‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মতো আপনিও দু-দণ্ড শান্তি পেতে বনলতা সেনের নাটোরে ঘুরে বেড়াতে পারেন। ইতিহাস আর ঐতিহ্যে ভরপুর এই জেলাকে বলা হয় ‘রাজসিক নাটোর’।
এখানে আছে অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানি ভবানীর রাজবাড়ি, উত্তরা গণভবনখ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি, চৌগ্রাম জমিদারবাড়িসহ অনেক প্রাচীন স্থাপনা। এ ছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি চলনবিল ও মিনি কক্সবাজারখ্যাত হালতি বিল তো আছেই। আধুনিক স্থাপত্যে সাজানো হয়েছে এই জেলার লালপুরের গ্রিন ভ্যালি পার্ক।
নাটোরকে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বলা হয়। তাই দেশের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সব দিক থেকেই সড়ক ও রেলপথে নাটোরে প্রবেশ করা যায়। এ ছাড়া আকাশপথে রাজশাহীতে এসে এক ঘণ্টা সড়কপথে নাটোরে যাওয়া যায়।
রানি ভবানীর রাজবাড়ি
শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে-পশ্চিমে নাটোর রাজবাড়ির অবস্থান। পরিখাবেষ্টিত এই রাজবাড়ি রানি ভবানীর রাজবাড়ি নামেও পরিচিত। বাংলার সুবেদার মুর্শিদকুলী খানের শাসনামলে নাটোর রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। কালক্রমে এটি প্রাসাদ, দিঘি, মন্দির, উদ্যান ও মনোরম অট্টালিকা দিয়ে সুসজ্জিত নগরীতে পরিণত হয়।
নাটোর রাজবংশ বড় তরফ ও ছোট তরফে বিভক্ত হওয়ায় রাজপ্রাসাদও ভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করে। দুই তরফের মাঝে প্রশস্ত উদ্যান। উদ্যানের উত্তর–পশ্চিম অংশে বড় তরফের এবং দক্ষিণ–পশ্চিমে ছোট তরফের রাজপ্রাসাদ। পোড়ামাটির টেরাকোটায় মোড়ানো প্রাসাদের মেঝেতে এখনো শ্বেতপাথরের উপস্থিতি রাজবংশের আভিজাত্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দুই তরফের জন্য আলাদা আলাদা মন্দির, পুকুর, কাছারি ও গাছপালা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তবে পরিচর্যার অভাবে ও বয়সের ভারে রাজবাড়ির প্রতিটি স্থাপনার ভঙ্গুর দশা চোখে পড়ে। প্রবেশমূল্য দিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে থাকা রাজবাড়িটি দর্শন করা যাবে অনায়াসে। নির্ধারিত ফি দিয়ে এখানে বনভোজন করার সুব্যবস্থা আছে।
নাটোর শহরতলি থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে দিঘাপতিয়ায় উত্তরা গণভবনের অবস্থান। ১৭৩৪ সালে দিঘাপতিয়ার দেওয়ান দয়ারাম রায় দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালের শক্তিশালী ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। পরে রাজা প্রমদানাথ রায় ওই বছরই আবার রাজপ্রাসাদটি সংস্কারের কাজে হাত দেন। ১১ বছর ধরে দেশ-বিদেশের নানা ধরনের নির্মাণ উপকরণ ও গাছপালা দিয়ে রাজপ্রাসাদটি অপরূপ সাজে সজ্জিত করা হয়। চারদিকে চড়া সীমানাপ্রাচীর ও পরিখা দ্বারা বেষ্টিত করে রাজপ্রাসাদটি সুরক্ষিত করা হয়।
রাজবাড়ির প্রবেশপথের দৃষ্টিনন্দন মূল ফটক যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। ফটকের মাঝখানে ওপরে একটি বিশাল আকৃতির ঘড়ি আছে, যা ভেতর ও বাহির থেকে দৃশ্যমান। সচল রাখতে সপ্তাহে একবার চাবি দিতে হয়। ঘড়ি থেকে উচ্চ স্বরের ঘণ্টাধ্বনি আশপাশের মানুষকে সময়ের জানান দেয়। রাজবাড়ির ভেতরে ঢোকার সময় চোখ জুড়িয়ে যাবে দেশি–বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ ফুল, ফলের গাছ ও বর্ণিল আয়োজন দেখে।
চলনবিল ও হালতি বিল
দুটি আলাদা নাম হলেও মূলত পুরোটা মিলেই চলনবিল। দেশের অন্য সব বিলের পানি স্থির থাকলেও বর্ষায় এখানকার পানি প্রবহমান থাকে। বর্ষা ও শুকনা মৌসুমে বিল দুটি আলাদা সৌন্দর্য ধারণ করে। বর্ষায় বিশাল জলরাশির মাঝে ছোট ছোট গ্রামগুলো দ্বীপের মতো মনে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকা নিয়ে ঘুরলেও বিলের সীমানা যেন শেষ হয় না। ঘুরে বেড়ানোর সময় মাথার ওপর দিয়ে অসংখ্য পাখির ওড়াউড়ি ও নৌকার শব্দে পানি থেকে ছোট ছোট মাছের লাফালাফি যে কাউকে মুগ্ধ করবে। বর্ষার পানি কমতে শুরু করলে দুই বিলের মাঝের ডুবোসড়কগুলো জেগে ওঠে। এ সময় অনেকে ডুবন্ত সড়কে হেঁটে বা মোটরসাইকেল চালিয়ে ঠান্ডা পানির স্পর্শ নেন। হালতি বিলের পুরো অংশ জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার মধ্যে। দর্শনার্থীরা শহর থেকে সড়কপথে ৭ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে হালতি বিল তীরবর্তী পাটুল গ্রামে যান। সেখান থেকে নৌকায় করে ঘুরে বেড়ান।
ঔষধি গ্রাম
সদর উপজেলার খোলাবাড়িয়া গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ঔষধি গাছের চাষাবাদ হয়। গাছগাছড়া বিক্রির জন্য গ্রামের মোড়ে মোড়ে রয়েছে পাইকারি আড়ত। বাস-ট্রাকে করে গাছগাছড়া প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। কাগুজে নাম খোলাবাড়িয়া হলেও গ্রামটি এখন ঔষধি গ্রাম নামেই অধিক পরিচিত। শুধু দর্শনার্থী না, দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থীরাও ভেষজ চিকিৎসার ধারণা নিতে এই গ্রামে আসেন। ঘৃতকুমারী, অশ্বগন্ধা, দাউদমূল, শতমূল, পাথরকুচি, মিছরিদানা, কালোমেঘ, বাসক, তুলসী, হরীতকী, ধুতরা, অর্জুন, যষ্টিমধু, বহেরা, লজ্জাবতী, হিমসাগর, দুধরাজ, রক্তচন্দন, উলটকম্বল, পুদিনাসহ সাড়ে চার শ প্রজাতির ভেষজ গাছের চাষ হয় এই গ্রামে।
বিনোদনকেন্দ্র গ্রিন ভ্যালি পার্ক
জেলার লালপুর থানা ভবন থেকে দুই কিলোমিটার উত্তর–পশ্চিমে লালপুর-আব্দুলপুর সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে গ্রিন ভ্যালি পার্ক। প্রায় ১২০ বিঘা জমিতে গড়ে ওঠা এই রিসোর্টে আকর্ষণীয় রাইড, সুইমিংপুল, শুটিং স্পট, পিকনিক স্পট, কৃত্রিম ঝরনা ও স্পিডবোট কর্নার গড়ে তোলা হয়েছে।