পাহাড় মানেই তো প্রশান্তি আর স্নিগ্ধতার পরশ। সবুজ পাহাড়ের মায়াবী সৌন্দর্য, মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের মিতালির অনন্যসাধারণ রূপ দেখে মুগ্ধ না হয়ে কি কারও উপায় আছে! ‘পাহাড়’ ভালোবেসে পাহাড় কেনার ইচ্ছা ব্যক্ত করে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘অনেক দিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ/ কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না/ যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না।/ আমার নিজস্ব একটা নদী আছে/ সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে/ কে না জানে পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশি/ পাহাড় স্থানু, নদী বহমান/ তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়ই কিনতাম।’ আসলেই তো, প্রকৃতির সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে চাইলে পাহাড়ে যেতে হবেই। পাহাড়ের মতোই বিশাল হতে হবে। তাহলেই পূর্ণতা পাবে সব তৃষ্ণা।
পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির মহত্ব অনুভব করতে আমরাও খুব তাগিদ অনুভব করছিলাম। এ কারণেই বান্দরবান ভ্রমণের জল্পনাকল্পনা চলছিল বহু আগে থেকেই। অবশেষে আবার নতুন করে উদ্যোগ নেওয়ার সাহস উসকে দিল সম্প্রতি ইউএসএ থেকে দেশে ঘুরতে আসা স্ত্রীর ছোট ভাই দীপ্ত ঘোষ। সিদ্ধান্ত হলো, পারিবারিক আনন্দভ্রমণে বের হব এবার ফেব্রুয়ারির মধ্য সপ্তাহের মধ্যেই। পরিকল্পনাকে সহজ করতে নির্ধারিত সময়ের এক দিন আগেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ই আমরা পৌঁছে যাই বান্দরবান। শহরের পরিচিত হোটেল হিলটনে রুম বুকিং করে রেখেছিলেন সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করা চবির সহকারী অধ্যাপক নাট্যজন সুবীর মহাজন। আমি, স্ত্রী অনামিকা, ছেলে বর্ণিল, শ্যালক দীপ্ত ও তার স্ত্রী পিয়া, পিয়ার ভাই প্রাপ্ত, শ্যালিকা অর্পা, শ্যালক শুভ্র, রক্তিম, শ্যালিকার বর ব্যাংক কর্মকর্তা রাহুল চৌধুরীসহ আমরা টিমে ছিলাম মোট ১৩ জন। সৌভাগ্যক্রমে আরও কয়েকজন পারিবারিক স্বজনকেও ভ্রমণের সহযোগী হিসেবে পেয়ে যাই। তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রামের পরিচিত আলোকচিত্র টিম চিত্রকুঞ্জের স্বত্বাধিকারী রোহিত চৌধুরী, টিমের অন্যতম সদস্য অর্পণ ঘোষ ও অভি দেবও বৃহস্পতিবার রাতে যুক্ত হয়েছিলেন।
এরপর প্রথম দিনের নীলগিরি ভ্রমণের জন্য ‘চাঁদের গাড়ি’ ঠিক করার জন্য চলে এলাম হোটেল হিলটনের সামনে। কয়েক মিনিটের মধ্যে পেয়েও গেলাম আমানউল্লাহ নামের চাঁদের গাড়ির একজন চালককে। তিনি জানালেন, পরের দিনের নীলগিরি যাত্রার জন্য প্রথম সিরিয়ালটি তাঁর। এটাও জানালেন, ভোর পাঁচটার দিকে নীলগিরির উদ্দেশে রওনা দিলে সকাল সাতটার মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব। কিছুক্ষণ বাদানুবাদের পর ৫ হাজার ৭০০ টাকায় নীলগিরিসহ এ রুটের অন্য স্পট দেখানোর সিদ্ধান্ত হলো। রাতের খাবার খাওয়ার জন্য বেছে নিলাম হোটেল হিলটনের সামনেই কলাপাতা রেস্তোরাঁকে। হরেক রকমের ভর্তা দিয়ে শেষ করলাম রাতের খাবার।
শুক্রবার ভোরে কাউকেই ঘুম থেকে ডেকে তুলতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি; বরং পাহাড়ে নতুন অ্যাডভেঞ্চারের আশায় ভোর পাঁচটায় উঠেই টিমের সবাই যাত্রার জন্য তৈরি। এদিকে ৫টা ১০ মিনিটের দিকে চাঁদের গাড়ির চালকও হাজির। তবে ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। অন্ধকারেই গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে নীলগিরির উদ্দেশে যাত্রা শুরু হলো ভোর ৫টা ১৫ মিনিটের দিকে।
সৌভাগ্য আমাদের, নীলগিরিতে সেদিন প্রথম গাড়ির দর্শনার্থীর টিম। নীলগিরির গেটে পৌঁছাতেই অন্য রকম এক ভালোলাগা। প্রতিজন ১০০ টাকায় টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। এ তো প্রকৃতির অসাধারণ সৌন্দর্যে রীতিমতো হারিয়ে যাওয়ার পালা। যেদিকেই তাকাই, সব দিকেই বিস্তীর্ণ বনভূমি। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্যের সঙ্গে নিজেদের ছবি ফ্রেমবন্দী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দীপ্ত, পিয়া, অনামিকা, বর্ণিল, অর্পা, প্রাপ্ত, শুভ্র ও রক্তিম। এদিকে একের পর এক ছবি ক্লিক করে চলেছে রোহিত, অর্পণ ও অভির ডিএসএলআর ক্যামেরা। একটু এগোতেই আকর্ষণীয় হেলিপ্যাডে আবারও ফটোসেশন। প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো কাটিয়ে নীলগিরি ক্যাফেতে সেরে নিলাম সকালের নাশতা।
