শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:০১ অপরাহ্ন

দুনিয়া কাঁপিয়ে দেওয়া ডিপসিকের রহস্যময় প্রতিষ্ঠাতা কে এই লিয়াং ওয়েনফেং

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫

নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মডেল ডিপসিক বাজারে এনে চীনের উদ্ভাবনী শক্তিকে দমিয়ে রাখার কয়েক বছরের মার্কিন নীতিকে রীতিমতো ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে এক অখ্যাত, অজানা চীনা প্রতিষ্ঠান। বাজারে এসেই এনভিডিয়া থেকে শুরু করে সিমেন্স এনার্জি-র মতো কোম্পানির বাজারমূল্যে ধস নামিয়ে দিয়েছে ডিপসিক। এনভিডিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ এআই চিপ প্রস্তুতকারক, আর সিমেন্স এনার্জি ডেটা সেন্টারে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদনকারী।

ডিপসিক দেখিয়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়েও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন করা সম্ভব। ফলে এআই মডেলকে প্রশিক্ষণ দিতে সর্বাধুনিক সেমিকন্ডাক্টর ও সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামের সহজলভ্যতা আসলে কতটা জরুরি, তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

এই সাড়া জাগানো ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন লিয়াং ওয়েনফেং—ডিপসিকের ৪০ বছর বয়সি প্রতিষ্ঠাতা। তার কর্মকাণ্ডে বিশ্ববাজারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, সেটি তিনি কতটা উপভোগ করছেন, তা ঠিক জানা যায়নি।

সাবেক এক সহপাঠী স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, লিয়াং এখন চান্দ্র নববর্ষ উপলক্ষে নিজ শহরে আত্মগোপনে আছেন। ২৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই উৎসবে তিনি জনসমক্ষে আসছেন না। শুকনো-রোগা গড়ন আর ফ্যাকাশে চেহারার জন্য চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে রসিকতা চলে। বেশিরভাগ মানুষের কাছেই তিনি এক রহস্যময় ব্যক্তি।

ডিপসিকের সঙ্গে কাজ করেছেন—এমন অনেকে বলেন, লিয়াং মূলত মানুষের মতো চিন্তাশক্তিসম্পন্ন আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স (এজিআই) এবং পৃথিবীতে এর প্রভাব নিয়ে কাজ করতে খুব পছন্দ করেন। তার এই কাজ করতে গিয়ে ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা শুধু চীন নয়, পশ্চিমা বিশ্বেও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ধারণাকে নাড়িয়ে দিচ্ছেন।

লিয়াং সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জানা যায়। তার জন্ম ১৯৮৫ সালে জন্ম, গুয়াংদং প্রদেশের ঝানজিয়াং শহরের অনতিদূরের এক দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামে। তার পরিবার শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিল। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। একজন সাবেক শিক্ষক বলেছেন, মাধ্যমিক স্কুলে থাকার সময়ই লিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গণিত রপ্ত করে ফেলেছিলেন।

২০০২ সালে তিনি চীনের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রনিক তথ্যপ্রযুক্তির ওপর পড়াশোনার সুযোগ পান। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন স্বনামধন্য মেশিন-ভিশন বিজ্ঞানীর অধীনে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন, যা তাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে নিয়ে আসে।

সে সময় হাংজু শহর ইন্টারনেট প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হচ্ছিল। এখানেই ছিল আলিবাবা-র মতো উঠতি প্রতিষ্ঠানগুলো। লিয়াং ও তার কয়েকজন সহপাঠী এই শহরে থেকে যান এবং কোয়ান্টিটেটিভ ইনভেস্ট মডেল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এই মডেল বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোম্পানির মৌলিক বিশ্লেষণের চেয়ে ডেটার ওপর বেশি নির্ভর করে।

নিজেদের তৈরি ট্রেডিং মডেলকে বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টায় ২০১৩ সালে লিয়াং ও তার তিনজন সহপাঠী মিলে ইয়াকেবি নামে একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান চালু করেন।

