ভ্রমণপিপাসু সবার মনের মাঝেই ইউরোপ ট্যুরের একটা সুপ্ত বাসনা থাকে। আসলে ইউরোপের সেনজেনভুক্ত যেকোন একটা দেশে ভিসার আবেদন করলে, এক ভিসাতেই সেনজেনভুক্ত ৩১টা দেশে ভ্রমণ করা যায় আর দেশগুলোর ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা এতোটাই ভালো যে, আমাদের উত্তরা থেকে গুলিস্তান যেতে যে সময় লাগবে, সেই একই সময়ে ওদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাওয়া যায়, তাও একদম নির্ঝঞ্জাট ভাবে। তাই ইউরোপে পা দিলে সবাই কয়েকটা দেশ একসাথেই ঘুরে আসার প্ল্যান করে। বার বার ছুটি নেওয়া, বিমানভাড়া, ভিসার আবেদন করার থেকে একবারে কয়েকটা দেশ ঘুরে আসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে ইউরোপে আসলে কয়টা দেশে পা রাখলেন, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আপনি কয়টা সিটিতে ঘুরে আসলেন। কারণ আপনি চাইলে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির মত বড় যেকোন দেশের কয়েকটা শহর বাছাই করতে পারেন৷ অথবা একই খরচ, একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশের কয়েকটা শহর বাছাই করে ঘুরে আসতে পারেন।
অনেকের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকলেও ভিসা পাওয়ার জটিলতার কারণে হয়তো ইউরো নিয়ে তেমন প্ল্যান করা হয়না, কিন্তু এশিয়ার অনেক ব্যায়বহুল শহরেই তারা ঘুরে আসে ছুটি কাটাতে। সেই হিসেবে ইউরোপের ভিসা পাওয়াটা আমাদের জন্য অনেক বেশি সহজ ছিল, এইজন্যই সুযোগটা মিস না করাই ভালসিদ্ধান্ত ছিল বলে আমাদের মনে হয়।
এই ট্যুরটা ছিল আমাদের দুজনের একসাথে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় একটা ইভেন্ট। দুজন দুই দেশে থেকে একটু একটু করে দুজনের পছন্দের জায়গাগুলি সিলেক্ট করে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছি। আমাদের প্ল্যান ছিল ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে এই ট্যুরটা করার। তাই শুধু ইউরোপের কোন জায়গার ভিডিও দেখলেই “এখানে যাবো” এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের প্ল্যান। কিন্তু আমাদের ট্যুরের এক্স্যাক্টলি ২ মাস আগে হঠাৎ করেই ও জানালো ফেব্রুয়ারী যেহেতু শীতকাল, আমাদের উচিৎ অবশ্যই অক্টোবরের ছুটিতে ইউরো ট্রিপে যাওয়া। আমার তো হঠাৎ করেই মাথার উপর একটা দুই মাসের টাইট শিডিউলের এসাইনমেন্ট এসে পড়লো। কারণ কাগজপত্র রেডি করা ছাড়া হোটেল বুকিং, ইন্টার্নাল ট্রান্সপোর্ট আর সাথে ঘোরাঘুরির পুরো আইটিনারিটা তৈরি করার দায়িত্ব আমার, কারণ ও তখন দূর্গম নেটওয়ার্কবিহীন একটা জায়গায় দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। তাই একদিনের মধ্যেই ওর দিকের পেপারগুলো সব রেডি করে আমাকে স্ক্যান করে পাঠিয়ে দিল, তারপর শুরু হলো আমার কর্মযজ্ঞ। আর বুঝতে পারলাম ঘরে বসে স্বপ্ন দেখা আর প্র্যাক্টিক্যালি কাজ করার মধ্যে কতটা পার্থক্য। এদিকে ফ্রেঞ্চ এম্বাসিতে ভিসা আবেদনের কাগজপত্র জমা দেওয়ার এপোয়েন্টমেন্ট পাই ১ মাস ১৯ দিন পর, মানে সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ, আবেদনের প্রায় ১০ দিন পর ভিসা দেয় সাধারণত। যেখানে আমাদের ট্যুরই শুরু হবে অক্টোবরের ৫ তারিখ। তার মানে ট্যুরের মাত্র ২-৩ দিন আগে আমি জানতে পারবো ভিসা পেয়েছি কিনা। এবং