মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১৪ পূর্বাহ্ন

চরম শঙ্কায় গ্রীন কার্ডধারীরা

  • আপডেট সময় বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন বিরোধী ক্র্যাকডাউনে শুধু অবৈধ অভিবাসী নয় গ্রীন কার্ডধারীরা চরম দু:শ্চিন্তায় পড়েছেন। সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বৈধ গ্রীন কার্ডধারী ও ভিসাধারী একাধিক ব্যক্তিদের বহিষ্কারের উদ্দেশে গ্রেপ্তার এবং এয়ারপোর্ট থেকে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীকে গ্রীন কার্ডসহ বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও ডিপোর্ট করার ঘটনায় দু:শ্চিন্তার পারদ আরো তীব্র হয়ে ওঠেছে। এছাড়াও যারা রাজনৈতিক আশ্রয় বা এসাইলামের মাধ্যমে বৈধ হয়েছেন সম্প্রতি এমন অনেকের কেইস পুনরায় রিভিউয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইউএস ইমিগ্রেশন।
ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞদের মতে, আমেরিকার অভিবাসন নীতির কিছু আইন রয়েছে যা আগের প্রেসিডেন্টদের প্রশাসন শিথিল রেখেছিলো। কিন্তু বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন এসব আইনের কঠোর প্রয়োগ শুরু করেছে। তাছাড়া আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি কিংবা জাতীয় নিরাপত্তায় ঝুঁকি এমন কার্যক্রম নজরে পড়লে যে কেউ বহিষ্কার ও গ্রেপ্তার হতে পারেন। বর্তমানে শুধু আমেরিকা নয়, এদেশের সরকার প্রশাসন বিরোধী কোন কিছু করলেও ইমিগ্যান্টরা বিপাকে পড়তে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষ করে গ্রীনকার্ডধারী যারা আছেন তাদেরকে সতর্কতার সহীত চলতে হবে। ঘন ঘন এদেশের বাহিরে ভ্রমণ কিংবা টানা কয়েকমাস দেশের বাহিরে অবস্থান না করা পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ট্রাম্প প্রশাসন বলছে দেশের নিরাপত্তার হুমকি আছে এমন যেকোন গ্রীণকার্ডধারীর কার্ড বাতিল করার আইন আছে।
এবিসি নিউজ, নিউইয়র্ক টাইমসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সম্প্রতি নিউইয়র্কের কলোম্বিয়া বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীন কার্ডধারী মাহমুদ খলিলকে গ্রেপ্তার করে বহিষ্কারের চেষ্টা করছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কর্তৃপক্ষ। তাঁর বিরুদ্ধে ইসরায়েল বিরোধী ও ফিলিস্থিনপন্থী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। তবে নিউইয়র্কের ফেডারেল কোর্টের বিচারক মাহমুদের বহিষ্কারাদেশ সাময়িক স্থগিত করেন। সর্বশেষ তিনি নিউ জার্সিতে আইস এর ডিটেনশন সেন্টারে থাকায় সেখানকার আদালতে তার বিচারিক কার্যক্রম চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই ভার্সিটির আরেক শিক্ষার্থীকে একই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে ভারতীয় নাগরিক ওয়াশিংটন ডিসির জর্জটাউন ভার্সিটির ফেলো গবেষক বদর খান সুরিকে গ্রেপ্তার করে তার স্টুডেন্ট ভিসা বাতিল করে ডিপোর্ট করা প্রক্রিয়া শুরু করে ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তাঁর বিরুদ্ধেও ফিলিস্থিনপন্তী অভিযোগ আনা হয়। তাঁর স্ত্রী ফিলিস্থিনী বংশোদ্ভুত ও আমেরিকান সিটিজেন।
