সময়টা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, প্রচণ্ড শীত। ওদের তখন চাইনিজ নিউ ইয়ারের উৎসব চলছে । সারাদেশে আলোর ঝলকানি ,চারিদিকে লাল রঙের আধিক্য, এমন এক উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা পা রাখলাম দেশটিতে। মধ্যরাতে নামলাম সাংহাই এ । রাতের ঝলমলে আলোয় অদ্ভুত পরিপাটি আধুনিক এক শহর আমাদেরকে স্বাগত জানাল। এরপর গন্তব্য ছিল বেইজিং এবং সব শেষে চিরবসন্তের শহর কুং মিং। প্রতিটা শহরই ছিল নান্দনিক, পুরো ট্যুর ছিল অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ। আমরা মাত্র ২ টা চাইনিজ ওয়ার্ড জানতাম , ‘ নিহা’ এবং ‘ নিহামা’ যার অর্থ ‘ hello ‘ এবং ‘ how are you ? ‘ ওদের অবস্থা তো আরও খারাপ। ওরা yes / no জানে না। তাতে কী ? কোন কিছুই আটকে থাকেনি। বেড়ানো, কেনাকাটা, অচেনা পথ চেনা সবই সম্ভব হয়েছে নানা নাটকীয়তায়। মজার মজার ঘটনা ঘটেছে প্রতিদিন।
প্রথমদিন মাইলখানেক হাঁটার পর ম্যাকডোনাল্ডস খুঁজে পেয়ে চোখে ছিল খুশির ঝিলিক, তখন বুঝিনি যে একসময় এই আনন্দেও ভাটা পড়বে, বার্গারেও অরুচি এসে যাবে একসময় । দুপুরে ভাতের ব্যবস্থা ছিল কখনো সখনো, স্টিকি রাইসও অমৃত মনে হয়েছিল তখন। পর্ক এড়িয়ে খাবার যোগার করা সত্যিই বেশ কষ্টসাধ্য। খাবারের সমস্যা , দুর্বোধ্য ভাষা এবং মাইনাসের নিচের সূচ বিঁধানো তাপমাত্রাকে তুড়ি মেরে আমরা ৮ দিন উপভোগ করেছি চায়নার নান্দনিক রূপ। মানুষগুলো ভীষণ রকম শান্ত। প্রচণ্ড ভিড়েও কোলাহল নেই। সবাই কথা বলে নিচু স্বরে। বাচ্চারা অসম্ভব ভদ্র। পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলেও কাঁদে না, কষ্ট চেপে থাকার চেষ্টা করে ।
যেহেতু ওদের নববর্ষের ছুটি ৮ দিন, সবাই তখন পরিবার নিয়ে সময় কাটাতে ব্যস্ত। পারিবারিক বন্ধন বেশ মজবুত। পরিবারের প্রতি সবাই বেশ মনোযোগী। শিশুরা খুব কিউট, বড়রাও কম যায় না , তরুণীদের স্কিন মাখনের মত। তবে চোখ বিষণ্ণ , তাদের চোখ সহজে হাসে না। ছোট ছোট চোখে যেন ধরে রেখেছে বিষণ্ণ নদী। ফেইসবুক, হোয়াটস আপ এর দাপট ওখানে না থাকলেও ভীষণ জনপ্রিয় We Chat এ সবাই মন্ত্রমুগ্ধ। বুঁদ হয়ে আছে মোবাইল স্ক্রিনে। ভাষার জটিলতা অনেকটা সুরাহা করেছে মোবাইল এর translating apps, যখন ঐ পদ্ধতিও ব্যর্থ হয়েছে তখন নিরুপায় হয়ে বাংলা বলেছি, মাঝে মাঝে কাজও হয়েছে তাতে।এমন কিছু মানুষের দেখা পেয়েছি যারা ভীষণ রকম আন্তরিক এবং পরোপকারী। ভাষার জটিলতায় একটা বিষয় খুব ভালো ভাবে বুঝেছি যে ‘আমার এক প্যাকেট গ্রিন টি দরকার’ এই কথাটা দোকানীকে বোঝানোর চেয়ে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এটা বোঝানো অনেক সহজ।
আকাশপথে ঢাকা থেকে চায়নার দূরত্ব মাত্র দু’ঘণ্টা। কুনমিং এয়ারপোর্টে নেমে কানেক্টিং ফ্লাইটে সাংহাই যেতে লাগবে ৪ ঘণ্টা। মাঝে ১ ঘণ্টা ট্রানজিট। এর মাঝেই ইমিগ্রেশন। তখন বুঝিনি গোলমালের শুরুটা এখান থেকেই। চ্যাপ্টা মুখের অল্প বয়সী সুন্দরী ইমিগ্রেসন অফিসার তার ছোট ছোট চোখ যতটা বড় করা যায় তত বড় করে আমাকে যা সব বলল তার অর্থ কিছুই না বোঝা গেলেও এটুকু বুঝলাম আমি কী করে ভিসা ছাড়া চায়নায় ঢুকে গেলাম। আমি ইংরেজি বলা মাত্র সে কিছুই না শোনার জন্য প্রস্তুত হল। ইশারা ইঙ্গিতে আমাকে এলিয়েন সাব্যস্ত করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। বার বার হাত দিয়ে পাসপোর্টের পেইজে ইন্ডিকেট করল, ভিসা নেই কেন পাসপোর্টে ? মিঠু, আমার স্বামী লাইনের পিছনে ছিল। তার ডাক পড়েনি তখনও। সে লাইন ক্রস করে এলো আমাকে বাঁচাতে। মহিলা বক বক করেই চলেছে। এবং আমাদের কোন কথা শুনতে প্রস্তুত না সে। অবশ্য শুনবে কি ! ইংরেজি বুঝলে তো ! আমাদের হৈ চৈ শুনে , এরমাঝে দেবদূতের মত আবির্ভূত হলেন এক অফিসার। কর্তব্যরত মহিলা আবার ঐ অফিসারকে বোঝাল, আমি চায়না ঢুকে গেছি ভিসা ছাড়া।উল্লেখ্য আমার গভমেন্ট পাসপোর্ট এবং আমার পোর্ট এন্ট্রি, আমি ওখানে অন অ্যারাইভ্যাল ভিসা পাবো। অফিসার ইংরেজি বোঝেন। তিনি আমাদের দুজনকে লাইন থেকে সরিয়ে নিলেন, একটা সোফায় বসিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে চলে গেলেন ভেতরে।দেশের বাইরে গিয়ে পাসপোর্ট নিজের হাতে না থাকার অর্থ তো সবারই জানা। দুরুদুরু বুকে বসে আছি সোফায় । সে অফিসার আর ফেরে না। এদিকে সব অফিসারের চেহারা তো একই রকম। কে যে পাসপোর্ট নিয়ে গেছে চিনতেও পারব না। আমি মুখ কালো করে বসে আছি, মাথায় তখন একটাই চিন্তা, ১ ঘণ্টায় এ নাটক মিটিয়ে নেক্সট ফ্লাইট ধরতে পারব তো?
