মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ১০:৩৪ অপরাহ্ন

অর্থের বিনিময়ে ইইউ নাগরিকত্বের সুযোগ বাতিল, বন্ধ ‘গোল্ডেন পাসপোর্ট’ নীতি

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৬ মে, ২০২৫

গোল্ডেন পাসপোর্ট বা অর্থের বিনিময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দেশে নাগরিক হওয়ার শেষ সুযোগটি সম্প্রতি বন্ধ করে দিয়েছেন ইউরোপের সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু এভাবে অর্থ উপার্জনের বিকল্প কিছু সুযোগ দেশগুলোর সামনে এখনো রয়ে গেছে। ২৯ এপ্রিল ইউরোপীয় বিচার আদালতের (ইসিজে) দেওয়া রায় শুরুতে বিশ্বাসই হয়নি মানুয়েল ডেলিয়ার। এমন রায় পাওয়ার জন্য আরো বছরের পর বছর লড়তে রাজি ছিলেন তিনি।

ডেলিয়া বলেন, ‘আমি চিৎকার করে উঠলাম। খারাপ খবরের অপেক্ষাতেই ছিলাম।’

মাল্টার নাগরিক সংগঠন রিপাবলিকার নির্বাহী কর্মকর্তা ডেলিয়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সে দেশের নাগরিকত্ব কর্মসূচির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। ‘গোল্ডেন পাসপোর্ট’ নামে পরিচিত অর্থের বিনিময়ে নাগরিকত্বের সুযোগ দেওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সর্বশেষ দেশ ছিল মাল্টা। তার আগে বুলগেরিয়া ও সাইপ্রাস তাদের এমন স্কিম বা কর্মসূচি বন্ধ ঘোষণা করেছিল।

ডেলিয়া বলেন, তার বন্ধু ও সহকর্মী মাল্টার দুর্নীতিবিরোধী সাংবাদিক দাফনে কারুয়ানা গালিজিয়ার হত্যার ঘটনা এই ধরনের কর্মসূচির বিপদের বিষয়টি প্রথম তুলে ধরে।

গোল্ডেন পাসপোর্ট : অর্থই যেখানে মূল বিবেচ্য

২০২২ সালে ইউরোপীয় কমিশন মাল্টার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। বলা হয় মাল্টা দেশটির আবাসন খাতে বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব দিচ্ছে, যা ইইউর নাগরিকত্ব নিয়মের বরখেলাপ। কেননা নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য শুধু আর্থিক প্রতিশ্রুতি নয়, ব্যক্তির সঙ্গে ওই দেশের ‘প্রকৃত সংযোগও’ থাকতে হবে।

ডেলিয়া আদালতের ভিন্ন রায়ের আশঙ্কা করছিলেন। কারণ গত অক্টোবরে প্রকাশিত একটি মতামতে ইসিজের অ্যাডভোকেট জেনারেল মাল্টার সরকারের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ইসিজে আগে বিভিন্ন সময়ে অ্যাডভোকেট জেনারেলের মতামত অনুসরণ করলেও এবার তেমনটি হয়নি। আদালত মাল্টার নাগরিকত্ব নীতিকে শুধু বাণিজ্যিক লেনদেন আকারেই দেখেছে।

রায়ে বলা হয়েছে, ‘এই ধরনের চর্চার কারণে সদস্য দেশগুলো ও তার নাগরকিদের মধ্যে প্রয়োজনীয় বন্ধন ও আস্থা তৈরি কিংবা সদস্য দেশগুলোর পারস্পরিক বিশ্বাস স্থাপন সম্ভব হয় না।’

মাল্টার পাসপোর্টের ক্রেতা কারা?

