সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৩:৫২ অপরাহ্ন

নিউইয়র্ক টু নায়াগ্রা

  • আপডেট সময় সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

আমেরিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে নায়াগ্রা জলপ্রপাত বেশ জনপ্রিয়।

অনেকদিন ধরে যদিও এই শহরের নামের সঙ্গে গানটির কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটা তবুও গানটি বেশ ভালোলাগায় ভরিয়ে দিচ্ছে মন। আর হয়ে ওঠছে না, অতঃপর সকল ব্যস্ততাকে একটু দূরে সরিয়ে করোনা মহামারির অতিষ্ট যন্ত্রণা হতে হৃদিমনকে একটু প্রফুল্লতা দিতে পুরো পরিবার নিয়ে আমরা বের হলাম নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে। শুরুতে লক্ষ্য বাফেলো শহরে। ইদানিং নিউইয়র্ক থেকে অনেক নিকটআত্মীয় বাফেলো শহরে গিয়ে বসতি গড়েছেন। তাই তাদের সঙ্গে দেখা করাটাও বেশ জরুরি হয়ে ওঠেছে। সুতরাং এবার নায়াগ্রার রূপ-বৈচিত্র খুব কাছ থেকে দেখে নেবার পালা।

হাডসন নদী পাড়ি দেয়ার সময় হতে গাড়ির ভিতর বসে চোখ দুটো কখনও ডানে, কখনও বামে ঘুরছে। লং ড্রাইভ সবসময়ই পছন্দ করি কেননা গন্তব্যের টেনশন বেশ দূরে সরে থাকে বলে চারিদিকটা আরাম-আয়েশে দেখে নেয়া যায়। হ্যাকেনস্যাক নদী পাড়ি দেয়ার দৃশ্যগুলোও বেশ নজর কাড়ে । জন্ম বাংলাদেশের সিলেটে হওয়াতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দিকগুলো আলাদাভাবে টানে কেননা এগুলো দেখে দেখেই তো বেড়ে ওঠা তাই কোথাও গেলে নতুন দেখা দৃশ্যগুলোর সাথে নিজ জন্মভূমির চিরচেনা দৃশ্যের সাদৃশ্য খুঁজে বেড়াই। আবারও পাড়ি দিতে হচ্ছে নদী। প্যাসাইক নদী। বেশ শান্ত এই নদীটির সাথে যুক্ত রয়েছে হ্যাকেনস্যাক নদী। প্যাসাইক ও হ্যাকেনস্যাক নদীর মিলনস্থল হচ্ছে নিউয়ার্ক উপসাগর।

বেশ কিছুক্ষণ পর চোখে পড়লো কলম্বিয়া লেক। লেকটি আকারে খুব বড় না হলেও সৌন্দর্য্যরূপে অনন্য। ক্রিস্টোফার কলম্বাস হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে বাফেলো গন্তব্যে। কলম্বিয়া লেক পাড়ি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলে দেখা মিললো ডেলাওয়ার নদীর। এ নদীর শহরেই আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রাজনৈতিক উত্থান। ১৯৭২ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে চমক সৃষ্টি করে এই ডেলাওয়ার থেকে মার্কিন সিনেটে সিনেটর নির্বাচিত হন।

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিতে ওয়াশিংটনে যাত্রার আগে ডেলাওয়ারের নিউ ক্যাসেল শহরে জো বাইডেন এক আবেগঘন বক্তব্য বলেন, ‘ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যের গর্বিত সন্তান হিসাবে সব সময় আমার পরিচয় থাকবে। আমি যখন মারা যাব, এ ডেলাওয়ার রাজ্য আমার হৃদয়েই লেখা থাকবে। সেই ডেলাওয়ার নদী পাশে গাড়ি ছুটছে বাফেলোর দিকে। নিউইয়র্ক থেকে বাফেলো যাওয়ার যে দুটো সড়ক রয়েছে সেটির মধ্যখানে মিলনস্থন হচ্ছে বিংহামটন শহর। এই বিংহামটন থেকে আবারও দুটো পথ ধরে পৌঁছা যায় বাফেলোতে। আমেরিকার প্রতিটি রাজ্যজুড়ে নানা বৈচিত্রতা। নানান রূপে মানুষকে আনন্দ বিলিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটিরও বেশি অঙ্গরাজ্য।