এত বড় ট্যুরে ২-৩ দিনে হোটেল বুকিং, ইন্টার্নাল ট্রান্সপোর্টের টিকিট করাও সম্ভব না। তাই ভিসার জন্য অপেক্ষা না করে আগে থেকেই বিমান টিকিট থেকে শুরু করে সবকিছু করে ফেলতে হলো, সাথে অন্যান্য কাজকর্ম তো আছেই। চেকলিস্ট বানিয়ে অফিসের লাঞ্চ আওয়ারে বের হয়ে প্রতিদিন একটু একটু করে কাজ এগিয়ে নিয়েছি। মোবাইলের মধ্যে ১৫-২০ টা এপ শুধুমাত্র ইউরো ট্যুরের জন্য। এর মধ্যে ডেংগু জ্বর হয়ে ১৫-২০ দিন বিছানায় পড়ে থেকে ভালোই সুযোগ পেলাম বিভিন্ন ইউটিউব ভিডিও, ট্রিপ এডভাইজর, ট্রাভেল ব্লগ থেকে ইনফো নিয়ে জায়গাগুলো সম্পর্কে স্টাডি করার।
আমাদের প্রাথমিক তালিকার দেশগুলো ছিল, স্পেইন, ফ্র্যান্স, সুইজারল্যান্ড, গ্রিস, আর তুরস্ক। ইউরোপের পাশাপাশি বর্ডারের বেশকিছু দেশের ওয়েদার, কালচার, ভূমিরূপ প্রায় একইরকম হয়, তাই আমরা চেয়েছিলাম এমনকিছু জায়গা বাছাই করতে যেখানে একটার সাথে আরেকটার কোন মিল নেই। প্রতিটা জায়গায় যেন ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়, আর নতুন কিছু শিখতে পারি। আর প্র্যাক্টক্যালি কাজ শুরু করার পর আমার বাকেটলিস্টের গ্রিসের সান্তরিনি, ইতালির তুসকানি আর অস্ট্রিয়ার সালজবার্গের হলস্ট্যাট গ্রামটা থেকে শুধুমাত্র সান্তরিনিকেই রাখা সম্ভব হলো। আর এদিকে বার্সেলোনা যেতে চাইলে দেখলাম রুট প্ল্যানটা বেশ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, যেহেতু আমরা প্যারিস দিয়ে এন্ট্রি করবো। তাই ইতালি তালিকায় না থাকলেও রুট প্ল্যানের সুবিধার্থে বার্সেলোনার পরিবর্তে মিলানকেই বেছে নিলাম, যেখানে অন্তত ওর বার্সেলনার ক্যাম্প ন্যুও স্টেডিয়ামের বিকল্প হিসেবে এসি মিলানের সান সিরো স্টেডিয়ামের দেখা পাওয়া যাবে৷
তো ফাইন্যালি আমাদের ভ্রমণ তালিকা শেষ পর্যন্ত প্যারিস, সুইজারল্যান্ড, মিলান, সান্তরিনি, এথেন্স, ইস্তাম্বুল এ এসে শেষ হলো। আলহামদুলিল্লাহ আমরা ঠিক যেমনটা আশা করেছিলাম, প্রতিটা জায়গা ছিল একটা আরেকটা থেকে ভিন্ন। চোখ ধাধানো আলো ঝলমলে রাতের জমজমাট প্যারিস, ছবির মত সুন্দর ল্যান্ডস্কেপের সুইজারল্যান্ড সাথে অনেক অনেক এডভেঞ্চার, মিলানের পশ আর ফ্যশনেবল লাইফস্টাইল, সান্তরিনির নিল সমুদ্রের মাঝে আঁকাবাকা উঁচু নিচু পথের সাদা সাদা ঘরবাড়ির রূপকথার গল্পের মত শহর, ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু গ্রিসের ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর এথেন্স আর এর সাথে বসফরাসের তীরে এশিয়া ইউরোপকে সংযুক্ত করা তুরস্কের বানিজ্যিক-অর্থনৈতিক শহর ইস্তাম্বুল, কোনটিই আমাদের নিরাশ করেনি। গ্লেসিয়ার, মাউন্টেন পিক, সমুদ্রসৈকত, স্কাইলাইন, রিভার ক্রুজ কোনটিই বাদ যায়নি আমাদের এই অল্প কয়েকদিনের ট্রিপে। সাথে বাড়তি হিসেবে পেয়েছিলাম স্নো আর সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ি বৃষ্টি। আহা কী অপরূপ সৌন্দর্য্যের মাধুর্য।
১৬ দিনের ট্যুর হলেও আমার কাছে এটা ছিল পুরো আড়াই মাসের একটা অভিজ্ঞতা। কারণ কোনরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই এত বড় ট্যুরের একটা প্ল্যান করতে গিয়ে ২ মাসে আমি যতকিছু শিখেছি তা আমার জীবনের অন্যতম অর্জন। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া সবকিছুর জন্য।
লিখেছেন – নুরুন্নাহার সুমি