দুই বছর পর লিয়াং ওয়েনফেং আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন কোয়ান্টিটেটিভ হেজ-ফান্ড হাই-ফ্লায়ার। চীনের বাজার উন্মুক্ত হওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত বিকশিত হয়। তখন চীনের বাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শিথিলতা ও অস্থিরতা ছিল তুঙ্গে; সেই সুযোগে এমন অনেক ফার্ম গড়ে ওঠে।

২০২১ সালে হাই-ফ্লায়ার দাবি করেছিল, তারা ১০০ বিলিয়ন ইউয়ান (১৪ বিলিয়ন ডলার) মূল্যের সম্পদ পরিচালনা করছে। তবে ওই বছরের শেষার্ধে প্রতিষ্ঠানটির আকার দ্রুত সংকুচিত হয়ে পড়ে।

চীনের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কোয়ান্ট ফান্ডগুলোর সম্পর্ক বরাবরই টানাপোড়েনের। নিয়ন্ত্রকেরা মনে করে, এই ফান্ডগুলো বাজারের পতনকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করে। শিল্পসংশ্লিষ্টদের দাবি, হাই-ফ্লায়ার ছিল সবচেয়ে আগ্রাসী কোয়ান্ট ফান্ডগুলোর একটি। প্রতিষ্ঠানটি প্রায়ই চীনের সিকিউরিটি নিয়ন্ত্রকদের বিরাগভাজন হতো।

ডিপসিকের জন্ম হাই-ফ্লায়ারের অ্যালগরিদম উন্নত করার প্রচেষ্টা থেকে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ২০০ মিলিয়ন ইউয়ান বিনিয়োগ করে ‘ফায়ার-ফ্লায়ার ১’ নামে একটি স্বতন্ত্র ইউনিট গড়ে তোলে। এর লক্ষ্য ছিল নিজস্ব ডিপ-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।

এরপর ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরি করতে আরও ১ বিলিয়ন ইউয়ান বিনিয়োগ করে। ওই সংস্করণে যুক্ত করা হয় এনভিডিয়ার ১০,০০০ এ১০০ গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট। এ সময় চীনে এত বড় আকারের শক্তিশালী চিপের মজুত ছিল মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠানের হাতে—সবকটিই আলিবাবার মতো টেক জায়ান্ট।

২০২৩ সালে ডিপসিক স্বতন্ত্র কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ডিপসিক বাজারে প্রথম বড় ধাক্কা দেয় গত বছরের মে মাসে, অত্যন্ত সস্তা মূল্যের চ্যাটবট বাজারে এনে। ওই চ্যাটবট তাদের ভি২ মডেলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এর ফলে চীনের এআই শিল্পে মূল্যযুদ্ধ শুরু হয়। আলিবাবা, বাইদু, বাইটড্যান্স, টেনসেন্ট—দেশের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের এআই পণ্যের দাম কমাতে বাধ্য হয়।

তবে লিয়াংয়ের দাবি অনুসারে, এটি স্রেফ বাজার দখলের কৌশল ছিল না। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে তিনি বলেন, ডিপসিক মূলত নতুন মডেলের কাঠামো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর ফলে তাদের ব্যয় কমে গেছে—এ বৈশিষ্ট্যই অন্যদের থেকে তাদের আলাদা করেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী চীনা এআই কোম্পানিগুলোও নতুন মডেল নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি বিধিনিষেধের কারণে তাদের কম্পিউটিং শক্তির ঘাটতি রয়েছে। ফলে তারা বিদ্যমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে বুদ্ধিদীপ্ত অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। অনেক চীনা এআই কোম্পানি মেটার তৈরি লামা ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের ওপর ভিত্তি করে তাদের অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেছে।

লিয়াং ওয়েনফেং জন্য কম কম্পিউটিং শক্তি ব্যবহার করে উন্নত মডেল তৈরি করা শুধু একটি কৌশল নয়, বরং তার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের জন্য অপরিহার্য ধাপ। তিনি স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য এজিআই। এটি অর্জন করতে হলে আমাদের নতুন মডেলের কাঠামো নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে, যাতে সীমিত সম্পদের মধ্যেই উচ্চতর দক্ষতা অর্জন করা যায়।’