বাফেলো শহরে যখন প্রবেশ করছি তখন গাড়িতে দরাজ গলায় জ্যামাইকান শিল্পী বব মার্লে গেয়ে চলেছেন তাঁর বিখ্যাত গান ‘বাফেলো সোলজার, ড্রেডলক রাস্তা/ দ্যায়ার ওয়াজ এ বাফেলো সোলজার/ ইন দ্য হার্ট অব আমেরিকা/ স্টোলেন ফ্রম আফ্রিকা, এট টু আমেরিকা/ ফাইটিং অন অ্যারাইভাল, ফাইটিং ফর সারভাইভাল…।

প্রায় ৭ ঘন্টার যাত্রা শেষে অতঃপর বাফেলো শহরের নায়াগ্রা স্কয়ারে পৌঁছলাম। প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে নজরকাড়া দৃষ্টিনন্দন বাহারি ডিজাইনের বাড়ি আর সবুজে ছায়া ঢাকা মাঠ শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুন। অতঃপর আত্মীয়ের বাসায় কাটলো প্রাণবন্ত সময়। বহুদিন পর নিউইয়র্কের চেনাজানা স্বজনদের বাফেলোতে দেখে মনেই হচ্ছে না এই প্রথম বাফেলোতে এসেছি। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের উত্তর-পশ্চিমের প্রান্তিক শহর হলো বাফেলো। বাফেলোতে রয়েছে বেশকিছু মসজিদ, মাদরাসা। আরেকটি বিষয় বেশ মুগ্ধ করেছে তা হচ্ছে নারীরা মাথায় হিজাব পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন চারিদিকে। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাও বেশ উন্নত। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকেরা মিলেমিশে বসবাস করছেন শহরটিতে।

নায়াগ্রা জলপ্রপাত। ছবি: ফরিদা নাসরিন।

নিউইয়র্ক হতে ৩৭৩ মাইল দূরের শহর বাফেলোর আয়তন ৫২ বর্গমাইল। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে আরেকটি বাংলাদেশ গড়ে নিয়েছেন এখানে বসতি স্থাপন করা বাঙালিরা। বাফেলোর পশ্চিমে ইরিক্যানেল, উত্তরে নায়াগ্রা জলপ্রপাত, দক্ষিণে বাফেলো নদী দ্বারা বেষ্টিত। নগর পরিকল্পনাবিদ জোসেফ এলিকট ছোট্ট এই শহরটির নকশা করেন। ১৮২৫ সালের দিকে ইরি ক্যানেল নামে নদীপথ চালু হওয়ার পর এ শহর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯০০ সালের মধ্যে বাফেলো আমেরিকার অষ্টম বৃহৎ শহরে পরিণত হয়। তবে আটলান্টিক মহাসাগরে যাওয়ার নতুন একটি সমুদ্রপথ চালুর পর থেকে বাফেলো বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। বাঙালি অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেট থেকে নব্বইয়ের দশক হতে বাফেলো শহরে আসতে শুরু করেন।

ট্রাফিক জ্যামহীন এই শহর পরিবেশ ও প্রকৃতির বৈচিত্রের জন্য সমগ্র আমেরিকা ও কানাডার মানুষের নিকট ভ্রমণ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। যা হোক, আমরা আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত স্থান নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে গেলাম। বহুদিন বহু মানুষের তোলা ছবিতে দেখা, কিংবা বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা প্রিয় জলপ্রপাতটিকে খুব কাছ থেকে দেখছি এ এক অন্যরকম শিহরণ। নায়াগ্রা সৌন্দর্যে চোখ দুটি পলক ফেলতে চাইছে না । এক নজরে দেখে নিলাম দৃষ্টি সীমায় যা ধরতে পারে। বিভিন্ন মাধ্যম হতে জানলাম নায়াগ্রা ‘এনগুইহারা’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে জলরাশির বজ্রধ্বনি।

নায়াগ্রা জলপ্রপাতের তিন ভাগের এক ভাগ আমেরিকায়। যে অংশকে সবাই আমেরিকান ফলস হিসেবে চিনে। বাকি দুই ভাগ কানাডায়। যার নাম কানাডিয়ান ফলস। এই জলপ্রপাতের আকার অনেকটা ঘোড়ার খুরের মতো বাঁকা। এটি মূলত তিনটি জলপ্রপাতের সমষ্টি। সবচেয়ে বড় জলপ্রপাতটির নাম হর্সশু ফলস বা কানাডা ফলস। এটি প্রায় ১৬৭ ফুট উঁচু থেকে ২৬০০ ফুট চওড়া পানির স্রোত নিয়ে নিচে আছড়ে পড়ে। বলা হয়, নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ৯০ ভাগ পানি এই ফলস দিয়েই পতিত হয়। এর পরের ফলসটির নাম আমেরিকান ফলস। এটি প্রায় ৭০ ফুট উঁচু এবং ১৬০০ ফুট চওড়া। অন্যটির নাম ব্রাইডর ভেইল ফলস।

