ট্রাভেল এজেন্সির শত কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে অনলাইনে প্লেন টিকিট সেবাদানকারী প্লাটফর্ম ফ্লাইট এক্সপার্ট। ফ্লাইট এক্সপার্টের এমন নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডে একদিকে শত শত ট্রাভেল এজেন্সি মালিকদের করেছে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, কেউ কেউ হয়েছেন নিস্ব। অন্যদিকে দুর্ভোগ, উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে পর্যটকসহ হাজারো প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধার। অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে ফ্লাইট এক্সপার্টের স্মার্ট মার্কেটিংয়ের কারণে বেশ জনপ্রিয় প্লাটফর্ম হওয়া সত্ত্বেও এতবড় স্ক্যাম তারা কেন করলো, এর উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন ট্রাভেল ব্যবসার সাথে যুক্ত অগণিত ব্যবসায়ীসহ সেবা গ্রহণকারীরা।
নিকট অতীতে হলমার্ক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এমিবিডিসহ কয়েকটি ওটিএ প্লাটফর্ম ছোট পরিসরে স্ক্যাম করেছিল। তাদের স্ক্যামের পরিমাণ ছোট হলেও ফ্লাইট এক্সপার্টের স্ক্যামের পরিমাণ অনেক বেশি। যার খেসারত দিতে হবে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত ট্রাভেল এজেন্সিদেরও। দীর্ঘ বছর সর্বোচ্চ আন্তরিক সেবা দিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের চূড়ান্ত আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল, ফ্লাইট এক্সপার্টের এমন অপ্রত্যাশিত প্রতারণার কারণে চরম হুমকি, এমনকি অস্তিত্ব সংকটের মতো পরিস্থিতিতেও পড়তে যাচ্ছে বেশকিছু ট্রাভেল এজেন্সি। গ্রাহক টাকার বিনিময়ে টিকিট সংগ্রহ করে। যৌক্তিকভাবেই তারা কোনো ধরনের ক্ষতির দায় নিতে আগ্রহী থাকবেন না। দীর্ঘ বছরের তিল তিল করে গড়ে তোলা সুনাম তাই কীভাবে ধরে রাখবে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো, এর কোনো সদুত্তর নেই কারো কাছেই।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, মালিকদের কেউ কেউ সর্বস্ব হারানোর আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, কেউবা দুশ্চিন্তা করছেন গ্রাহকদের কী জবাব দিবেন এমন বিষয়ে। অনেকেই হতবিহ্বল হয়ে ক্যামেরায় কথা বলতে গিয়ে আটকে যাচ্ছেন। কান্না করতেও দেখা যাচ্ছে অনেককে। গ্রাহক সন্তুষ্টির বিষয়টিকে যারা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন এমন প্রতিষ্ঠানগুলো পড়তে যাচ্ছে স্মরণকালের সর্বোচ্চ বিড়ম্বনা এবং ক্ষতির মুখে।
হাজার হাজার যাত্রীর বিমানযাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এজেন্সি মালিকদের দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ এতবড় সমস্যার সমাধানে কে পাশে থাকবে, কে কার্যকর ভূমিকা রাখবে, এমন দায়িত্বশীল কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। না সরকারের পক্ষ থেকে, না পেশাগত সংগঠনের পক্ষ থেকে। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন পেশাগত সংগঠনের যতটা ভূমিকা রাখার কথা; ততটা তারা রাখছেন না কিংবা রাখতে পারছেন না। সংগঠনগুলোরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে পরিস্থিতি। স্ক্যামের ঘটনাটি খুব শিগগিরই বিস্মৃত হয়ে যাবে সব মাধ্যম থেকে এবং দিনশেষে যার যার ক্ষতির দায় তাকে তাকেই নিতে হবে বলেও অনিশ্চয়তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
