1. [email protected] : চলো যাই : cholojaai.net
দেড়শ বছরের পুরোনো পরিত্যক্ত দুর্গ যেভাবে বিলাসবহুল 'পার্টি আইল্যান্ডে' পরিণত হলো
মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫, ০৫:২৯ অপরাহ্ন

দেড়শ বছরের পুরোনো পরিত্যক্ত দুর্গ যেভাবে বিলাসবহুল ‘পার্টি আইল্যান্ডে’ পরিণত হলো

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫

পুরাতন স্থাপনা মেরামত করে নিজের মন মতো করে গড়ে তুলবেন, এমন স্বপ্ন অনেকেই দেখে থাকেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যের দেড়শ বছরেরও বেশি পুরনো পরিত্যক্ত দুর্গটিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে যে এতটা বেগ পোহাতে হবে, সেটা ধারণাও করতে পারেননি সফটওয়্যার কোম্পানির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাইক কনার।

“আমার এই উদ্যোগকে অনেকেই ‘মধ্যবয়সের সংকট’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন,” রসিকতা করে বলছিলেন মি. কনার।

তিনি বলেন, “সত্যি বলতে, আমি আসলে জানতাম না যে ঠিক কীসের সঙ্গে আমি নিজেকে জড়াচ্ছি।”

৫২ বছর বয়সী মি. কনার ২০১৭ সালের মে মাসে ওয়েলসের দক্ষিণ-পশ্চিমে পেমব্রোকশায়ারের মিলফোর্ড হ্যাভেন বন্দের কাছে অবস্থিত ছোট্ট একটি দ্বীপ কিনেছিলেন প্রায় পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার পাউন্ডে।

স্থানীয়ভাবে দ্বীপটি ‘থর্ন আইল্যান্ড’ নামে পরিচিত। মূলত ফরাসি নৌবাহিনীর হামলার হাত থেকে ব্যস্ত মিলফোর্ড হ্যাভেন বন্দরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ১৮৫০-এর দশকে ওই দ্বীপটিতে একটি দুর্গ গড়ে তোলা হয়।

সেখানে শ’খানেক সৈন্য মজুদ রাখার ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তীতে বহু বছর ধরে দুর্গটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। মাঝে কিছুদিন হোটেল এবং বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের ভেন্যু হিসেবে এটি ভাড়া দেওয়া হয়।

কিন্তু দেড় দশক আগে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর প্রায় ১৭ বছর ধরে অব্যবহৃতই অবস্থায় পড়ে থাকার পর মি. কনার দুর্গটিকে আবারও বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। সংস্কারের পুরো কাজ শেষ করতে তার প্রায় বছরখানেক সময় লেগে যায়।

চমৎকারভাবে সাজানো দুর্গটিতে বর্তমানে ৪০টির মতো বিছানা, চারটি সংযুক্ত গোসলখানা ছাড়াও নিজস্ব একটি নাইট ক্লাবও রয়েছে। এছাড়া অতীতে সেখানে পানি-বিদ্যুতের সংকট দেখা গেলেও এখন সেসব সমস্যারও সমাধান করা হয়েছে।

সবমিলিয়ে একসময়ের পরিত্যাক্ত দুর্গটি এখন বিলাসবহুল একটি ‘পার্টি আইল্যান্ডে’ পরিণত হয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় তিন মিলিয়ন পাউন্ড।

২০১৭ সালে সফটওয়্যার কোম্পানির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাইক কনার দ্বীপটি কিনে নেন

ছবির উৎস,Mike Conner

ছবির ক্যাপশান,২০১৭ সালে সফটওয়্যার কোম্পানির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাইক কনার দ্বীপটি কিনে নেন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে প্রথমবার দুর্গটি মেরামত করে একটি হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়।

পরে ১৯৯৯ সালে মালিকানার হাত বদল হওয়ার আগে সেখানে জন্মদিন, বিয়ে ছাড়াও নানান ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ভাড়া দেওয়া হতো।

২০০১ সালের দিকে যুক্তরাজ্যের ভন এসেন হোটেল গ্রুপ প্রাচীন দুর্গটি কিনে নেয়। সেখানে পুনরায় হোটেল ব্যবসা চালু করার জন্য তারা চার মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করার পরিকল্পনাও করেছিল।

মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপটিতে আগত পর্যটকদের হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘ক্যাবল কার’ বসানোর পরিকল্পনাও করছিলেন তারা। যদিও পরবর্তীতে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি।

মি. কনার যখন দুর্গটি ক্রয় করেন, তখন সেটি রীতিমত পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। তখনও অবশ্য কেউ জানতো না একসময়ের ব্যস্ত দ্বীপটি আরও প্রাণ ফিরে পাবে এবং আগের চেয়ে আরও বিলাসবহুল হয়ে উঠবে।

১৮৫০-এর দশকে ওই দ্বীপটিতে একটি দুর্গ গড়ে তোলা হয়

ছবির উৎস,Strutt & Parker

ছবির ক্যাপশান,১৮৫০-এর দশকে ওই দ্বীপটিতে একটি দুর্গ গড়ে তোলা হয়

“সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না, পানি ছিল না, এমনকি খাবার বা বর্জ্য অপসারণেরও ব্যবস্থা ছিল না,” বলছিলেন সফটওয়্যার কোম্পানির সাবেক সিইও মাইক কনার।

“আমার স্ত্রীকে আমি যখন প্রথম খবরটা জানালাম যে, দুর্গটি আমি কিনেছি, তখন সে বেশ বিরক্ত হয়েছিল। সে বলেছিল, সে ওখানে তখনই থাকার জন্য যাবে যখন অন্তত ফ্লাশ করা যায় এমন শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকবে।”

স্ত্রীর এই কথার পর মি. কনার দুর্গটিতে ফ্লাশওয়ালা শৌচাগার নির্মাণের পরিকল্পনা করেন।

কিন্তু কাজে হাত দিতে গিয়ে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কারণ তিনি কল্পনাও করতে পারেনিনি যে, ফ্লাশওয়ালা শৌচাগার নির্মাণের জন্য তাকে প্রায় ১৬ ফুট পাথর কাটতে হবে, যাতে খরচ হবে প্রায় দুই লাখ পাউন্ড।

“ওয়েলসের কিছু অসাধারণ ঐতিহাসিক ভবন আছে সত্যি, কিন্তু সেগুলোর অবস্থা আসলেই করুণ,” বলেন মি. কনার।

দুর্গপ্রাঙ্গণের ছবি

ছবির উৎস,Mike Conner

ছবির ক্যাপশান,দুর্গপ্রাঙ্গণের ছবি

পানি, বিদ্যুৎ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহ থর্ন দ্বীপের যাবতীয় সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করতেই প্রায় পাঁচ বছর সময় চলে যায়। কাজ চলাকালে দ্বীপটিতে মাত্র ছয় জন ব্যক্তি বসবাস করেছিলেন, যারা সবাই পুরুষ।

তবে সংস্কার কাজ চালানোটা মোটেও সহজ ছিল না। কারণ বেশিরভাগ মালামাল ও সরঞ্জাম সেখানে নিতে হয়েছিল হেলিকপ্টারে করে।

“এটা ছিল অবিশ্বাস্যরকম কঠিন একটা কাজ,” বলছিলেন মি. কনার।

সংস্কার কাজের জন্য উপকরণ নিয়ে যাওয়াটা যেমন দুরূহ ব্যাপার ছিল, তেমনই চ্যালেঞ্জিং ছিল কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য দ্বীপে দিনের পর দিন একটানা অবস্থান করা।

“এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না, শেষ পর্যন্ত কতজন মানুষ আপনার সঙ্গে ওই কাজে থাকতে রাজি হবে,” বলেন মি. কনার।

সংস্কারের পর দুর্গের ভেতরের একটি অংশের ছবি

ছবির উৎস,Strutt & Parker

ছবির ক্যাপশান,সংস্কারের পর দুর্গের ভেতরের একটি অংশের ছবি

কারণ দ্বীপটিতে বিদ্যুৎ ছিল না, ছিল না পরিষ্কার পানিতে গোসল করার ব্যবস্থাও। এর মধ্যেই প্রতিবার টানা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সংস্কার কাজ চালিয়ে যেতে হতো।