বেশ কিছু সময় পর অফিসার একটা ফরম হাতে নিয়ে আসলেন এবং পূরণ করতে বললেন। উনি নিজেই সাথে করে ঐ ফরম সহ আমাকে আবার লাইনে দাঁড় করালেন। এবার আর কোন ঝামেলা হল না। সহজেই সিল পড়ে গেল পাসপোর্টে। অফিসারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমরা দ্রুত পায়ে, প্রায় দৌড়ে এগিয়ে গেলাম ডোমেস্টিক জোনে। আগেই বলে রাখি চায়নায় এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি খুব কড়াকড়ি। দেশের বাইরে এতো ট্র্যাভেল করি, আমার কখনো লাগেজ খুলতে হয়নি কিন্তু এখানে খুলতে হয়েছে। কখনো ইনহেলার , কখনো পাওয়ার ব্যাংক, কখনো বা কোন কসমেটিক্স এ তাদের সমস্যা। বের করে হাতে দিয়ে বাংলায় বলি, ‘ রেখে দে।’ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে, তারপর আবার ফেরত দিয়ে দেয়। চেকিং শেষে ডোমেস্টিক লাউঞ্জে এসে দেখলাম অসংখ্য যাত্রী অপেক্ষা করছে কিন্তু কোন কোলাহল নেই, ভীষণ নীরবতা। সবার চোখ মোবাইল স্ক্রিনে। সবাই উই চ্যাট এ ব্যস্ত। চায়নায় কিন্তু ফেইস বুক, হোয়াটস আপ নেই, আছে জনপ্রিয় উই চ্যাট । বাচ্চারাও ভিডিও গেইমে মহাব্যস্ত । এয়ারপোর্টে বাচ্চাদের চেয়ারের সাথে ভিডিও গেইমের ব্যবস্থা আছে। কারও কোন হৈ চৈ নেই, সবাই যন্ত্রের সাথে যুক্ত এবং ব্যস্ত । কাপল যারা, একে অন্যের গায়ে হেলান দিয়ে আছে কিন্তু দুজনেরই চোখ মোবাইল স্ক্রিনে।
চার ঘণ্টার প্লেন জার্নি করে যখন সাংহাই এ এসে নামলাম, তখন মধ্য রাত। গাইড আমাদের জন্য নেইম প্লেট হাতে অপেক্ষা করছিল যার কারণে কোন সমস্যা হয় নাই। সাংহাই আলট্রা মডার্ন সিটি।সিটিতে এতো মডার্ন বিল্ডিং, একটার চেয়ে আরেকটা সুন্দর এবং অত্যাধুনিক ডিজাইনের।রাতের নিস্তব্ধতায়, ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলেছে হোটেলের দিকে, কোন মানুষজন নেই, মনে হচ্ছে যেন ভূতুরে মুভির কোন এক আধুনিক নগরী। হোটেল ‘ হলি ডে এক্সপ্রেস ‘ এর সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াল, গাড়ি থেকে নামতেই মনে হল হাত পা জমে যাচ্ছে, মুখে এসে বাতাস যেন সূচ ফুটিয়ে যাচ্ছে।হোটেল লবি কাঁচ দিয়ে ঘেরা । রিসিপশনের ছেলেটা আমাকে ইশারা ইঙ্গিতে জানাল, এখানে কফি আছে, আমি বাটন চেপে নিয়ে খেতে পারি। প্রচন্ড ঠাণ্ডায় আমি কিছুটা আরাম পেলাম গরম কফিতে চুমুক দিয়ে।
রুম চমৎকার ছিল, পাশেই রেল স্টেশন । রাতে ট্রেনের শব্দ শোনা যায়, মনটা ক্যামন করে ওঠে।সকালে বড় জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য মন ভালো করে দেয়। মন আরও চমকিত হয় ব্রেক ফাস্ট এর বুফেতে , মিষ্টি কুমড়া সিদ্ধ, ভুট্টা সিদ্ধ দেখে। প্রচুর খাবার কিন্তু আমাদের জন্য সুবিধাজনক না, ভাতের মারও ছিল সেই সাথে নুডুলসের ঝোল। এ ছাড়াও বিভিন্ন খাবারে মেশানো ছিল নিষিদ্ধ মাংস। আমি আধা ঘণ্টা ধরে খালি ঘুরেছি কোন খাবার নেব। ওদিকে ওরা সমানে ভুট্টা সিদ্ধ , মিষ্টি কুমড়া সিদ্ধ খেয়ে যাচ্ছে। ওদের খাওয়া দেখে আমি শুধু মনে মনে ভাবছি, কোন বাংলাদেশী ছেলে যদি ভালবেসে চীনা নারীকে বিয়ে করে তাহলে তাকে নিজেকেই রান্না করে খেতে হবে, না হলে খবর আছে !!!
