উজবেকিস্তান মধ্য এশিয়ার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ, যার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ভৌগোলিক অবস্থান একে বিশ্ব মানচিত্রে একটি বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। প্রাচীন সভ্যতা, বিখ্যাত বাণিজ্য পথ ‘সিল্ক রোড’, ইসলামি স্থাপত্য ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার এক চমৎকার সংমিশ্রণ দেখা যায় এই দেশে।
উজবেকিস্তান একটি স্থলবেষ্টিত দেশ, যার পশ্চিমে ও উত্তরে কাজাখস্তান, পূর্বে কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান, দক্ষিণে আফগানিস্তান এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে তুর্কমেনিস্তান অবস্থিত। আয়তন প্রায় ৪৪৮,৯৭৮ বর্গকিলোমিটার।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি বিশ্বের দুইটি মাত্র দেশগুলোর একটি, যা সম্পূর্ণরূপে স্থলবেষ্টিত অন্য দেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত (অন্যটি হলো লিচেনস্টেইন)।
উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ (Tashkent), যা দেশের বৃহত্তম শহর এবং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো হলো:
সমরকন্দ (Samarkand) – প্রাচীন সিল্ক রোডের শহর, ইসলামি স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের ধনভাণ্ডার।
বুখারা (Bukhara) – ঐতিহাসিক শহর, অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা ও মিনার রয়েছে।
খিভা (Khiva) – ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত প্রাচীন শহর।
আন্দিজান, নামাঙ্গান, ফেরগানা – শিল্প ও কৃষিতে সমৃদ্ধ ফেরগানা উপত্যকার শহর।
উজবেকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ৩৬ মিলিয়ন (২০২৪ আনুমানিক)। প্রধান জাতিগোষ্ঠী উজবেক, তবে রুশ, তাজিক, কাজাখ ও কিরগিজ সম্প্রদায়ের লোকও বাস করে।
রাষ্ট্রভাষা হলো উজবেক (Uzbek), তবে রুশ ভাষাও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, বিশেষত শহরাঞ্চলে।
উজবেকিস্তানের প্রধান ধর্ম ইসলাম (সুন্নি), তবে এখানে খ্রিস্টান, ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও রয়েছে।
দেশটির সংস্কৃতিতে ইসলামি ঐতিহ্য, পারস্য ও তুর্কি প্রভাব, রুশ শাসনের স্মৃতি এবং আধুনিক বৈশ্বিক প্রভাব একত্রে মিশে আছে।
উজবেক নৃত্য, সঙ্গীত, নকশিকাঁথা, রেশমি পোশাক ও কারুশিল্প পৃথিবীজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে।
উজবেকিস্তান একটি রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্র। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এটি স্বাধীনতা অর্জন করে। প্রথম রাষ্ট্রপতি ইসলাম কারিমভ (Islam Karimov) দীর্ঘ ২৫ বছর শাসন করেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট হলেন শাভকাত মিরজিয়োয়েভ (Shavkat Mirziyoyev), যিনি সংস্কারমূলক নীতির মাধ্যমে দেশকে আরো উন্মুক্ত ও উন্নয়নমুখী করে তুলছেন।
উজবেকিস্তানের অর্থনীতি কৃষি, শিল্প ও খনিজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল। প্রধান রপ্তানিপণ্য হলো তুলা, স্বর্ণ, প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল।
বর্তমানে পর্যটন, নির্মাণ এবং পরিষেবা খাতেও প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সরকার অর্থনৈতিক উদারীকরণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
উজবেকিস্তান পর্যটকদের জন্য এক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্বর্গ। এখানে বহু ইউনেস্কো তালিকাভুক্ত ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে, যেমন:
সমরকন্দ – রেজিস্তান স্কয়্যার, শাহ-ই-জিন্দা, তিমুরের সমাধি।
বুখারা – কালান মসজিদ, আরক ফোর্ট, লাবি-হাউজ।
খিভা – ইচান-কালা শহর, মিনার ও মাদ্রাসা।
তাসখন্দ – মেট্রো স্টেশনগুলো তাদের নান্দনিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত।
চরভাক হ্রদ, তিয়ান শান পর্বতমালা – প্রকৃতি ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য আকর্ষণীয়।
উজবেকিস্তানে শিক্ষা ব্যবস্থা বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে আধুনিকায়ন চলছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে।
উজবেকিস্তান যদিও অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রসর হচ্ছে, তবে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত।
বেকারত্ব ও গ্রামীণ দারিদ্র্য।
পরিবেশগত সংকট, বিশেষ করে আরাল সাগরের সংকোচন একটি বড় সমস্যা।
তবে সরকারের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ও বৈদেশিক সহযোগিতার মাধ্যমে দেশটি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।
উজবেকিস্তান একটি ঐতিহাসিক ঐশ্বর্যে ভরপুর, সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং আধুনিক উন্নয়নের পথে থাকা দেশ। মধ্য এশিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই রাষ্ট্রটি ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রাখে।