মূল্যহ্রাসে প্লেন টিকিট বিক্রির অফারসহ বিভিন্নভাবে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল ফ্লাইট এক্সপার্ট। পুরোনো ট্রাভেল এজেন্সি মালিকদের শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল এমন মূল্যহ্রাস দিয়ে টিকিট বিক্রি যৌক্তিক পন্থা হতে পারে না। আইএটিএ সদস্যভুক্ত ট্রাভেল এজেন্সি মালিকদের আক্ষেপের সুরে বলতে শোনা গেছে, ‘অনেক পুরোনো প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এই সময়ের গ্রাহকদের বেশিরভাগই অনলাইনে টিকিট চেক করে দাম কম পেয়ে আমাদের অভিযুক্ত করে। আমরা টিকিটের বেশি দাম রাখি আর ওটিএ থেকে কম দামে টিকিট পাওয়া যায়, এমনকি বিশেষ ডিসকাউন্টেরও ছড়াছড়ি। আমরা অযৌক্তিক ডিসকাউন্ট দিতে পারি না বলে অগণিত গ্রাহক আমাদের বরাবরই অভিযোগের কাঠগড়ায় রাখতো। বাধ্য হয়ে আমরাও ওটিএ প্লাটফর্মের সেবা নিতে বাধ্য হই।’ দিন শেষে আইএটিএ সেবা থাকা সত্ত্বেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হলো এই সেক্টরের অনেককেই।
বাংলাদেশে স্ক্যামের বিভিন্ন ঘটনা নতুন কিছু নয়। একেকটা স্ক্যামের উৎপত্তি ঘটে, কিছুদিন এই নিয়ে আলোচনা শেষে হারিয়ে যেতেও খুব বেশি সময় লাগে না। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া যেন আমাদের জাতিগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যতবড় ঘটনাই ঘটুক না কেন, সেই ঘটনাগুলো আমরা খুব বেশিদিন মনে রাখি না। যে কারণে বারবার স্ক্যামের ঘটনা ঘটে, বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়ে পুনরাবৃত্তিও হয় বারবার। একেকবার একেক শ্রেণিপেশার মানুষদের চরম ক্ষতির শিকার হতে হয় এসব স্ক্যাম থেকে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্ক্যামের জন্য বড় ধরনের কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত না থাকায় স্ক্যামাররা ভেবেই নেন, এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে বারবার ঘটানো যায় এবং এসব করে বহাল তবিয়তে থাকাও যায়।
যে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক সময় এবং প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে ট্রাভেল শিল্প বেশ জমজমাট এই সময়ে। ট্রাভেল শিল্পকে শিল্পের অবস্থানে নিয়ে আসতে এই খাত সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠানকে ব্যাপক শ্রম দিতে হয়েছে বিভিন্নভাবে। ফ্লাইট এক্সপার্টের স্ক্যামের কারণে একদিকে যেমন চরম আস্থার সংকটে পড়েছে প্লেন টিকিট ব্যবসা, অন্যদিকে ট্রাভেল শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন অনেকটা সময় ধরে, তারাও পড়তে যাচ্ছেন অভাবনীয় ক্ষতির মুখে। এতবড় নিন্দনীয় প্রতারণার ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছে, রাষ্ট্র যদি তাদের বিচারের আওতায় না নিয়ে আসতে পারে, কঠিনতম শাস্তির ব্যবস্থা করে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ তৈরি না করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এমন স্ক্যামের ঘটনার পুনরাবৃত্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। আবারো স্ক্যামের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে নিস্ব হবেন ভিন্ন পেশাজীবীর অগণিত মানুষ, এমন ঘটনা প্রত্যাশিত নয়।
আজ প্লেন টিকিট ব্যবসা আস্থার সংকটে পড়েছে, কাল আস্থার সংকটে পড়বে অন্য পেশাজীবীরাও। বারবার স্ক্যামের ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্র অবশ্যই সব স্ক্যামের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান বজায় রেখে অপরাধীদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। এমন প্রত্যাশা রাষ্ট্রের সব নাগরিকের।