সকাল সারে সাতটায় ড্রাইভার এসে আমাদের পিক করার কথা। গন্তব্য ডিজনি ল্যান্ড। আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে লাউঞ্জে বসে আছি। মিঠু স্মোকিং জোনে যাবার আগে বলে গেল ‘ খেয়াল রেখো ড্রাইভার এসে রিসিপশনে হয়ত আমাদের খোঁজ করবে। হোটেল রিসিপশনে একজন মাত্র ইংরেজি জানে , কাজেই সে ই একমাত্র ভরসা। আমরা তাকে বলে রেখেছি ড্রাইভার এলে যেন আমাদেরকে জানায়। লাউঞ্জে যেই এসে ঢোকে আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে তার গতিবিধি লক্ষ্য করি , সে আমাদের খোঁজ করছে কিনা। অনেকেই সোফায় বসে ওয়েট করছে। ঘড়িতে যখন ঠিক ৭ টা ৩০ , আমার পাশের সোফা থেকে একজন উঠে পকেট থেকে কাগজ বের করে মেলে ধরল যে কাগজে আমাদের নাম লেখা। আমি তাকে হাতের ইশারায় আশ্বস্ত করে মিঠুকে ডেকে আনলাম স্মোকিং জোন থেকে। মিঠু এসে বলে, ‘ ব্যাটা এতক্ষণ পাশে বসে আছে, আর আমরা ড্রাইভার খুঁজে মরছি।’ এতক্ষণ সেও বসে আছে আমরাও বসে আছি, সামনাসামনি, সারে সাতটার আগে কিছুতেই খোঁজ করবে না, কঠিন টাইমিং । আমাদের নিয়ে রওনা হল সে , প্রায় ১ ঘণ্টা পর নিয়ে এলো একটা বড় হোটেলের সামনে, ডিজনি পার্ক লেখা। আমাদের তো মাথা খারাপ। যাবো ডিজনি ল্যান্ড, এ ব্যাটা তো ডিজনি পার্কে নিয়ে এলো। কিন্তু কোন লাভ নেই সে এক বর্ণও ইংলিশ বোঝে না। বিশাল হোটেলের সামনে গাড়ি পার্ক করল। হোটেলের নাম টয় স্টোরি হোটেল। ড্রাইভার হোটেলের এক কর্মচারীর সাথে অনেক কিছু বলল, এবার সে কর্মচারী দোভাষীর ভূমিকা পালন করল। তার ইংরেজির অবস্থাও খুব ভালো না। আমাদের অনেক কষ্টে বুঝাল, ‘এখানে লাইনে দাঁড়াতে হবে, এখান থেকে সাঁটল বাস আমাদেরকে ডিজনি ল্যান্ডে নিয়ে যাবে। বিকেল ৫ টায় আবার ড্রাইভার এসে এখান থেকে আমাদেরকে নিয়ে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দেবে।’ তখনও বুঝিনি ফেরার সময় আমাদের জন্য কী চরম পরীক্ষা অপেক্ষা করছে।
বাস আমাদের ডিজনি ল্যান্ডে নামিয়ে দিল । বিশাল এরিয়া , অসংখ্য মানুষের ভিড়। মনে হচ্ছে গোটা চায়নার লোকজন এসে ভিড় করেছে। সকালের সোনা রোদে সবাই যেন ঝকমক করছে। চাইনিজ বাচ্চাগুলো দেখার মত, সব বাচ্চা একই রকম দেখতে, গোলগাল বৃত্তাকার আদুরে মুখ এবং সবাই ভদ্র। দর্শনার্থীরা সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমি আমার মোবাইলে বিভিন্ন ছবি তুলছিলাম, মানুষজন , গাড়িঘোড়া সবকিছুর। মিঠু কিছুটা বিরক্ত হল আমার ছবি তোলার জন্য কারণ দ্রুত পা চালিয়ে আমাদের ভেতরে ঢুকতে হবে। ভেতরে ঢোকার মূল গেইট খুঁজে পেতে প্রায় আধা ঘণ্টা লেগে গেল।আমাদের টিকিট অনলাইনে আগেই কাটা ছিল জন্য লাইনে দাঁড়াতে হল না। ভেতরে ঢুকে দিশেহারা কোনটা থেকে শুরু করব। প্রতিটা শো দেখতে বিশাল লাইন।প্রথমে টারজানের শো দেখলাম। নিজে না দেখলে লিখে বোঝানো যাবে না, কতটা মনোরম সেই শো। এরপর “পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ান” , লাইনে থাকতে হয়েছে ২ ঘণ্টারও বেশী সময়। পরে এমন অবস্থা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। কিন্তু শো এর ভেতরে যখন বোটে করে প্রবেশ করলাম, অবিশ্বাস্য ! মনে হল আমরা সমুদ্রে সেই মুভিটার মধ্যেই প্রবেশ করেছি, সাইক্লোন , জলদস্যু , গুপ্তধনের খাজানা … সব মিলিয়ে সিনেমাটিক এক পরিবেশ যা নিজে না দেখলে বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব না।
পুরো ডিজনি ল্যান্ডে বিরাজ করে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। তবে একদিনে সব শো দেখা সম্ভব হয় না। বিকেলে শোভাযাত্রা বের হয় শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য। এতো আনন্দের মাঝে ঘড়ির কাঁটা জানান দিল ৫ টায় আমাদের সেই হোটেলের সামনে পৌছাতে হবে । অনেকটা হেঁটে আগের প্লেসে এলাম সকালে যেখানে সাঁটল বাস আমাদের নামিয়েছিল। এসে দেখি সব ফাঁকা, কোন বাস নেই। এখন উপায় ?
চারিদিকে অসংখ্য মানুষ কিন্তু কেউ আমাদের কথা বুঝতে পারবে না , এবং আমরাও বোঝাতে পারব না আমাদের বাস ধরে সেই হোটেলের সামনে যেতে হবে , যেখানে আমাদের জন্য আমাদের গাড়ির ড্রাইভার অপেক্ষা করবে। অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম কোথাও সেই বাস নেই, পারকিং এ গিয়েও খুঁজলাম সেখানে শুধু মাইক্রো । চোখে জল আসার অবস্থা। মিঠু আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে ‘ মন খারাপ করো কেন ? একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে চলে যাবো ।’ আমি অসহায় কণ্ঠে বলি, ‘ ট্যাক্সিওয়ালা তোমার ভাষা বুঝলে তো তোমাকে হোটেলে নিয়ে যাবে !’