সকাল ৯টার দিকে রওনা দিলাম নীলগিরির মূল স্পট থেকে। ১০ থেকে ১৫ মিনিট এগোতেই গাড়ি থামল ডাবল হ্যান্ড ভিউ পয়েন্টে। দারুণ সুন্দর এই স্পট। ছবি তোলার জন্য দর্শনার্থীদের কিছুটা ভিড় লক্ষ করা গেল এ স্পটে। তবে ফাঁকে ফাঁকে আমরাও ছবি তোলার সুযোগ মিস করিনি। পাহাড়ের সুস্বাদু বড়ই (কুল) পাওয়া গেল এখানকার দোকানগুলোয়। মুখে নিতেই দেখা গেল দারুণ মিষ্টি। তাই কিনে নিলাম কয়েক কেজি।
পরবর্তী স্পট চিম্বুকে খুব বেশি সময় থাকা হলো না। গেলাম শৈলপ্রপাতে। চালক জানালেন, আমরা শহরের খুব কাছাকাছি। শৈলপ্রপাত ঝরনা থেকে বান্দরবান শহরের দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। রাস্তার পাশে বানানো সিঁড়িতে নেমে গেলাম নিচে। ঝরনায় খুব বেশি পানি পাওয়া যায়নি। তবে এর স্বচ্ছ ও ঠান্ডা পানি মন ভরাল। ঘুরে দেখলাম শৈলপ্রপাতকে ঘিরে এখানকার দোকানগুলোয় বম নারীদের হাতে বোনা চাদর, মাফলার, বেডশিটসহ বেত ও বাঁশের তৈরি আসবাব, তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন জিনিসের পসরা। সেখানে বিক্রি হচ্ছিল বমদের উৎপাদিত মৌসুমি ফলমূলও। সেখান থেকে আমরা রওনা দিই বান্দরবান শহরের দিকে।
বান্দরবান শহরে এসে পৌঁছি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে। হোটেলের রুমে এসে ফ্রেশ হলাম সবাই। দুপুরের খাবারের পর ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে গেলাম স্থানীয় বাজার ও বার্মিজ মার্কেটে। ঘণ্টাদুয়েক ঘুরে কিছু কেনাকাটা সেরে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘মুন্ডি’ খেতে গেলাম মারমাপাড়ায়। দেখলাম জনপ্রিয় এ ‘মুন্ডি’ খেতে সন্ধ্যায় এখানকার দোকানগুলোয় বেশ ভিড়। হোটেলে ফিরে রাতের খাবার খেলাম।
পরদিন শনিবার গন্তব্যের স্পট নীলাচল ও মেঘলা পর্যটনকেন্দ্র। যেহেতু শহর থেকে এ পর্যটন কেন্দ্রগুলোর দূরত্ব চার থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে, তাই যাত্রা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা বা অস্থিরতা নেই কারোর মধ্যেই। ঘুম থেকে উঠে হোটেল থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে তাই সকাল সাড়ে ৯টা। হোটেলের নিচে এসে চাঁদের গাড়ি পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। ভাড়া নির্ধারিত হলো ১ হাজার ২০০ টাকা।
নীলাচলে প্রায় দুই ঘণ্টার মতো কাটিয়ে এবারের গন্তব্য মেঘলা পর্যটনকেন্দ্র। মাত্র কয়েক মিনিটেই চলে এলাম এই স্পটে। প্রতিজন ৫০ টাকা টিকিট কেটে ঢুকলাম ভেতরে। উঁচু–নিচু পাহাড় পরিবেষ্টিত এই কৃত্রিম লেকের সৌন্দর্য যে কারোর মন কাড়বে নিঃসন্দেহে। লেকের স্বচ্ছ পানির সঙ্গে চারদিকের সবুজে মেতে ওঠার আনন্দটাই অন্য রকম। ঝুলন্ত সেতুর সৌন্দর্যও তৈরি করেছিল অন্য রকম আবেশ। চিড়িয়াখানা তেমন মন না ভরালেও কেব্ল কার ও প্যাডেল বোটে চড়ার আনন্দে মেতে উঠেছিল টিমের সদস্যরা।
বেলা তিনটার দিকে আমরা ফিরে এসে দুপুরের খাবার সেরে নিই ‘বেয়াই বাড়ি’রেস্টুরেন্টে। দুই দিনের ভ্রমণ শেষে গন্তব্যে ফেরার পালা শনিবার। তবে প্রকৃতির উজাড় করা ভালোবাসায় মন সায় দিচ্ছিল না কিছুতেই। বিশেষ করে রোহিত, অর্পণ আর অভি তো রীতিমতো আরও এক দিন থেকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত! তবে একসঙ্গে আসার তাগিদে সবার জোরাজুরিতে তাদেরও অবশেষে একসঙ্গে ফিরে আসতে রাজি হতে হলো। ফেরার জন্য বিকেল সাড়ে চারটার টিকিট নেওয়া হলো পূর্বাণী বাসের।
অবশেষে বিদায় বান্দরবান। সবাই বিষণ্ন,œতার সঙ্গে সন্ধ্যার বিষণ্নতাও মিলেমিশে যেন একাকার! চলতে শুরু করেছে আমাদের বাস। পেছনে পড়ে আছে স্বর্গভূমিতে অপার মুগ্ধতায় কাটানো দুই দিনের চমৎকার সব স্মৃতি। আর মন ভরে পাহাড়ি সবুজ আর প্রাণ ভরে মেঘ ছোঁয়া প্রশান্তির অসাধারণ এক আমেজ…।