1. [email protected] : চলো যাই : cholojaai.net
দেখে মনে হবে রংধনু, আসলে পাহাড়
শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:২১ অপরাহ্ন

দেখে মনে হবে রংধনু, আসলে পাহাড়

  • আপডেট সময় শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্যের শেষ নেই। কখনো আকাশের রঙিন রংধনু আমাদের বিমোহিত করে, কখনো আবার সাগরের নীল ঢেউ মন কেড়ে নেয়। তবে পৃথিবীর কিছু স্থান এমনো আছে যেগুলো একেবারেই অনন্য। যার সৌন্দর্য মানুষের কল্পনার সীমানাকেও ছাড়িয়ে যায়। ঠিক তেমনই এক বিস্ময়কর জায়গা হলো পেরুর রেইনবো মাউন্টেন বা স্থানীয়দের ভাষায় ভিনিকুনকা। এই পাহাড়কে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে রঙিন পর্বতশ্রেণি, যেখানে পাথর আর মাটির স্তরে স্তরে জেগে ওঠে লাল, সবুজ, হলুদ, গোলাপি, নীল, এমনকি বেগুনির মতো বিচিত্র রং। যেন পাহাড়ের গায়ে আঁকা হয়েছে বিশাল রংধনু।

এই রঙিন পাহাড়কে ঘিরে রয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের এক অদম্য কৌতূহল। কীভাবে পাহাড়ের বুকে তৈরি হলো এমন রঙের খেলা? কেনই বা প্রকৃতির এই শিল্পকর্ম দীর্ঘদিন মানুষের চোখের আড়ালে ছিল? চলুন জেনে নেওয়া যাক রেইনবো মাউন্টেনের অদ্ভুত রহস্য, ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে এর সম্পর্ক।

দেখে মনে হবে রংধনু, আসলে পাহাড়

রেইনবো মাউন্টেন অবস্থিত দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে, আন্দিজ পর্বতমালার অংশে। রাজধানী লিমা থেকে সরাসরি যাওয়া যায় না; সাধারণত কুসকো শহরকে ঘিরে তৈরি হয় ভ্রমণের পরিকল্পনা। কুসকো থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫,২০০ মিটার উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে এই রঙিন পাহাড়। এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে যাওয়া এই পথ যাত্রা তাই বেশ কঠিন।

পাহাড়ের রঙিন সৌন্দর্যের পেছনে রয়েছে ভূতাত্ত্বিক রহস্য। লাখ লাখ বছর আগে সমুদ্রের নিচে জমা হওয়া খনিজ পদার্থ ও শিলার স্তর আন্দিজ পর্বতের ভূকম্পন ও টেকটোনিক ক্রিয়ার ফলে উপরে উঠে আসে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাত, বাতাস ও ক্ষয়ের কারণে খনিজ পদার্থগুলো ভিন্ন ভিন্ন রঙে প্রকাশ পেতে শুরু করে।

দেখে মনে হবে রংধনু, আসলে পাহাড়

লাল রং এসেছে আয়রন অক্সাইড থেকে। সবুজ রং গঠিত হয়েছে ক্লোরাইট খনিজের কারণে। হলুদাভ রং এসেছে সালফারের উপস্থিতি থেকে। গোলাপি রং এসেছে ম্যাগনেসিয়াম ও অন্যান্য মিশ্র খনিজ থেকে। নীল বা বেগুনি আভা তামা ও মালাকাইট জাতীয় খনিজের প্রভাবে ফুটে ওঠে।

প্রতিটি খনিজ আলাদা স্তরে জমে থাকায় পাহাড়ের বুক জুড়ে দেখা যায় একেকটি রঙিন ব্যান্ড, যা দেখতে অনেকটা রংধনুর মতো। আশ্চর্যের বিষয় হলো, দীর্ঘ সময় ধরেই রেইনবো মাউন্টেন প্রকৃতির গোপন সম্পদ হয়ে লুকিয়ে ছিল। পাহাড়টি ঘন বরফে ঢাকা থাকায় এর আসল রং দেখা যেত না। ২০১৩ সালের পর থেকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বরফ গলতে শুরু করলে ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এই রঙিন সৌন্দর্য। আর সেখান থেকেই শুরু হয় বিশ্বের নানা প্রান্তের পর্যটকদের ভিড়।

রেইনবো মাউন্টেন ভ্রমণ সহজ নয়। কুসকো থেকে ট্রেকিং শুরু করে কয়েক ঘণ্টা গাড়ি ও প্রায় ৩-৪ ঘণ্টার পদযাত্রার পর পৌঁছানো যায় শীর্ষে। উচ্চতা বেশি হওয়ায় অক্সিজেনের ঘাটতি ও ঠান্ডা আবহাওয়া অনেককে কষ্ট দেয়। অনেক পর্যটকই অল্টিচিউড সিকনেস বা উচ্চতাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন। তাই ভ্রমণের আগে শারীরিক প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।

তবে শীর্ষে পৌঁছে যে দৃশ্য চোখে ধরা দেয়, তার তুলনা নেই। দূরে বরফঢাকা আন্দিজের শৃঙ্গ, চারপাশে গবাদি পশু চরানো স্থানীয় মানুষ, আর মাঝখানে রঙিন রংধনুর মতো পাহাড় সব মিলিয়ে এটি নিঃসন্দেহে জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ভ্রমণ হয়ে ওঠে।

দেখে মনে হবে রংধনু, আসলে পাহাড়

পেরুর আদিবাসী কেচুয়া জনগোষ্ঠীর কাছে এই পাহাড় পবিত্র হিসেবে গণ্য। তাদের বিশ্বাস, ভিনিকুনকা হলো আকাশ ও মাটির মিলনস্থল, যেখানে দেবতারা প্রকৃতিকে রঙিন করে আশীর্বাদ দিয়েছেন। স্থানীয় উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠানেও এই পাহাড়ের প্রতীক ব্যবহার করা হয়।

২০১৫ সাল থেকে রেইনবো মাউন্টেন পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকেই এটি পেরুর অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। হাজারো পর্যটক প্রতিদিন এই পাহাড় দেখতে আসে, যা স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থান ও আয়ের নতুন উৎস তৈরি করেছে। ট্রেকিং গাইড, ঘোড়ার সেবা, খাবার-দাবার থেকে শুরু করে হস্তশিল্প বিক্রি-সব কিছুই স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।

তবে অতিরিক্ত পর্যটনের কারণে পরিবেশের উপর চাপও বাড়ছে। মাটির ক্ষয়, আবর্জনা এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলছে ভ্রমণকারীদের ভিড়। এ কারণেই সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন টেকসই পর্যটনের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে।

রেইনবো মাউন্টেন শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ভূতত্ত্ববিদরা মনে করেন, এই পাহাড়ের রঙিন স্তরগুলো পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী। প্রতিটি স্তর আসলে কোটি বছরের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলাফল, যা পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দেয়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Developed By ThemesBazar.Com