এরপর আমি তৎপর হলাম, নিজের বুদ্ধি কাজে লাগালাম। সকালে যে ছবিগুলো তুলেছিলাম, বাসেরও ছবি ছিল তাতে, বাসের নম্বর প্লেট সহ। সেটা বের করে পুলিশকে দেখালাম । এইবার তারা কিছু বুঝল হয়ত, হাত ইশারায় কোন একটা জায়গা দেখাল। এরপর কিছুটা গিয়ে আবার দেখালাম সিকিউরিটি গার্ডকে, সেও হাত ইশারায় দেখাল ‘ ঐ পথে’ । এভাবে ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে ঠিক পেয়ে গেলাম বাস। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে নীল নীল সেই সাঁটল বাস। দুজনেরই মুখে হাসি এবার। মিঠু বলল তাড়াতাড়ি উঠে পড়। আমি এখন হুসিয়ার, কোথায় নামাবে ঠিক নেই , ভুল বাসে উঠেছি কিনা। উঠেই বাসের ড্রাইভারকে আবারও ছবিটা দেখালাম , সে ইশারায় বোঝাল আমরা যেটাতে উঠেছি সেটা যাবে না ঐ দিকে, সামনের বাসেটা আমাদের জন্য ঠিক। তার কথা মত সামনের বাসটায় উঠে গেলাম এবং সেই বাসের ড্রাইভারকে ছবি দেখিয়ে কনফার্ম হলাম যে আমরা ঠিক বাসেই উঠেছি।ওয়াসফিয়া , নিশাত মজুমদার যতটা আনন্দিত হয়েছিল এভারেস্টে উঠে , তার চেয়েও বেশী আনন্দিত হয়েছিলাম সেই নীল রঙের সাঁটল বাসে উঠে যেটা আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে নামিয়েছিল।
ডিজনি ল্যান্ড থেকে ফিরে সন্ধ্যায় হেঁটে দেখলাম হোটেলের আশেপাশের সবকিছু। আগের বলেছি রুম থেকে রেল স্টেশন দেখা যায়। এবার দেখলাম স্টেশনে যাবার বিশাল আন্ডার পাস। চায়নায় তখন নিউ ইয়ারের ছুটি , চাইনিজ নিউ ইয়ার তাদের সবথেকে বড় উৎসব। ৮/১০ দিন ছুটি থাকে । সেসময় যারা কাজ করে তাদের ডবল পেমেন্ট করতে হয়।সারা দেশ আলোক সজ্জায় সেজেছে তখন । মেয়েরা সবাই লাল ওভারকোট পরে উৎসবের কয়দিন। চারিদিকে লালে লাল।বেশিরভাগ দোকান পাট বন্ধ।রাস্তায় ভুট্টা সিদ্ধ বিক্রি করছে চীনা রমণী। আমরা হেঁটে হেঁটে ডিনারের জন্য খুঁজছিলাম কোন চেইন শপ। খুঁজে পেলাম ম্যাগডোনাল্ডস, হোটেলের কাছাকাছিই ছিল । খুব খুশি হলাম পেয়ে। ছবি দেখে দেখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে খাবার চাইলাম ।এই প্রথম দেখলাম ম্যাগডনাল্ডস এ ভুট্টা সিদ্ধ বিক্রি হয়। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ছিল সাথে কনকনে শীত, সবাই ঘরে ফেরার জন্য রেল স্টেশনের দিকে যাচ্ছে। আমরা হোটেলে ফিরে এলাম । আগামী কাল ডে লং প্রোগ্রাম, নতুন গাইড আসবে নিতে।
সকালে নির্দিষ্ট সময়ে গাইড এলো, গোলগাল চেহারা, ইংরেজি জানে। ১০ সিটের মাইক্রো নিয়ে এসেছে। আমরা ছাড়াও আরও একটা কাপল ছিল যারা মায়ামি থেকে এসেছে, আরেকজন সিঙ্গেল, ফ্লোরিডা থেকে এসেছে, তার মুখও লাল চুলও লাল বিশাল দেহী। পাঁচ জনের গ্রুপ নিয়ে গন্তব্য সাংহাই মিউজিয়াম। সেখানে লম্বা লাইন। চীনের ইতিহাস এবং কালচার অনেক রিচ কাজেই মিউজিয়ামও অনেক বড়। চারটা ফ্লোরে ভাগ করা। মিউজিয়ামে ২ ঘণ্টা কাটিয়ে আমরা ওদের দুটো টেম্পল ঘুরে দেখলাম। ডে ট্যুরের সাথেই লাঞ্চ ছিল। ওরা আগেই জেনে নিয়েছিল আমাদের কোন কিছুতে আপত্তি আছে কিনা। আমরা পর্ক এর কথা জানিয়েছিলাম, সেভাবেই ওরা ব্যাবস্থা করে। এই প্রথম ভাত খেলাম, স্টিকি রাইস সাথে চিকেন এবং অন্যান্য আইটেম। কালো রঙের একটা খাবার ছিল , আমি টেস্ট করলাম, জিজ্ঞেস করলাম খাবারটার নাম , গাইড জানাল সেটা ‘ ফাঙ্গাস ‘। শুনে খাওয়া বন্ধ করলাম। চীনারা খাবারের পর চা খায়, জগ ভরে চা দিয়ে গেল, ঠাণ্ডা চা। গরম চায়ের প্রচলন নেই ওদের। এরপর হারবারে নিয়ে গেল, চমৎকার প্লেস কিন্তু ঠাণ্ডায় কাবু করে ফেলার মত বাতাস। চায়নার রেশম শিল্প কিন্তু বিখ্যাত। আমাদের রাজশাহী সিল্ক কিন্তু ওদের সুতাতেই হয়। রেশম মিল পরিদর্শন করে আমরা শহরের একটা আধুনিক এরিয়ায় গেলাম যেখানে লেখা ছিল ” ওয়ে টু হেভেন ” , ” স্বর্গের পথ।” জায়গাটা খুব চমৎকার , সব জায়গায় উৎসবের সাজসজ্জা এবং একটু ভিন্ন ধাঁচের, আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। এরপর আমাদের নিয়ে যায় ওল্ড টাউনে, অনেকটা আমাদের পুরান ঢাকার মত। উদ্দ্যেশ ইউ গার্ডেন দেখানো এবং নববর্ষ দেখানো । আমাদের দেশে রমনায় যেমন ভিড় হয় তার চেয়ে কয়েকগুণ ভিড় ঠেলে আমরা নির্দিষ্ট ‘ ইউ গার্ডেনে’ হেঁটে আসি। এর ভীরের মধ্যে দলছুট হবার ভয় ছিল। সব চাইনিজ তো একি রকম চেহারা, গাইডের চেহারা মনে রেখে হেঁটে দেখা যায় অন্য লোকের পিছন পিছন যাচ্ছি। মিঠু বলল , ‘ ফ্লোরিডার ঐ লাল চুল , লালমুখ বিশাল ফিগার ফলো করো তাইলে আর দলছুট হবে না।’ সবশেষে সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে হোটেলে কারণ সন্ধ্যায় আমরা বেইজিং যাবো। অত্যাধুনিক হাই স্পিড বুলেট ট্রেনে । তখন অবশ্য আমরা জানি না, আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে আরও নাটক …
হোটেল থেকে বের হওয়ার আগে মিঠু কিছু ডলার কনভার্ট করে নিল চাইনিজ কারেন্সিতে। স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম। ব্যাংকে বা মানি এক্সচেঞ্জে যেতে হয় না। হোটেলে মেশিন বসান আছে, সেখানে পাসপোর্ট স্ক্যান করে ডলার ঢুকিয়ে দিলেই চাইনিজ কারেন্সি বের হয়ে আসে। আমাদের তখন দরকার ছিল না, তবুও কেন যে মিঠু সেটা করল এবং পরে বুঝেছিলাম কতটা ভাগ্য ফেভার করেছিল সেটা। যাই হোক , নির্দিষ্ট সময়ে ড্রাইভার এসে আমাদের নাম লেখা কাগজ সামনে ধরল। আমরা তাকে অনুসরণ করে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলতে শুরু করতেই সে তার মোবাইল এগিয়ে দিল।মেসেজ ইংলিশে কনভার্ট হল। ড্রাইভার লিখেছে ‘ কোন রেল স্টেশনে তোমাদেরকে নামাবো ?’ কয় কী ? কয়টা রেলস্টেশন আছে ??? হাতে একদম মাপা সময়, ঠিক সময়ে স্টেশনে পৌঁছাতে হবে। মিঠু ওকে ট্যুর আইটিনারি দেখাল, সে কিছুই বুঝল না। পরে নিজে ঐ মোবাইলে টাইপ করে দিল বুলেট ট্রেন ধরব, বেইজিং যাবো। সেটা ওর ভাষায় অনুবাদ হল। সে কতটা বুঝল জানিনা , আমাদেরকে বিশাল এক স্টেশনের গেইটে নামাল এবং বিদায় নিল।আমাদেরকে বলা ছিল আমরা আমাদের অনলাইন বুকিং কপি টিকিট কাউন্টারে দেখিয়ে আমাদের টিকিট নেব। কপিটা কাউন্টারে দেওয়ার পর একজন কম্পিটারে চেক করে এগিয়ে এলো, জানাল আমাদের যে বুকিং ওটা দিয়ে টিকিট পাবো না আমরা। শুনে মাথা পুরা শূন্য হয়ে গেল , কয় কী !!! চারিদিকে হাজার হাজার প্যাসেঞ্জার, আমাদের ঈদের মৌসুমে যেমন ভিড় থাকে। টিকিট না দিলে কিভাবে হবে, বেইজিং এ ড্রাইভার ওয়েট করবে, রুম বুকিং করা আছে , সকালে গাইড পিক করবে ঐ হোটেল থেকে, সব চেইন । একটা ব্রেক হলে সব ব্রেক। কিন্তু কে কার কথা শোনে। মিঠু হাল ছাড়ার মানুষ না , আমাকে দিয়ে আরেকটা কাউন্টারে ফের টিকিট চাইল। এবার কাউন্টারের লোক ভেতরে গেল, আর কোন খবর নেই। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি ওর দিকে। ও আমাকে আশ্বস্ত করছে কোন না কোন ব্যাবস্থা হবেই। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা মেয়েকে পাঠাল, সে সামান্য ইংলিশ জানে। সে বলল, ‘ তোমাদের বুকিং এ টিকিট পাবে না , কারণ তোমাদের পাসপোর্ট নম্বরে ডিজিটের আগে লেটার আছে কিন্তু ওদের সিস্টেমে শুধু নম্বর , কোন লেটার নেই, কাজেই ম্যাচ করে না। এখন টিকিট নগদ কিনতে হবে।’ মিঠু তার সব চাইনিজ মানি বের করল , যা কিছুক্ষণ আগে ভাঙ্গিয়েছিল হোটেলে। মেয়েটি দুটো টিকিটের টাকা নিয়ে ভেতরে গেল। কিছুক্ষণ পর এসে আমাদের হাতে টিকিট দিল এবং আমাদের বুকিং এর কাগজে কিছু লিখে দিল , যার অর্থ ১৫ দিন পর বুকিং এর টাকা ফেরত পাওয়া যাবে, ক্লেইম করলে।
যাক বাবা এ যাত্রায় রক্ষা। এবার ভেতরে যেতে পারি।স্টেশন বিশাল বড়, সুন্দর পরিপাটি, এয়ারপোর্টের মত। ট্রেনও খুব সুন্দর। ৪ ঘণ্টা লাগে বেইজিং এ যেতে। ঘটায় ৩৫০ কিলমিটার গতি।বুলেট ট্রেন নতুন এক্সপেরিয়েন্স ছিল আমাদের জন্য।আমাদের পেছনের সিটে ছিল চমৎকার এক বাচ্চা যার নাম ক্যান্ডি। ক্যান্ডির মা ইংলিশ জানে, সে আমাদের সাথে অনেক কথা বলে এবং নামার সময় হেল্প করে কোন দিকে যেতে হবে। সমস্যা হল বের হওয়ার গেইট বেশ কয়েকটা। আমরা বুঝতে পারছিনা ঠিক কোন গেইটে ড্রাইভার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল, ড্রাইভার কল করে কথা বলছে, আমরা কিছুই বুঝিনা। মিঠু ইংরেজি বলে ড্রাইভার বোঝে না। আমি বুদ্ধি করে মোবাইলটা ধরিয়ে দিলাম এক মহিলা অফিসারকে , যে তখন ডিউটিতে ছিল প্ল্যাটফর্মে। মোবাইলে কথা বলে ওরা নিজেরাই বুঝে নিল বিষয়টা এবং ঐ মহিলা অফিসার আমাদেরকে একেবারে ড্রাইভারের কাছে এনে হস্তান্তর করল।
