২০১৯ সাল। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন পটুয়াখালীর দুই বন্ধু ইমাম হোসেন ও রুম্পা আক্তার। দুজনই তখন পটুয়াখালীতে ছিলেন। এরই মধ্যে এল রুম্পা আক্তারের জন্মদিন, কিন্তু পটুয়াখালী শহর ঘুরে কোনো ভালো কেক পেলেন না ইমাম হোসেন। জন্মদিন কেক ছাড়াই উদ্যাপন করলেন তাঁরা। তবে মন খারাপও ছিল নিজ এলাকায় একটা কেক পাওয়া গেল না।
ফিরে এলেন ঢাকায়। তখন তাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। ইমাম হোসেন ২০১৮ সালে এইচএসসি পাস করেন পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে আর রুম্পা একই বছর এইচএসসি উত্তীর্ণ হন পটুয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজ থেকে। একদিন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একটা কেকের দোকান দেখেন তাঁরা। কথা বললেন, জানলেন কীভাবে কেক তৈরি করেন, কীভাবে আনেন। তখন থেকে দুই বন্ধুর উদ্যোগ শুরু। নিজেদের কেক তৈরির একটি প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন ‘সফট বাইট’। লোগোও তৈরি করলেন। খুলে ফেললেন একটি ফেসবুক পেজ। শুরু হলো তাঁদের এফ-কর্মাস ব্যবসা। তারপর এগিয়ে চলা। ভার্চ্যুয়াল জগৎ থেকে সফট বাইট এল বাস্তবে। এখন সফট বাইটের চারটা দোকান। প্রতি মাসে সফট বাইটের কেক বিক্রি হয় ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকার। ওদিকে ইমাম হোসেন ও রুম্পা আক্তার—সদ্য স্নাতক দুই বন্ধুর বয়সই এখন ২৪ বছর।
ইমাম হোসেন সফট বাইটের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আর তাঁর বন্ধু রুম্পা আক্তার সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট হেড। এই দুজনের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে কেক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সফট বাইট। সফট বাইটের যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে। আজ এই ব্যবসা দাঁড়িয়ে আছে ৪টি শাখা, ৩৫ জন কর্মী ও ১টি করপোরেট অফিস নিয়ে। চারটি শাখার দুটি পটুয়াখালী ও দুটি বরগুনা জেলায়।
যাত্রার শুরুটা সহজ ছিল না। পটুয়াখালীতে ভালো মানের কোনো কেক পাওয়া যেত না। সেই অভাববোধ থেকে ইমাম হোসেন ও রুম্পা আক্তারের এই উদ্যোগ নেন। ইমাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সহপ্রতিষ্ঠাতা রুম্পার জন্মদিন ছিল। ভাবলাম কেক কাটার আয়োজন করব। কিন্তু পটুয়াখালীর কোথাও ভালো কোনো কেক পেলাম না। তখনই ভাবলাম, এ শহরে ভালো কেকের ব্যবস্থা করা দরকার। ঢাকায় ফিরে নিজেই উদ্যোগ নিই।’
শুরুতে একটি ফেসবুক পেজ, একটি লোগো আর সামান্য পুঁজি দিয়ে পটুয়াখালীতে কেক পাঠানো শুরু করেন ইমাম হোসেন। ঢাকা থেকে লঞ্চে কেক পাঠিয়ে স্থানীয়ভাবে বিপণন চালাতেন। এটিই ছিল সফট বাইটের প্রথম পদক্ষেপ। পাশাপাশি ফেসবুকের মাধ্যমে বেচাকেনা তো চলছিল। এখনো চলছে।
কিন্তু হঠাৎ শুরু হয় কোভিড-১৯ মহামারি। সফট বাইটের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া অর্থ ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ প্রক্রিয়া, ব্র্যান্ডিং, বিপণন, লোকবল ব্যবস্থাপনা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল নানা চ্যালেঞ্জ। ইমাম হোসেন বলেন, ‘আমরা ভর্তি হয়েছিলাম ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিভাগে। এই বিভাগ থেকে পাওয়া জ্ঞান ও সহায়তা কাজে লাগিয়ে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পেরেছি। নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছি, শিফট সিস্টেম ও রিপোর্টিং টাইম ঠিক করে লোকবল ব্যবস্থাপনার সমস্যাও সমাধান করেছি।’
ইমাম হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ থেকে যে সহযোগিতা পেয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। মো. সবুর খানসহ অন্য সব শিক্ষকের কাছ থেকে মেন্টরশিপ, বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ইনভেস্টমেন্ট অফার, নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট, অর্থায়ন, বাস্তব শিক্ষা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন—এসব আমাদের অনেকটাই এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।’
রুম্পা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছি, সেটি আমাদের একটা ব্র্যান্ড দাঁড় করাতে ব্যাপকভাবে কাজে লেগেছে। আসলে এখন যে অবস্থা, আমরা কোনো চাকরির আশায় বসেছিলাম না। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেরাই একটা কিছু করব, সেই স্বপ্ন আর চেষ্টাতেই সফট বাইট গড়ে উঠেছে। আমার পরিবারও খুশি, কারণ, তাঁদের মেয়ের সঙ্গে ৩৫ জন কর্মসংস্থানে সুযোগ পেয়েছে।’
২০২৬ সালের মধ্যে দেশের সব বিভাগীয় শহরে সফট বাইটের আউটলেট খোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। শুধু দেশেই নয়, একদিন বিশ্বজুড়ে সফট বাইটকে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন ইমাম হোসেন। তাঁর কথায়, ‘আমাদের স্বপ্ন, সফট বাইট একদিন এমন একটি ব্র্যান্ড হবে, যা শুধু দেশেই নয়, পৃথিবীজুড়ে সমাদৃত হবে। আমার মৃত্যুর শত বছর পরও এই ব্র্যান্ডের নাম থাকবে মানুষের মুখে মুখে।’
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে ইমাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু একটা শুরু করুন। উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পথ চলতে চলতেই শিখবেন। মনে রাখবেন, “নেটওয়ার্কিং ইজ ইওর নেন ওয়র্থ”। তাই যোগাযোগ বাড়ান। সেই সঙ্গে বলব, কখনো বই পড়া বাদ দেবেন না। এটি আপনার মস্তিষ্কের খাবার। জন্মের একটি দাগ রেখে যেতে হবে এই পৃথিবীতে। নিজেকে এমনভাবে তৈরি করুন, যাতে পৃথিবীর সেরাদের তালিকায় নাম থাকে।’