এদিকে লেবাননী ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইফনিভার্সিটি হাসপাতালের নারী চিকিৎসক ডা. রাশা আলাওয়েকে গত সপ্তাহে বিমানবন্দর থেকে ডিপোর্ট করে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি। হিজবুল্লাহার সাথে সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে তাঁকে ডিপোর্ট করা হয়। শুক্রবার ফ্রান্সের নাগরিক এক বিজ্ঞানী যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাধারী, তাঁকে বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন বিরোধী মতামত প্রচারের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দর থেকে ডিপোর্ট করে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকজন গ্রীন কার্ডধারী যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পথে নিউইয়র্কে জেমফকে এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কঠিন জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। এদের বেশ কয়েকজনকে দীর্ঘসময় বসিয়ে রেখে তাদের সাথে থাকা মোবাইলসহ কাগজপত্র চেক করা হয়।
এসব পরিস্থিতিতে ব্রাউন ইফনিভার্সিটিকর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক ছাত্র ও কর্মীদের বিদেশে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে বলেছে।কারণ তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ডা. রাশা আলাওয়েযিনি ওয়ার্ক পারমিটে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। নিজ দেশ লেবাননে গিয়ে ফেরত আসার সময়  বহিষ্কৃত হন।
জাতীয় অভিবাসন আইন কেন্দ্রের আইনজীবী লিন দ্যামিয়ানো পিয়ারস ওয়ালস্ট্রীট জার্নালকে বলেন “আমরা অভিবাসন বিরোধী এমন ধরনের বৃদ্ধিরত কার্যক্রম বাস্তবায়নের সাক্ষী হচ্ছি, যা ট্রাম্প প্রশাসনের ক্ষমতায় আসার আগের প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি।”
ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল তাদের প্রতিবেদনে বলে, যখন বিদেশ থেকে অনাগরিকরা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন, তখন একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে তাদের পুনরায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে কি না।  কর্মকর্তারা  স্বাস্থ্য, অপরাধ, নিরাপত্তা এবং বিদেশী নীতির সমস্যা সহ বিভিন্ন কারণে তাদের অযোগ্য বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রে এন্ট্রি বাতিল করতে পারেন।  ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।
ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট অফিসাররা গ্রীনকার্ডধারীদের আটক করতে পারেন। তবে স্থায়ী বাসিন্দা গ্রীণকার্ডধারী তার বিষয়টি বিবেচনার জন্য ইমিগ্রেশন জাজ এর শরনাপন্ন কিংবা অভিবাসী কর্মকর্তারা তাকে বিচারকের সামনে হাজির করার আইনী বিধি রয়েছে। এরকম মামলা চলাকালে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আটক রাখতে পারেন গ্রীনকার্ডধারী ওই ব্যক্তিকে।
গ্রীন কার্ডধারীদের অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে থাকার অধিকার নেই ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের এমন বক্তব্য ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (ওঈঊ)-এর অভিযানে সাম্প্রতিক অভিবাসী গ্রেপ্তারের ঘটনায় গ্রীন কার্ডধারীদের মনে আতঙ্ক বাড়িয়েছে। কিছু গ্রীন কার্ডধারী বিদেশ ভ্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন, কারণ তারা ফিরে আসার পথে আটক বা বিতাড়িত হওয়ার আশঙ্কা করছেন। এছাড়া ভিন্ন জাতি ও ধর্মের নির্দিষ্ট  পোশাক এবং সংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইমিগ্রেশন আইন অনুযায়ী, গ্রিন কার্ডধারীরা নির্দিষ্ট অপরাধে জড়িত হলে তাদের বিতাড়িত করা যেতে পারে। তবে “বিদেশ নীতিতে নেতিবাচক প্রভাব” বিষয়টি খুবই অস্পষ্ট এবং এর প্রয়োগ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
বিশেষজ্ঞ লাতোয়া ম্যাকবিন পম্পি মনে করেন গ্রীন কার্ডধারীদের অধিকার রক্ষায় যথাযথ প্রক্রিয়াগুলোর প্রতি সম্মান দেখানো উচিত।