মাইনাস টু টেম্পারেচারে মধ্যরাতে যখন বেইজিং এর হোটেলে চেক ইন করতে গেলাম , রিসিপশনের ছেলেটা আমাদের বুকিং পেপার দেখে কোন মতে ইংরেজিতে বোঝাল এটা আমাদের হোটেল না। দুটো হোটেল খুব কাছাকাছি নাম । ড্রাইভার ভুল করে আমাদের নামিয়েছে এখানে। কথা শোনা মাত্রই আমি দৌড় দিলাম বাইরে, মিঠু তখনও রিসিপশনে কথা বলেই চলেছে। বাইরে এসে দেখি ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে কেবল। আমি হাত নেড়ে ডাকি, হ্যালো হ্যালো, হেই হেই … কোন কাজ হয় না। এরপর বাংলা,’এই শোন, শোন , যাসনে থাম থাম…’ এবার কাজ হল। সে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এলো। তাকে তো বোঝাতে হবে যে সে ভুল হোটেলে নামিয়েছে এবং সেটা বোঝানো আমার ক্ষমতার বাইরে। কাজেই আমি তাকে ধরে নিয়ে গেলাম রিসিপশনের ছেলেটার কাছে, সেই বাকিটা করে দিল। এবার ড্রাইভার আবার আমাদেরকে নিয়ে রওনা দিল সঠিক গন্তব্যে।
আমার মেজাজ খারাপ, রাত দুটোয় এই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় সে আমাদেরকে অন্যখানে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল, সে তো মোটেও প্রফেশোনাল না।এরপর সঠিক হোটেলে যখন চেক ইন করলাম রিসিপশনে লাল রাজকীয় ড্রেসে সুজজ্জিত ছেলেটা মোবাইল টিপে টিপে ট্রান্সলেটিং অ্যাপস এ জানতে চাইল আমরা বিজনেস পারপাজে এসেছি কিনা। বেড়াতে এসেছি শুনে আবারও স্বাগত জানাল। এবার আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে মোবাইল এগিয়ে দিয়ে জানতে চাইল, ‘তোমাদের তো একটা রুম বুকিং দেওয়া আছে, তোমরা কি একসাথেই থাকতে আগ্রহী ?’ আমি অসহায় দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালাম , এই মধ্যরাতে , ক্লান্ত শরীর যখন বিছানা খুঁজছে, তাকে নাকি এখন বুঝাতে হবে আমরা এক রুমে থাকতে চাই কিনা। ইংরেজি বুঝলে তাও না হয় কথা ছিল। আমি নিরাশ হয়ে সোফায় গিয়ে বসলাম। মোবাইল এ টাইপ করে করে তাকে বোঝানো হল যে আমরা হাসবেন্ড ওয়াইফ এবং আমরা একটা রুমই বুকিং দিয়েছি। এরপর সে আমাদেরকে তার বিগলিত হাসি উপহার দিল, যা দেখে আমি শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করলাম ‘ হ্যাপি হইছ ? ‘ ও কি বুঝল জানিনা তবে আমাকে সে আবারও তার হাসি উপহার দিল। রুমে যাবার জন্য ছটফট করছি, এর মাঝে ড্রাইভার মোবাইলে কি যেন লেখা শুরু করল। ইংরেজিতে অনুবাদ হয় কিন্তু সেটাও দুর্বোধ্য, সে আবারও লেখে আমরা বুঝিনা। ৩ বার চেষ্টায়ও বিফল হয়, চতুর্থ বার আবার লেখে আমি মোবাইল হাত থেকে নিয়ে দেখি অনুবাদ এসেছে ” বাকশিস “। এবার আমি হেসে দিলাম। বাংলায় বললাম ‘ তুমি যে মহৎ কর্ম করেছো, বকশিস তো দিতেই হবে।’
বেইজিং আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল গ্রেটওয়াল। খুব ভোরে গাইড সাবরিনা নিতে এলো আমাদেরকে। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে যেতে হবে। যেয়ে দেখি লম্বা লাইন, আমাদের আগেও বহু মানুষ এসে লাইনে দাঁড়িয়েছে।যেহেতু চাইনিজ হলি ডে, উপচে পড়া ভিড়। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলি, চায়নায় বসবাস করেও এতদিন এরা চীনের প্রাচীর দেখতে আসার সময় পায় নাই ! সাবরিনার টিমে আমাদের সাথে আরও এক দম্পতি ছিল ক্যামেরুন এবং কোরা। চমৎকার কাপল। ক্যামেরুন ব্রিটিশ, কোরা ফিলিপিনো। ওরা কিছুদিন বাংলাদেশেও ছিল চাকরীর সুবাদে। আরও ছিল পেরুর হেলেনা। হেলেনা এসেছে দিল্লীতে ‘মাস্টার সেফ’ এর একটা কোর্স করতে। দিল্লী যাবার পথে একদিনের জন্য চায়না এসেছে শুধুমাত্র গ্রেট ওয়াল দেখার জন্য। লাইনে দাঁড়িয়েই আমরা পরিচয় পর্ব সেরে নেই, গল্প কথায় এগোতে থাকি।দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর টিকিট যোগার করে ফিরে আসে সাবরিনা। ক্যাবল কার আমাদেরকে নিয়ে সরাসরি উপরে চলে যায়। যাবার পথের চমৎকার পাহাড়ি ভিউ, মহাপ্রাচীরের সর্পিল পথ চলা, অনন্য এক মুহূর্ত।
পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলা এই দেয়াল ঋতু পরিবর্তনে সাজে নতুন নতুন সাজে। কখনো ফুলে ফুলে ঢেকে যায় কখনো বা ছুঁয়ে যায় তুষারের শুভ্রতায়। আমরা গিয়েছিলাম পাতা ঝরা সময়ে, তখন কোন ফুল ছিল না, ছিল আলাদা কাঠিন্য, আলাদা গাম্ভীর্য। আমার কেবলই মনে হয়েছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এর নির্মাণ কাজ কতটা কঠিন ছিল। কথিত আছে চীনের প্রথম সম্রাট কিং সি হুয়াং এই প্রাচীর প্রথম ব্যবহার করেছিলেন শত্রুর হাত থেকে নিজের সম্রাজ্যকে রক্ষার জন্য। এই অবিচ্ছিন্ন লম্বা দেয়ালে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার, যেখানে সেনারা পাহারায় থাকতো ।সাথে আছে সেনাদের জন্য বিশ্রামস্থল। ধারণা করা হয় মিং সাম্রাজ্যের সময় প্রায় ১০ লক্ষ সেনা এই মহাপ্রাচীরটির পাহারায় নিয়োজিত থাকতো। এটি ছিলো তাদের সামরিক প্রতিরক্ষার দূর্গ।
সিঁড়ি বেয়ে ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য, বিশেষ করে আমাদের বয়স্ক সঙ্গী ক্যামেরুন এর জন্য। কোরা বার বার জিজ্ঞেস করছিল ‘ আর ইউ ওকে ক্যামেরুন?’
হাঁপিয়ে ওঠা ক্যামেরুন প্রতিবারই উত্তর দিচ্ছিল, ‘ আই অ্যাম ফাইন।’ এদিকে তার ঘন ঘন নিঃশ্বাস প্রশ্বাস জানান দিচ্ছিল সে ঠিক নেই। আমার স্বামী পুরোপুরি নিয়োজিত হল তাকে সিঁড়িতে উঠতে সাহায্য করতে। আমি, কোরা, হেলেনা ৩ দেশী নারী মিলে গেলাম গল্প গুজবে। ঐদিনের দুপুরের খাবার ছিল খুব সুন্দর। সাবরিনা আগেই জেনে নিয়েছিল কে কোন জিনিস খায় না। সেসব বাদ ছিল মেনুতে, পিকিং ডাক ছিল সেদিন।খাবারের স্বাদ বেশ ভালো ছিল।
প্রকৃতি এবং শৈলীর সমন্বয় সামার প্যালেস।’ওয়েস্ট লেকে’র বরফ হয়ে যাওয়া জল আর অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ মনে করিয়ে দেয় রূপকথার কাহিনীর কথা। ‘ড্রাগন গড টেম্পল’ যেখানে প্রার্থনা করা হত বৃষ্টির জন্য।রানী সামার প্যালেসে থাকা কালীন এখানেই প্রার্থনা করতেন।সামার প্যালেসের ‘লং কোরিডর’ও দেখার মতো স্থাপনা। ১৪০৬ সাল থেকে ১৪২০ সালের মধ্যে ফরবিডেন সিটির মূল কয়েকটি স্থাপনা গড়ে ওঠে বলে ধারণা পাওয়া যায় । ফরবিডেন সিটি ছিল চীন সম্রাটদের বাসস্থান এবং পাঁচশ’ বছর ধরে চীনের প্রশাসনিক ক্ষমতার মূল কেন্দ্র।সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ ছিল এই জায়গা।সম্রাটের অনুমতি ছাড়া এ এলাকায় কেউ প্রবেশ করতে বা এলাকা ত্যাগ করতে পারতো না বলে এর নাম ‘ফরবিডেন সিটি’।ফরবিডেন সিটি এখন আর নিষিদ্ধ নেই। পুরো ফরবিডেন সিটি এখন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত।
সাংহাই এবং বেইজিং এর হাড়কাঁপানো শীতের প্রকোপ থেকে যখন আমরা কুনমিং এ এসে নামলাম , আহ ! শরীরে মনে তখন দারুণ প্রশান্তি। ফেব্রুয়ারির দারুণ শীতেও বসন্তের আমেজ। কুংমিংকে বলা হয় চিরবসন্তের শহর , ফুলের শহর। এই শহরই ইউনান প্রদেশের রাজধানী। শহর থেকে ৮৫ কিলমিটার দূরে অপেক্ষা করে আছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর এক ওপার বিস্ময় যার নাম “স্টোন ফরেস্ট “। ভূতত্ত্ববিদদের মতে ২৭০ বছর আগে এই পাথরের বন সমুদ্রের নিচে ছিল। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা ভূমিকম্পে অথবা প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে সমুদ্রের পানি শুকিয়ে এই পাথরের বন জেগে ওঠে। প্রাকৃতিক ভাবেই পাথরের অদ্ভুত সব গড়ন, কোনটা হাতী , ঘোড়া , কুমির, কোনটা বা নেপলিয়নের হ্যাট। এরিয়া অনেক বড়, ট্রামে করে ঘোরা যায় । গাইড চীনা মেয়েরা ওখানকার মনোরম ট্রাডিশনাল পোশাক পরে পর্যটকদের স্টোন ফরেস্ট ঘুরিয়ে দেখায়। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়ানোর সময় ভাবতেই রোমাঞ্চ লাগে যে এই জায়গা এক সময় সমুদ্রের তলদেশে ছিল।
