বরফের হাতছানি লেগেছে পানির দেশে। এখন দেশের তরুণেরা বরফের পাহাড় বেয়ে উঠে যাচ্ছেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায়। একজন ছাড়া সবাই নিরাপদে ফিরেও এসেছেন। সবাই হয়তো এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করতে পারছেন না। কিন্তু বরফময় বেসক্যাম্পে কিংবা হিমালয়ের বিভিন্ন ট্রেকে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কোনো একদিন বরফের তাল সরিয়ে উঠে যাবেন চূড়ায়।
১৯ মে ইকরামুল হাসান শাকিল সপ্তম পর্বতারোহী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণ করেছেন। শাকিলের আগে আরও ছয়জন বাংলাদেশি পা রেখেছেন সেই চূড়ায়। তাঁরা হলেন মুসা ইব্রাহীম, এম এ মুহিত, নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া নাজরীন, খালেদ হোসেন ও বাবর আলী।
এই তালিকা নিয়ে একটি ফুটনোট দিয়ে রাখা জরুরি। দেশের এভারেস্ট আরোহী প্রথম মানুষ হিসেবে মুসা ইব্রাহীমকে নিয়ে বারবার বিতর্ক হয়। দেশের সব পর্বতারোহী তাঁদের কাজ করে চলেছেন নিয়মিতভাবে। এ ক্ষেত্রে মুসা ইব্রাহীমই একমাত্র ব্যতিক্রম, এভারেস্টে ‘সফল’ অভিযানের পর যাঁর আর কোনো অভিযানের সংবাদ কোথাও পাওয়া যায় না। পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই নয়। ফলে বিতর্কটি চাগিয়ে ওঠে মাঝেমধ্যেই। সে যাক।
দুবার এভারেস্টজয়ী অভিযাত্রী
২০১০ সালে প্রথমবার এভারেস্ট অভিযান চালিয়ে আবহাওয়ার কারণে আরোহণে ব্যর্থ হয়েছিলেন এম এ মুহিত। এর এক বছর পর ২০১১ সালের ২১ মে তিনি এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন। পরের বছর তিনি আবারও এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন। বাংলাদেশের পর্বতারোহীদের মধ্যে এই রেকর্ড এখন পর্যন্ত দখলে রেখেছেন মুহিত। ভারতের দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে মৌলিক এবং উচ্চতর পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ নেওয়া পর্বতারোহী তিনি।
একই অভিযানে দুই শৃঙ্গ সামিট
২০২৪ সালের ১৯ মে বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে বাবর আলী মাউন্ট এভারেস্ট শৃঙ্গ স্পর্শ করেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে চিকিৎসা পেশায় যুক্ত হলেও বাবর আলী তাতে থিতু হননি। এর আগে তিনি ৯টি পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করেন। ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর নেপালের স্থানীয় সময় ৯টা ৩ মিনিটে সামিট করেন আমা দাবলাম চূড়া। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি এই সামিট করেন। ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সাইকেলে যাত্রা করেন।
এ ছাড়া গত ৭ এপ্রিল তিনি হিমালয়ের অন্নপূর্ণা-১ (৮ হাজার ৯১ মিটার) পর্বতচূড়া সামিট করেন।
দেশের প্রথম এভারেস্টে আরোহণকারী নারী
২০১২ সালের ১৯ মে, বেলা সাড়ে ১১টায় প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছান নিশাত মজুমদার। ২০০৩ সালে এভারেস্ট অভিযানের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেওক্রাডং চূড়ায় উঠে তিনি পর্বতারোহণ শুরু করেন। ২০০৭ সালের মে মাসে বিএমটিসির সহায়তায় দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে মৌলিক প্রশিক্ষণ নেন। এরপর এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে সেপ্টেম্বরে তিনি হিমালয়ের মেরা পর্বত (২১ হাজার ৮৩০ ফুট) এবং ২০০৮ সালে সিঙ্গুচুলি শৃঙ্গে (২১ হাজার ৩২৮ ফুট) আরোহণ করেন।
পর্বতে মৃত্যু
২০১৩ সালের ২০ মে খালেদ হোসেন এভারেস্ট সামিট করেন। সাউথ সামিট পর্যন্ত নেমে এসে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে মারা যান তিনি। খালেদ এভারেস্ট অভিযানের আগে ২০০৬ সালে সিকিমের ফ্রে পর্বত, ২০০৯ সালে নেপালের মাকালু, ২০১০ সালে বাংলাদেশ-নেপাল ফ্রেন্ডশিপ পিক এবং ২০১১ সালে সিঙ্গুচুলি জয় করেন। এ ছাড়া অ্যাডমন্ড ভিস্টার্সেলের ‘পর্বতের নেশায় অদম্য প্রাণ’ বইটি তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে ‘কাজলের দিনরাত্রি’ নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন খালেদ হোসেন।
সাত মহাদেশের সাত শৃঙ্গ জয়ী
২০১২ সালের ২৬ মে দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী হিসেবে মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণ করেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। তিনি এখানেই থেমে থাকেননি। বাংলাদেশের একমাত্র পর্বতারোহী হিসেবে সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করেছেন তিনি। ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর কারস্তেঞ্জ পিরামিডে (পাপুয়া, ইন্দোনেশিয়া) সফল অভিযানের মাধ্যমে সাত মহাদেশের সাত শৃঙ্গ জয়ের রেকর্ড সম্পন্ন করেন ওয়াসফিয়া। ২০২২ সালের ২২ জুলাই তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত কে-২ সামিট করেন। তাঁর দুঃসাহসিক অভিযাত্রার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক তাঁকে বর্ষসেরা অভিযাত্রী ঘোষণা করে।
এভারেস্ট সামিটে বিশ্ব রেকর্ড
এভারেস্ট অভিযানে শাকিল যা করে দেখিয়েছেন, তা পুরো বিশ্বে এক অনন্য রেকর্ড। ‘সি টু সামিট’ অভিযানে তিনি কম সময়ের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হেঁটে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এভারেস্ট সামিট করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। ১৯ মে তিনি সফলভাবে শৃঙ্গ জয় করে ক্যাম্প-৪-এ ফিরে আসেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের ইনানী সৈকত থেকে শুরু হয়েছিল শাকিলের সি টু সামিট অভিযান। এরপর বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দুর্গম পথ অতিক্রম করে এভারেস্ট সামিট করেন শাকিল। এর আগে তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে গ্রেট হিমালয়ান ট্রেইলে ট্রেকিং শেষ করেন।