নায়াগ্রা নদী, লেক ইরি এবং লেক ওন্টারিও থেকে আসা পানি মিলে এক বিশাল জলপ্রপাতের সৃষ্টি করে। নায়াগ্রা এই জলের খেলা যে কেবল সৌন্দর্যের রং ছড়ায় তা নয় বরং নায়াগ্রার জলের স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। প্রতি মিনিটে নায়াগ্রা জলপ্রপাত ৬০ লাখ ঘনফুটের বেশি জল প্রবাহিত করে। যার গড় পরিমাণ হলো ৪০ লাখ ঘনফুট। নায়াগ্রা সমগ্র নিউইয়র্ক এবং ওন্টারিওর জলবিদ্যুৎ শক্তির এক অন্যতম প্রধান উৎস। অন্যান্য জলপ্রপাতের চেয়ে নায়াগ্রার স্রোত অনেক বেশি।

নায়াগ্রা জলপ্রপাতের স্রোতের শব্দ এতটাই তীব্র যে অন্য কোনো শব্দ কানে পৌঁছায় না। আমেরিকা হতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতটি পেছন থেকে দেখতে হয়। কানাডায় সরাসরি সামনে থেকে সম্পূর্ণ জলপ্রপাত ভালোভাবে দেখা যায়। রংধনু দেখতে আকাশের দিকে তাকাতে হয় না এখানে। মুগ্ধ পর্যটকের দৃষ্টির খুব কাছেই জলপ্রপাতের জলরাশিতে রংধনু যেন নিজে এসে ধরা দেয়। অষ্টাদশ শতক থেকে এটি পর্যটন এলাকা হিসেবে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। এখানে প্রতিবছর প্রায় ৩০ মিলিয়ন পর্যটক আসেন। এই মনোরম ও প্রাণবন্ত জলপ্রপাতটি পরিদর্শনের উপযুক্ত সময় হলো বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল। জলপ্রপাতের পাশাপাশি এখানে পর্যটকেরা ঘুরে দেখতে পারেন নায়াগ্রা অ্যাকোরিয়াম, নায়াগ্রা সায়েন্স মিউজিয়াম, ওয়ার্লপুল স্টেট পার্ক, ডেভিল’স হোল স্টেট পার্ক, নায়াগ্রা অ্যাডভেঞ্চার থিয়েটার ও হাইড পার্কে।

পৃথিবীতে ভ্রমণ পিপাসু সকল প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের কাছে নায়াগ্রা জলপ্রপাতটি একটি রোমাঞ্চকর স্থান। সবচেয়ে বড় চমক ছিল রাতের লাইট শো ও আতশবাজি। নদীর মাঝ থেকে ফলসের গায়ে মুহুর্মুহু আলো ফেলে অপার্থিব এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে যা নিজ চোখ না দেখলে বর্ণনা করা খুব কঠিন! পরিবেশ বান্ধব প্রাকৃতিক গ্যাসে চালিত জাহাজে চড়ে খুব কাছ থেকে দেখা নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সৌন্দর্য চোখে লেগে থাকবে বহুদিন।

জলপ্রপাতের কাছাকাছি ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা অনন্য কেননা দূর্বল হার্টের মানুষকে সাহসী করে ফেলবে এটা অনায়াসে বলা যায়। জলপ্রপাতের দিকে তাকালে একদিকে যেমন ভয়ে আপনার বুক কেঁপে উঠবে তেমনি কিছুতেই এর মোহময় আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। এই আকর্ষণই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষকে নিয়মিত টেনে আনে এখানে।

‘মেড অব দ্য মিস্ট’ নামের বোটটি জলপ্রপাতের পাড়ে সর্বদা অপেক্ষমান থাকে পর্যটকদের নায়াগ্রার অপার সৌন্দর্যের আরও নিকটে নিয়ে যাবার জন্য। এখানে জলপ্রপাতের পানি পতনের কলকল গর্জন কানে মধুর সংগীতের মতো বাজে। সব মিলিয়ে জলপ্রপাতটি বিস্ময় আর রোমাঞ্চের এক অপরূপ সৌন্দর্যের সম্ভার। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণ হৃদয়ে গাঁথা থাকবে আজীবন।

ফরিদা নাসরিন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com