হোটেলে ফিরে রাতে আর ইচ্ছে করছিল না ৫ কিলোমিটার হেঁটে বার্গার খেতে যেতে, এই ক’দিনে বার্গারে অরুচি এসে গেছে। ঠিক করেছি আগামী ১ বছর আর বার্গার মুখে নেব না। স্বামীকে বললাম, ‘ মানুষ প্রিয়জনকে বলে চন্দ্র সূর্য এনে দিতে। আমাকে কেউ সুযোগ দিলে বলতাম, একটু ভাত এনে দিতে। ঝরঝরে ভাত।’ শুনে সে মৃদু হাসল।আমাকে টিভি দেখতে বলে নিচে গেল, আর ফেরে না। আমি টিভিতে চাইনিজ নাটক শেষ করে ফেললাম । অনেক পরে সে ফিরে এলো প্লেট হাতে নিয়ে। ঢাকনা খুলে দেখি, আহ ! ধোঁয়া ওঠা ফ্রায়েড রাইস ! ।পরিমানে কম কিন্তু এতো স্বাদের ফ্রায়েড রাইস আমি জীবনে খাইনি।চাইনিজ হলি ডে র জন্য রাতে ওদের কিচেন বন্ধ কিন্তু ‘বার’ খোলা ছিল। বারে গিয়ে মিঠু বারের ম্যানেজার মহিলাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ওদের কিচেন থেকে এইটুকু রান্না করিয়ে নিয়ে এসেছে। ভদ্রমহিলা ইংরেজি পারেন কিছুটা, উনিই ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন।
চলে আসবার আগের দিনের বিকেলবেলার ছোট্ট একটি গল্প দিয়ে শেষ করতে চাই। লোকাল মার্কেটে ছোটখাটো কেনাকাটার ব্যস্ততা।ছোট ছোট দোকানে কানের দুল সাজানো। এক কানে সুন্দর দুলটা ধরে আমি স্বামীর মতামতের অপেক্ষায়। সে কিছু বলবার আগেই পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘beautiful’ টানা আট দিনের চীন সফরে দারুণ ভাষা সংকটে এক টুকরো ইংরেজি ওয়ার্ড যেন পানি ছিটিয়ে দিল শুষ্ক মরুতে। সহসা পিছন ফিরে তাকালাম। এক মধ্যবয়সী নারী সহাস্যে আমার দিকে তাকিয়ে , are you Indian ? আমি হেসে বললাম ‘ না, বাংলাদেশী ‘। সে বাংলাদেশ চেনে না। আমি তাকে এবার ‘ঢাকা’র কথা বললাম। সে দু একবার ঢাকার নাম শুনেছে হয়ত তবে এটুকু বুঝল ইন্ডিয়ার পাশে।
ফর্সা বেঁটে খাটো মহিলা কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, চোখ দুটো হাসছে। ৮ দিনে এই প্রথম আমি কারও চোখ হাসতে দেখলাম। সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের চোখে কোন ভাষা নেই। মাছের চোখের মত চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মেয়েগুলো, যেন চোখে তাদের এক সমুদ্র দুঃখ। চোখ হাসে না ওদের। এই মহিলা দেখলাম ব্যাতিক্রম, তার দুচোখে আত্মবিশ্বাসের ছাপও স্পষ্ট।’ তোমার বয়স কত ?’ ‘আমার বয়স ?’ আমি একটু অবাক হই তার প্রশ্নে।
সে স্পষ্ট ইংরেজিতে বলে , ‘ yes , your age .’ আমি তাকে বয়স জানালাম ‘ ওহ তোমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না। আমি তোমার চেয়ে ৫ বছর কম। অথচ দেখো আমাকে কত বয়স্ক লাগছে।’ আমি বিষয়টা এড়িয়ে যাবার জন্য জিজ্ঞেস করলাম’ তুমি কি এখানকার ?’
‘ হ্যাঁ আমি কুংমিং এর। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ দেখিয়ে বলল আমি একজন পেইন্টার, এই যে সব গুছিয়ে নিয়ে এখন বাড়ি যাচ্ছি। পথে বসে টুরিস্টদের ছবি আঁকি সারাদিন, সন্ধ্যায় বাড়ি যাই।’ আমি তাকে বললাম ‘ তুমি তো বেশ ভালো ইংরেজি বল …’ সে বলল, ‘ আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে ফলো করছি। তোমার চোখ খুব সুন্দর। আমি এতক্ষণ পেইন্টারের চোখ দিয়ে দেখছিলাম তোমার চোখদুটো।’
এবার আমার লজ্জা পাবার পালা। লাজুক চোখে স্বামীর দিকে তাকালাম দেখি তার চোখে হাসির আভাস।
তার প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। স্বামীকে অনুযোগের সুরে বললাম, জীবনে তো কখনই বল নাই যে আমার চোখ সুন্দর ! ভিনদেশী নারীর কাছে চোখের প্রশংসা শুনে মনে তখন আমার কাশ ফুলের মৃদু দোলা। জীবনে কোন পুরুষ মিথ্যে করেও বলে নাই যে আমার চোখ সুন্দর, তবে এক নারী যখন আরেক নারীর চোখে সৌন্দর্য খুঁজে পায়, তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়।
শেষ বিকেলের নরম রোদ চারিদিকে। কমলা রঙের বিকেলটা সত্যিই দারুণ সুন্দর। এতো এতো ফুল চারিদিকে । এখানে নাকি সারাটা বছর বসন্ত।এই শহরকে ঘিরে এমন একটা মিষ্টি স্মৃতি যখনই মনে পড়ে, আমাকেও ছুঁয়ে দিয়ে যায় বসন্ত বাতাস।
সোহানা স্বাতী