পশ্চিমা প্রযুক্তি দুনিয়া কাঁপিয়ে দেয়া ডিপসিকের নতুন আর১ মডেল ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাদের সত্যিই অগ্রগতি হচ্ছে। কোম্পানিটির দাবি, ৬০ লাখ ডলারেরও কম খরচে একে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে—যা ওপেনএআইয়ে মতো প্রতিষ্ঠানের মডেলগুলোর তুলনায় নগণ্য।

ওপেনএআইয়ের প্রধান স্যাম অল্টম্যান আর১-কে ‘দারুণ’ বলে প্রশংসা করেছেন। যদিও তিনি বলেছেন, তারা ‘আরও উন্নত মডেল’ আনছেন। আর নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়া সত্যিই ‘অনুপ্রেরণাদায়ক’।

তবে ডিপসিকের অর্জন নিয়ে সংশয়ও আছে। প্রাথমিক পরীক্ষানিরীক্ষা বলছে, আর১ সত্যিই শক্তিশালী। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ সন্দেহ করছেন, প্রতিষ্ঠানটি হয়তো আসলে প্রচুর উচ্চমানের চিপ ব্যবহার করেছে, যা তারা প্রকাশ করেনি। অন্যদিকে অনেকে মনে করেন, ডিপসিকের দাবি সত্যিও হতে পারে।

আরেকটি বিতর্ক হচ্ছে, ডিপসিক ‘ডিস্টিলেশন’ পদ্ধতিতে মার্কিন এআই মডেলগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করে নিজের মডেল উন্নত করছে কি না। ওপেনএআইয়ের দাবি, তাদের কাছে এমন প্রমাণ আছে যে ডিপসিক ডিস্টিলেশন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, যা ওপেনএআইয়ের পরিষেবা শর্তাবলির লঙ্ঘন।

তবে ডিপসিক যদি সত্যিই এত দক্ষ হয়, তাহলে এটি শুধু আমেরিকার প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নয়, বরং চীনের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত উদ্ভাবন মডেলের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ।

চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম অবশ্য ডিপসিককে ‘জাতীয় সম্পদ’ বলে অভিহিত করছে। ডিপসিককে চীনের এআই নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার অস্ত্র হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ২০ জানুয়ারি অন্যান্য শীর্ষ উদ্যোক্তাদের সঙ্গে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে দেখা করার আমন্ত্রণ পান লিয়াং।

তবে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান পিনপয়েন্ট অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ঝাং ঝিওয়েই বলেন, ডিপসিকের সাফল্য চীনের অসংখ্য রাষ্ট্রীয় অনুদানপ্রাপ্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি থেকে আসেনি। ডিপসিকের বেশিরভাগ শেয়ার লিয়াংয়ের হাতেই। রাষ্ট্রীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল শিল্প থেকে দূরে থেকেছেন তিনি।

লিয়াং মনে করেন, গত ৩০ বছর ধরে চীন পশ্চিমা প্রযুক্তির ‘অনুসরণকারী’ ছিল, যারা শুধু পশ্চিমের তৈরি ভিত্তির ওপর নিজেদের প্রযুক্তি গড়ে তুলেছে। স্থানীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে মৌলিক উদ্ভাবন বনাম অনুকরণ’। তার মতে, এনভিডিয়ার সাফল্য কেবল তাদের নিজেদের দক্ষতায় ভর করে আসেনি, বরং এটি ছিল পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর পারস্পরিক প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ফল।

লিয়াং মনে করেন, পশ্চিমা কম্পিউটিং ক্ষমতাকে অনুকরণের চেষ্টা করে চীন সফল হয়নি। কারণ তারা এই ধরনের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারেনি, যদিও সরকার বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। ডিপসিকের উত্থান কেবল পশ্চিমাদের জন্য নয়, বরং বেইজিংয়ের নেতাদের জন্যও সতর্কবার্তা।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com