নিঝুম দ্বীপের অবস্থান
দেশের দক্ষিণের বিভাগ চট্টগ্রামের নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত হাতিয়া উপজেলার ছোট একটি দ্বীপ এই নিঝুম দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের বুকে মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এই চরটি হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একরের এই দ্বীপটি সাগরের মাঝখানে জেগে ওঠে ১৯৪০ সালে। তারও প্রায় এক দশক পর গড়ে ওঠে জনবসতি। দ্বীপটিকে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল।
জনবসতি গড়ে ওঠার একদম শুরুর দিকে এই দ্বীপের নাম ছিল চর ওসমান ও বাউল্লার চর। লোকমুখে শোনা যায়, এখানে বসতি গড়া প্রথম মানুষটির নাম ওসমান। তিনি ছিলেন একজন বাথানিয়া। আর তখন তার নামানুসারেই দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছিল।
দর্শনীয় স্থানসমূহ
নিঝুম দ্বীপের বিশেষত্ব হচ্ছে চিত্রা হরিণ ও শীতকালের অতিথি পাখি। একসঙ্গে এতো চিত্রা হরিণ দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। আর সন্ধ্যা নামলেই শিয়ালের ডাক শিরদাঁড়া দিয়ে রোমাঞ্চের ঢেউ তোলে।
পাখি, হরিণ দেখতে হলে খুব ভোরে উঠতে হবে। আগে থেকেই কোনো স্থানীয় গাইডকে বলে রাখা যেতে পারে। তাহলে সঠিক জায়গায় যেতে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। স্থানীয় ছোট ছোট ছেলেরাই গাইডের কাজ করে। ওরাই সাধারণত পর্যটকদের ম্যানগ্রোভ বনের হরিণ দেখিয়ে নিয়ে আসে।
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য এখানকার সেরা জায়গা নামা বাজার সৈকত। নামা বাজার থেকে পায়ে হেঁটে ১০ মিনিটের মধ্যেই সৈকতে পৌঁছা যায়। বারবিকিউয়ের জন্যও এ জায়গাটি বেশ জনপ্রিয়।
নিঝুম দ্বীপ ছাড়া পাখিদের মেলা বসে পাশের দ্বীপ কবিরাজের চর ও দমার চরে। পড়ন্ত বিকেলে কবিরাজের চরের কাছে চৌধুরীর খাল দিয়ে নৌকা করে কিছু দূর গেলেই চোখে পড়বে চিত্রা হরিণ। ট্রলার রিজার্ভ করা হলে মাঝিই হরিণ দেখিয়ে নিয়ে আসতে পারবে। ১০ থেকে ১৫ জনের জন্য ট্রলার ভাড়া পড়তে পারে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা।
তাজা ইলিশ খাওয়ার জন্য কমলার দ্বীপ সেরা জায়গা। জাতীয় উদ্যান এলাকা থেকে সাগর ঘোরার জন্য ৪০ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ফাইবার বোট ভাড়া দেওয়া হয়।
শীতের অতিথি পাখি দেখার জন্য এখানকার আরো একটি দর্শনীয় জায়গা হচ্ছে ভার্জিন আইল্যান্ড। দমার চরের দক্ষিণে নতুন সৈকতটিই ভার্জিন আইল্যান্ড। দমার চর ঘুরে আসতে হলে ট্রলার ভাড়া পড়বে প্রায় তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা। নিঝুম দ্বীপ থেকে একটু দূরের পথে দেখা মিলবে ভোলার ঢালচর আর চর কুকরি-মুকরি।
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের সেরা সময়
নিঝুম দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করার শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে শীত ও বসন্তকাল। হেমন্তের শেষলগ্নে তথা অক্টোবর থেকে এপ্রিলের ঠিক মাঝামাঝি সময়টাই উপযুক্ত সময়। এ সময় রাস্তাঘাট শুকনো থাকায় আশেপাশের যেকোনো জায়গায় যাওয়া যাবে। এ ছাড়া হরিণ দেখার জন্য বনের পথে হাঁটতে সুবিধা হবে।
বর্ষাকালে গেলে হাঁটু সমান কাদায় পুরো দ্বীপ হেঁটে ঘুরতে হবে। যানবাহন নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হবে। তবে ভোজন রসিকদের জন্য সুখবর হলো, এ সময়টাতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় সেখানে। এ ছাড়া বছরের বাকিটা সময় মেঘনা নদী ও সাগর অনেক উত্তাল থাকে।
কিভাবে যাবেন
দেশের যেকোনো স্থান থেকে নোয়াখালীর সোনাপুরে যেতে হবে। ঢাকার যেকোনো বাস টার্মিনাল থেকে বাসে যাওয়া যাবে। ভাড়া পড়তে পারে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। সোনাপুর থেকে চেয়ারম্যান ঘাট যাওয়ার জন্য নিতে হবে সিএনজিচালিত অটোরিকসা। সিএনজিতে খরচ পড়তে পারে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। চেয়ারম্যান ঘাট থেকে হাতিয়া যাওয়ার জন্য আছে ট্রলার, সি-ট্রাক ও স্পিড বোট। এখান থেকে প্রতিদিন সকাল ৮টায় সি-ট্রাক ছাড়ে। যেগুলোতে জনপ্রতি ভাড়া পড়তে পারে যথাক্রমে ১২০-১৫০, ৯০ এবং ৪০০ টাকা। এই জলযানগুলো নামিয়ে দেবে হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে। আর নলচিরা থেকে চেয়ারম্যান ঘাট আসার ফিরতি সি-ট্রাক ছাড়ে সকাল ১০টায়।