“তারা জেনারেটর দিয়ে তাদের ফোনে চার্জ দিতো এবং গোসলের জন্য সমুদ্রের লোনা পানিতে ডুব দিতে হতো। জীবনযাপন করা ছিল ভীষণ কঠিন,” বলেন মাইক কনার।

এতসব সমস্যার কথা জেনেও তখন যারা প্রকল্পটিতে কাজ করতে রাজি হয়েছিলেন, তাদের বেশিরভাগ লোক এখনও মি. কনারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

মি. কনার নকশা ও প্রযুক্তি’র শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। প্রাচীন দুর্গটির নকশা দেখে তিনি রীতিমত অভিভূত হয়েছিলেন।

“শুরুতে আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, ভিক্টোরীয়রা (রানি ভিক্টোরিয়ার শাসনামলের নকশাকারেরা) এত দুর্দান্ত কিছু সৃষ্টি করতে পারে”

“প্রায় এক হাজার মানুষ দুই বছর ধরে এটি নির্মাণে কাজ করছিল। এটি স্টোনহেঞ্জের (ব্রোঞ্জ যুগের একটি স্তম্ভ) মতো করেই তৈরি করা হয়েছিল,” বলেন মি. কনার।

মূলত চমৎকার নকশা দেখেই তিনি দুর্গটি কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

মি. কনারের জন্মদিনের উৎসবের ছবি

ছবির উৎস,Mike Conner

ছবির ক্যাপশান,মি. কনারের জন্মদিনের উৎসবের ছবি

“সেটা দেখার পর মনে হয়েছিল, আমার কাজ হচ্ছে একে আধুনিকীকরণ করা। এটা তাদের (মূল নকশাকারদের) কঠোর পরিশ্রমের প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা নিবেদন বলা চলে,” বলছিলেন মি. কনার।

তার মতে, দ্বীপটি “জনবহুল উৎসব থেকে শুরু করে জনশূন্য নির্জনতা”- সবকিছুর সাক্ষী।

সংস্কার কাজ শেষে দ্বীপটিতে মি. কনার নিজের পঞ্চাশতম জন্মদিনে উৎসবের আয়োজন করেন। সেদিন মনোরম সুন্দর দুর্গ প্রাঙ্গণজুড়ে সবাই হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠেছিলেন।

“এটা এমন একটা জায়গা যেখানে কোনো প্রতিবেশী নেই। ফলে কেউ বিরক্তও হয় না,” বলেন মি. কনার।

তবে যারা দ্বীপটিতে এখন বেড়াতে আসেন, ফেরার সময় তাদের নিজেদেরকেই ময়লা-আবর্জনা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়। কারণ কেউ সেখানে আবর্জনার ঝুড়ি সংগ্রহ করতে আসে না।

ফরাসি নৌবাহিনীর হামলার হাত থেকে মিলফোর্ড হ্যাভেন বন্দরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিল

ছবির উৎস,Mike Conner

ছবির ক্যাপশান,ফরাসি নৌবাহিনীর হামলার হাত থেকে মিলফোর্ড হ্যাভেন বন্দরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিল

“সপ্তাহ শেষে ছুটি কাটাতে যেসব পর্যটকরা এখানে আসেন, তাদেরকে সঙ্গে করে আবর্জনা ফিরিয়ে নিতে বললে রীতিমত অবাক হন,” বলছিলেন মাইক কনার।

দৈনন্দিন জীবনের ছকে বাঁধা জীবনের তুলনায় দ্বীপ জীবন “অবিশ্বাস্যরকম” সুন্দর বলে বর্ণনা করেছেন প্রযুক্তি কোম্পানির সাবেক এই সিইও।

“আমরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা জীবন যাপন করে থাকি, যেখানে ব্যস্ততা থাকে, মিটিং থাকে। কিন্তু দ্বীপের জীবন সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে আপনি প্রতিটি মুহূর্ত অনুভব করতে পারেন, যা আপনাকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দেয়,” বলেন মি. কনার।

তিনি এটাও বলছিলেন যে, দ্বীপের মনোরম পরিবেশ এবং বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড পর্যটকদের ফোন থেকে দূরে থাকতে উৎসাহ যোগায়।

“আমি মনে করি এটাই থর্নকে একটি বিশেষ জায়গা হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে,” বলেন মি. কনার।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Developed By ThemesBazar.Com