বিশেষজ্ঞ ডেভিড লিওপোল্ড বলেন, এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক কারণ এটি ভবিষ্যতে আরও বৈধ অভিবাসীদের ডিপোর্টেশনের লক্ষ্যবস্তুতে ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, যেকোনো ধরনের ভ্রমণের আগে অভিজ্ঞ ইমিগ্রেশন আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া উচিত। সব প্রয়োজনীয় নথি সবসময় হাতের কাছে রাখা জরুরি।এই ধরনের পরিস্থিতি নিয়ে কমিউনিটিতে আলোচনা করা এবং সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
গ্রিন কার্ডধারীদের এই ধরনের উদ্বেগ বোঝা যায় এবং এটি একটি গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন স্কুলের সহকারী অধ্যাপক ম্যাথিউ বোয়াজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাও বিদেশ থেকে ফিরে আসার সময় কিছু পরীক্ষার সম্মুখীন হন। কিছু ক্ষেত্রে, অভিবাসন এজেন্টরা অনুসন্ধান করতে পারে, যার মধ্যে তাদের ফোনের বিষয়বস্তুও দেখতে পারেন। তাছাড়া এক্ষেত্রে একজন ব্যাক্তি যদি আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভে জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত না হন, তাহলে তাদের পুনরায় দেশে প্রবেশ থেকে আটকানো হবে না।
ট্রাম্প প্রশাসন  একাধিক দেশের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আনতে যাচ্ছেন। যদিও চূড়ান্ত তালিকা এখনো প্রকাশ হয়নি। এই নিষেধাজ্ঞা মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব দেশের নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীনকার্ডধারী হলেও বিদেশ থেকে ফেরার পথে ডিপোর্ট হতে পারেন। এসব দেশে ভ্রমণকারী যে কোন গ্রীনকার্ডধারীরাও ডিপোর্টসহ নানা জটিলতায় পড়তে পারেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসন কর্তৃপক্ষ সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে পারে যে কোন গ্রীনকার্ডধারী এবং বিভিন্ন অভিবাসী সিটিজেন নাগরিককেও।
এ বিষয়ে এটর্নি মীর মিজানুর রহমান বলেন, বর্তমানে আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসীদের জন্য খুবই কঠোর অবস্থানে আছে। এখন শুধু অবৈধরা না, যেকোন বৈধ স্ট্যাটাসধারী অভিবাসী যেমন গ্রীন কার্ড আছে তারাও বর্তমান পরিস্থিতিতে এদেশের ইমিগ্রেশন আইনের মুখোমুখি হতে পারেন। আমরা জানি যে ফার্স্ট এমেন্ডমেন্ট রাইটস নিয়ে যে কেউ এদেশে থেকে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারতেন। কিন্তু এখন সেটা আর দেখানোর সুযোগ নেই। এখন আমেরিকার গভর্নমেন্ট এর বিরুদ্ধে কথা বললে বিপাকে পড়তে পারেন। এদেশের পররাষ্ট্র নীতি কিংবা জাতীয় নিরপত্তার হুমকি এমন কিছু কাজ বা কোন মতামত প্রকাশ করলে যেকোন বৈধ অভিবাসী ইমিগ্রেশন আইনের মাধ্যমে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।
আরেকটা বিষয় সচেতন থাকতে হবে, সেটি হলো আমেরিকা কর্তৃক যেকোন দেশের কোন গোষ্ঠি বা ব্যক্তিকে জঙ্গী ও উগ্রবাদ হিসেবে চিহ্নিত করে ঘোষণা দিয়েছে। আর তার পক্ষে যদি কেউ সামান্যতম পক্ষপাতমূলক কোন মতামত প্রকাশ করেন আর তিনি যদি গ্রীনকার্ডধারী অথবা অভিবাসন নীতির মাধ্যমে সিটিজেনশীপ গ্রহণ করেন তাকেও বর্তমান প্রশাসন গ্রীনকার্ড কিংবা সিটিজেনশীপ বাতিল করতে পারে। এজন্য কংগ্রেসে পাশ হওয়া একটি আইন আছে, সেটি প্রয়োগ করতে পারে প্রশাসন। কখনোই ক্রিমিনাল এক্টিভিটিস ও জালিয়াতিতে অভিযুক্ত না হোন সেদিকে সচেতন থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, যারা গ্রীনকার্ডধারী তারা ঘন ঘন বিদেশ অথবা নিজের দেশে যাওয়া আসা করেন। তারা এখন সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া যারা এসাইলামের মাধ্যমে গ্রীনকার্ড পেয়েছেন তারা সিটিজেনশীপ পাওয়ার আগে ভুলেও দেশে যাবেন না। দেশ থেকে ফেরার সময় এখানে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এদেশে প্রবেশ করতে নাও দিতে পারে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com