ডেলিয়া বলেন, ‘আদালতের রায়ে প্রমাণ হয়েছে, যা এত দিন ধরে আমরা বলার চেষ্টা করেছি। এই কর্মসূচিটি অর্থ উপার্জনের মাধ্যম, যা ন্যায়সংগত নয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘আপনি নাগরিকত্বের দাম ধরতে পারেন না। এটি অর্থের চেয়েও মূল্যবান।’

গোল্ডেন পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ শর্তগুলো কতটা যাচাই করে তা নিয়ে শুরু থেকে প্রশ্ন তুলেছেন ডেলিয়া ও অন্য পর্যবেক্ষকরা। কেননা, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় মাল্টায় অবস্থান না করেই অনেকে নাগরিত্ব পেয়েছেন।

দাফনে কারুয়ানা গালিজিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্যে দেখা যায়, প্রতি ১০টি গোল্ডেন ভিসার মধ্যে ৯টি ভিসাই পেয়েছেন চীনা বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু জনমিতি জরিপ অনুযায়ী, এই সংখ্যা দেশটিতে বসবাসকারী চীনা নাগরিকের চেয়ে বেশি। সংগঠনটি মনে করছে গোল্ডেন ভিসা পাওয়া অর্ধেকসংখ্যকই বস্তুত মাল্টায় বসবাস করেন না।

এক দুয়ার বন্ধ হলেও খোলা অন্যগুলো

এদিকে আদালতের রায়ের পর মাল্টার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট আবেলা কর্মসূচিটির পক্ষে অবস্থান জানিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছেন। জানিয়েছেন, মাল্টা গোল্ডেন পাসপোর্টের মাধ্যমে ১৬০ কোটি ডলার আয় করেছে। রায়ের সঙ্গে সংগতি রেখে এই ব্যবস্থা চালু রাখার ইঙ্গিতও দেন তিনি।

রবার্ট আবেলা বলেন, ‘মাল্টা সরকার সব সময়ের মতোই আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। এই মুহূর্তে রায়ে আইনি প্রভাব বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে, যাতে নাগরিকত্ব নিয়ন্ত্রণের কাঠামোটি রায়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়।’

অর্থের বিনিময়ে পাসপোর্টের সুযোগ বন্ধ হলেও পাসপোর্টমুক্ত শেঙেন অঞ্চলে প্রবেশের আরো পথ খোলা রয়ে গেছে। পাসপোর্ট কর্মসূচিতে থাকা অনেক সুবিধাই মেলে ‘গোল্ডেন ভিসাতে’। আবাসনে বা অন্য খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশগুলোতে বসবাসের জন্য এই ধরনের ভিসা সুবিধা রয়েছে।

মাল্টার পাসপোর্ট কর্মসূচিতে সহায়তা করে হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স। ৩১টি দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার সেবা দেয় তারা। এর অর্ধেকই ইউরোপীয় ইউনিয়নের।

বৈশ্বিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালে নীতিবিষয়ক কর্মকর্তা আনা টেরন বলেন, ‘এর মাধ্যমে আপনি এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সুযোগ পাবেন।’

রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র মার্কুস লেমার্ট গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচিগুলো নিয়ে ‘গুরুতর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই ধরনের কর্মসূচিগুলো ইউনিয়নের জন্য নিরাপত্তা, অর্থপাচার, কর ফাঁকি ও দুর্নীতির সামগ্রিক ঝুঁকি তৈরি করছে। সদস্য দেশগুলোর এমন কর্মসূচির ক্ষেত্রে যাতে ঝুঁকি মোকাবেলা ও ব্যবস্থা নেওয়ার যথাযথ পদক্ষেপ থাকে, তা ইইউ অর্থপাচার আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।’

২০২২ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি রেজ্যুলেশনে বিনিয়োগের বিনিময়ে বসবাসের সুবিধা স্কিমের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

পরিবর্তনের সূচনা
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের টেরন আশা করছেন, গোল্ডেন পাসপোর্ট বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্তকে সামনে এগিয়ে নেওয়া হবে। আদালত যেই যুক্তিতে এটি বন্ধ করেছে, তা গোল্ডেন ভিসাতেও প্রযোজ্য হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

ইইউ দেশগুলোর মধ্যকার সংহতি ও নিরাপত্তার জন্য ‘দুর্নীতিবাজ ও অস্বচ্ছ উপায়ে সম্পদশালী হওয়াদের’ দূরে রাখা প্রয়োজন বলেও মত দেন তিনি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com