মঙ্গলবার, ০৪ মার্চ ২০২৫, ০২:১৩ পূর্বাহ্ন

পাকিস্তানে ২৪০ মিলিয়ন ডলারের রহস্যময় বিমানবন্দর

  • আপডেট সময় সোমবার, ৩ মার্চ, ২০২৫

টার্মিনালে কোনো যাত্রী বা উড়োজাহাজের উপস্থিতি নেই—এমন আবহে এক রহস্যে পরিণত হয়েছে পাকিস্তানের নতুন ও দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিমানবন্দরটি। পুরোপুরি চীনের অর্থায়নে নির্মিত ২৪০ মিলিয়ন (২৪ কোটি) ডলারের নিউ গদর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট কবে চালু হবে, তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। স্থানীয় উন্নয়নের পরিবর্তে ব্যয়বহুল এ বিমানবন্দর তৈরি নিয়ে অঞ্চলটির অধিবাসীদের ক্ষোভ রয়েছে। খবর এপি।

দক্ষিণ-পশ্চিম বেলুচিস্তান প্রদেশের উপকূলীয় শহরে অবস্থিত নতুন এ বিমানবন্দর। ২০২৪ সালের অক্টোবরে নির্মাণ শেষ হওয়া এ স্থাপনার আশপাশে রয়েছে দারিদ্র্যপীড়িত ও অশান্ত অঞ্চল, যা এর শানশওকতের সম্পূর্ণ বিপরীত।

এক দশক ধরে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকল্পের আওতায় বেলুচিস্তান ও গদরে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে চীন। মূলত পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশকে আরব সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে বেইজিংয়ের নেয়া বহুমূল্য প্রকল্পের অংশ এটি। কর্তৃপক্ষ বড় ধরনের রূপান্তরের কথা বললেও গদরে এ পরিবর্তনের খুব কমই প্রমাণ দেখা যাচ্ছে। শহরটি এখনো জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের অংশ নয়। বিদ্যুৎ আসে প্রতিবেশী ইরান বা সৌর প্যানেলের মাধ্যমে এবং এখানে পর্যাপ্ত পরিষ্কার পানিও নেই। সব মিলিয়ে শহরের ৯০ হাজার বাসিন্দার জন্য ৪ লাখ যাত্রী ধারণক্ষমতার একটি বিমানবন্দর কোনোভাবেই অগ্রাধিকারের বিষয় নয়।

পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক গবেষক আজিম খালিদ বলেন, ‘এ বিমানবন্দর পাকিস্তান বা গদরের জন্য নয়। এটি চীনের জন্য, যাতে তাদের নাগরিকরা নিরাপদে গদর ও বেলুচিস্তানে প্রবেশ করতে পারে।’

বলা হচ্ছে, সিপিইসি প্রকল্প বেলুচিস্তানের সম্পদসমৃদ্ধ ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডে দীর্ঘদিন ধরে চলা বিদ্রোহকে আরো উসকে দিয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভিযোগ, স্থানীয়দের স্বার্থ উপেক্ষা করে রাষ্ট্র শুধু শোষণের পথ বেছে নিয়েছে।

পাকিস্তানের জাতিগত বেলুচ জনগণের অভিযোগ, তারা বৈষম্যের শিকার এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যদিও সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

চীনের বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখতে গদরে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে পাকিস্তান সরকার। শহরটি এখন পরিণত হয়েছে চেকপয়েন্ট, কাঁটাতারের বেড়া, সেনাসদস্য, ব্যারিকেড ও ওয়াচ টাওয়ারের এক বিশৃঙ্খল মিশ্রণে। শহরটিতে যেকোনো সময় সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়, যাতে চীনা কর্মী এবং পাকিস্তানি ভিআইপিদের নিরাপদে চলাচল নিশ্চিত করা যায়।

সাংবাদিকদের চলাফেরাও এখানে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। গদরের মাছের বাজারের মতো সাধারণ জায়গাও সংবেদনশীল স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। স্থানীয় অধিবাসী ৭৬ বছর বয়সী খুদা বখশ হাশিম বলেন, ‘আগে কেউ জিজ্ঞেস করত না আমরা কোথায় যাচ্ছি, কী করছি বা আমাদের নাম কী। এখন আমাদের পরিচয় প্রমাণ করতে হয়, আমরা কারা, কোথা থেকে এসেছি—আমরা তো এখানকারই বাসিন্দা! বরং যারা এসব প্রশ্ন করছে তাদেরই নিজেদের পরিচয় জানানো উচিত।’

গদর শহরটি ১৭৯৭ সালে ওমান সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৮ সালে শহরটিকে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই সময়ের কথা ভেবে হাশিম স্মৃতিকাতর হন। তখন এটি মুম্বাইগামী যাত্রীবাহী জাহাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টপেজ ছিল। তিনি বলেন, ‘সে সময় মানুষ অভুক্ত থাকত না, কাজের অভাব ছিল না, খাবারের সংকট ছিল না এবং পানীয় জলেরও ঘাটতি ছিল না।’

পাকিস্তান সরকারের দাবি, সিপিইসি প্রকল্পে প্রায় ২ হাজার স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে ‘স্থানীয়’ বলতে বেলুচ জনগণকে বোঝানো হয়েছে নাকি পাকিস্তানের অন্য অঞ্চল থেকে আগত শ্রমিকদের কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়নি।

এখানকার অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর থেকে বর্তমানে শুধু সপ্তাহে তিনবার করাচির উদ্দেশে ফ্লাইট ছাড়ে। বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী কোয়েটা বা রাজধানী ইসলামাবাদের জন্য সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। উপকূলীয় মহাসড়কটিতেও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে।

নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে গদর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্বোধন বিলম্বিত হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিমানবন্দরকে লক্ষ্যবস্তু করতে চারপাশের পাহাড় সন্ত্রাসীদের জন্য পছন্দনীয় হতে পারে। ফলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং ভার্চুয়াল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করেন। উদ্বোধনী ফ্লাইটটি গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ রাখা হয়েছিল।

বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টির জেলা সভাপতি আবদুল গফুর হোথ বলেন, ‘গদরের একজন বাসিন্দাও এ বিমানবন্দরে কাজের সুযোগ পায়নি, এমনকি নিরাপত্তারক্ষী হিসেবেও নয়।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, সিপিইসির জন্য তৈরি এ বন্দরে ক’জন বেলুচ কাজ করছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ আজিম খালিদের মতে, স্থানীয় শ্রমিক, পণ্য বা পরিষেবা ছাড়া সিপিইসি থেকে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়। বরং চীনা বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে সামরিক দমন-পীড়নও বেড়েছে, যা বাধা ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি করেছে। তার ভাষ্য, পাকিস্তান সরকার যেমন বেলুচ জনগণকে কিছুই দিতে চায় না তেমনি বেলুচরাও সরকারের কাছ থেকে কিছুই নিতে চায় না।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com