 
							
							 
                    পৃথিবীর ভাসমান শহরের তালিকার শীর্ষে যে শহরের নাম উঠে আসে সেটি হলো ভেনিস। নান্দনিক সৌন্দর্যের ঐতিহাসিক এক নগরী হলো ভেনিস। ইতালির এ শহরটির মতো নান্দনিক শহর পৃথিবীতে খুব কমই আছে। পুরো শহরটির বুক চিরে বয়ে গেছে স্বচ্ছ জলের প্রবাহ। পরিষ্কার জলের এই লেকগুলো এতটাই স্বচ্ছ যে, গা ঘেঁষে মাথা উঁচু করে থাকা দালানগুলোর প্রতিবিম্ব আর আকাশে ছুটে চলা মেঘ যেন নেমে এসেছে পানিতে।
বলা যায়, ইউরোপের সবচেয়ে রোমান্টিক শহর এটি। ভেনিস ভেনেতো অঞ্চলে আড্রিয়াটিক সাগরের ওপর অবস্থিত একটি প্রধান বন্দর এবং একটি জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র।
১১৮ টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত ভেনিস, যেখানে রাস্তার বদলে আছে অসংখ্য খাল। খালগুলো ছোট বড় নানা আকারের ৪০০ টি ব্রিজ দিয়ে সংযুক্ত। খালে চলাচলের জন্য ভেনিসবাসীরা গণ্ডোলা নামের এক ধরণের এক-বৈঠাওয়ালা নৌকা ব্যবহার করে। ভেনিস ছাড়াও ভেনেতো অঞ্চলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে আছে ভেরোনা, পাদুয়া এবং ত্রিয়েস্তে।
মিলান-লোমবার্ডিয়া রাস্তার পাশে মে মাসে ফুটে থাকে রক্তাক্ত পপি। ছোট মফস্বলীয় একটি স্টেশন থেকে প্রায় ৪০ মিনিটের যাত্রা ভেনিসের মূল স্টেশন ভেনিস সান্তা লুগিয়ায়। ট্রেনে ওঠার পর প্রথম প্রথম সাধারণ দৃশ্যমালা। ছোট ছোট কটেজ বাড়ি, আঙ্গুর ক্ষেত, রেল লাইনের দুই পাশে পপি আর গোলাপের সারি। ঝকঝকে নীল আকাশ। এ রকমই প্রায় পুরোটা পথ।
দেখতে দেখতে হঠাৎই রাস্তার দু’পাশে দৃশ্যগুলো বদলে যায়। বছর দশেক আগে ঢাকা থেকে সাভার যাওয়ার পথে যেমন দেখা যেত তেমনি দিগন্তবিস্তৃত পানি আর মাঝমধ্যে উঁকি দেয়া কিছু বাড়িঘর। সারা বছরই যেন বন্যা। হুবহু প্রায় সে রকম এলাকা। বিস্তীর্ণ জলাজমি, সমুদ্রের অংশ। একটা কেমন যেন সমুদ্রের ঘ্রাণও পাওয়া যায়। অনেক বড় একটা প্রায় প্রাগৈতিহাসিক ব্রিজের উপর দিয়ে পার হয় ট্রেন। পাশ দিয়েই চলে বিলাসবহুল বাস।
ব্রিজ পেরোলেই ভেনিসের মূল স্টেশন। রেলগাড়ির ঘষা কাঁচ, স্টেশনে বিখ্যাত ফুটবলার মালদিনির মত চেহারার ফিটফাট পুলিশ। কিছুই নজর এড়ায় না। চোখ খোঁজে পনিটেলের ব্যাজ্জিও। সুন্দর মানুষ, সুন্দর প্রকৃতির ভুবন যেন ভেনিস। সারা বিশ্বের মানুষের পরম আগ্রহের শহরই বটে। কারো কাছে শেকস্পিয়ারের ভেনিস, পোর্শিয়া আন্তনিও বা শাইলকের ভেনিস আর দূর সমুদ্রে জাহাজ ভাসিয়ে বাণিজ্যে যাওয়া সওদাগরের শহর ভেনিস।