নলচিরা ঘাট থেকে স্থলপথে হাতিয়া অতিক্রম করার জন্য একমাত্র উপায় হচ্ছে মোটরসাইকেল। এগুলো ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা ভাড়ায় সর্বোচ্চ দুইজনকে মোক্তারিয়া ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এরপর মোক্তারিয়া ঘাট থেকে ট্রলারে চেপে জনপ্রতি ২০/৩০ টাকায় পৌঁছা যাবে নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে।
ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সবচেয়ে সেরা উপায়টি হচ্ছে লঞ্চ ভ্রমণ। সদরঘাট থেকে প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৫টায় একটি লঞ্চ হাতিয়ার তমুরদ্দী ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। গন্তব্যে পৌঁছতে পৌঁছতে পরদিন সকাল ৯টা বেজে যাবে। তমুরদ্দী ঘাট থেকে ঢাকার ফিরতি লঞ্চ ছাড়ে দুপুর সাড়ে ১২টায়। লঞ্চের ভাড়া পড়তে পারে ৩০০ থেকে ২০০০ টাকার মতো। তমরুদ্দি ঘাট থেকে মোটরসাইকেলে মোক্তারিয়া ঘাট পৌঁছা যাবে। বাকি পথটা একই ভাবে পাড়ি দিতে হবে।
তবে তমরুদ্দি ঘাট থেকে সরাসরি নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার পর্যন্ত জলপথটা পাড়ি দেওয়ার আরেকটি উপায় আছে। তমরুদ্দি ঘাট থেকে কিছু মাছ ধরার ট্রলার সরাসরি নামার বাজার যায়। এগুলোতে উঠতে হলে সকাল ১০ টার আগেই ঘাটে উপস্থিত থাকতে হবে। আর জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এ ছাড়া এখান থেকে ট্রলার রিজার্ভ করেও সরাসরি নামার বাজার যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে সেক্ষেত্রে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া পড়তে পারে।
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ও নামার বাজার সৈকতের কাছেই ভালো মানের কয়েকটি রিসোর্ট আছে। এগুলোতে জনপ্রতি এক হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা খরচে বিভিন্ন ক্যাটাগরির রুম পাওয়া যাবে।
শীতের নিঝুম দ্বীপ মানেই ক্যাম্পিং। দ্বীপে ক্যাম্পিং এর জন্যে সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো নামার বাজারের নিঝুম রিসোর্টের পাশের খালটি পেরিয়ে সৈকতের কাছে প্রায় ছয় মাইলের বিশাল খোলা মাঠটি। ক্যাম্পিংয়ের জন্য রীতিমতো স্বয়ংসম্পূর্ণ নিঝুম দ্বীপ। এখানকার জাহাজমারা বাজারে ক্যাম্পিংয়ের প্রায় সব আইটেমই পাওয়া যায়। এ ছাড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায়ও তাঁবু ভাড়া পাওয়া যায়। তাই যাত্রার সময় সঙ্গে করে তেমন কিছুই নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
নিঝুম দ্বীপে পেটপূর্তির জন্য যেতে হবে নামার বাজারে। সেখানকার খাবার হোটেলগুলো সামুদ্রিক মাছ ও চিংড়ি ভাজার জন্য বেশ জনপ্রিয়। আগে থেকে অর্ডার করে রাখলে তুলনামূলক ভালো খাবার পাওয়া যায়।
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে সতর্ক থাকা আবশ্যক, বিশেষ করে যাত্রা শুরুর আগে অবশ্যই সেখানকার আবহাওয়ার ব্যাপারে অবগত হয়ে নেওয়া উচিত। নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুতের জন্য সবাই জেনারেটর ও সোলারের ওপর নির্ভরশীল। তাই যাত্রার মুহূর্তে ব্যাগ গোছানোর সময় শীতের পরিমিত কাপড় ও ফার্স্ট এইডের পাশাপাশি মোবাইল চার্জার, ক্যামেরা ও মোবাইলের জন্য অতিরিক্ত ব্যাটারি, পাওয়ার ব্যাংক ও টর্চের কথা ভুলে গেলে চলবে না।
বিভিন্ন যানবাহন ভাড়া করার সময় আগে থেকে ভালোভাবে মিটিয়ে নেওয়া উচিত। তবে দর কষাকষির সময় শিষ্টতা বজায় রাখতে হবে। সর্বোপরি, নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের সময় দ্বীপের পরিবেশ যেন অপরিষ্কার না হয় সেদিকে স্পষ্ট খেয়াল রাখতে হবে।
সূত্র : ইউএনবি