পানির মধ্যে একটা শহর! সেই শহরের মূল স্টেশন থেকে বাইরে আসতেই দেখা যায় লোকে লোকারণ্য। অলিগলি, দোকান, বাজার আর পুরনো আদি অকৃত্রিম ছাঁচে যতেœর সাথে রেখে দেয়া গায়ে গা লাগানো বাড়িঘর। আর একটা-দু’টো সারি বাড়ির পরই কাকচক্ষু জলের খাল।
সমুদ্র থেকে সরাসরি এসে ভেনিস শহর এফোঁড়-ওফোঁড় করে মিলেছে আবার সমুদ্রে। এ রকম কয়েকশো খাল বা ক্রিকের ফাঁকে ফাঁকেই গড়ে উঠেছে কিংবদন্তির ভেনিস। রাস্তার ধারে রং-বেরঙের ফলের দোকান বা ভাসমান মুখোশের টং, জমজমাট ওয়ান স্টপ পিৎজা শপ থেকে বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্ট, সবখানেই অনেক লোকের পদচারণা। সারা বিশ্ব থেকে টুরিস্ট আসে ভেনিস দেখতে আর বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসী মানুষও কম নয়।
শহরের একটি এক জায়গার নাম পিয়াৎসা সান্তা মার্কো বা সেন্ট মার্কস স্কয়ার। চারদিকে অনেক পুরনো অভিজাত প্রাসাদের মত দেখতে বাড়িঘর। একটু দূরে একটা বনেদি গির্জা। পুরো চত্বর ছুটি কাটানো মানুষের হই-হট্টগোলে মুখর। এর থেকে কিছুটা দূরে এগিয়ে গেলেই সমুদ্র, উদার। ঘাটে বাঁধা একেকটা গন্ডোলা একাই দোলে ঢেউয়ের তালে।
মাঝ দরিয়ার ভেতর কিছু একলা বসতবাড়ি। অনেকেই থাকে দূরে পানির ভেতর ওইসব ঘরে। আকাশ থেকে পানি পড়ে, পায়ের নিচে পানি, নিঃসঙ্গ ওই বসতিদেরও আজব জীবন।
ভেনিস মেস্ত্রেতে মাইলের পর মাইল লোক নাই, জন নাই। হঠাৎ পথের ধারে একলা একটা রেস্টুরেন্ট। মনে হয় কোন সুদূর থেকে হঠাৎ মাথা তুলে বের হয়েছে। উঠোনজুড়ে ঝরাপাতার দল। অদ্ভুত গাঢ় সবুজ রঙের ধান আর গমের ক্ষেত প্রায় পুরোটা মেস্ত্রে জুড়েই। বরফ গলার পর থেকে আবার বরফ পড়া পর্যন্ত যেটুকু সময় পাওয়া যায় তার মধ্যে তিনটা ফসল উঠবে। ধানগাছ বা গমগাছ তাই সময় পায় খুব কম। চোখের সামনে ধেই ধেই করে বড় হয়ে ওঠে।
এই রকম একটা দিগন্তজোড়া ধানের ক্ষেতের কাছে, কুয়ার্তো ডি আলতিনো নামে ছোট্ট একটা রেল স্টেশনের পাশে হাতে গোনা কয়েকটা ভিলা নিয়ে একটা লোকালয়। প্রায় সবগুলো বাড়িই খালি থাকে বেশি সময়। বেশিরভাগই শহুরে লোকের ছুটি কাটানোর ঠিকানা।
ভেনিসে পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেশি। মূলত ভেনিসের আয় দিয়ে অঞ্চলটির খরচ মেটানো হয়। পৃথিবীর সকল দেশ থেকে শহরটি দেখতে আসেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ভেনিসের ইতিহাস বলে, জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য এখানে প্রবাসীরা বসতি গড়ে তোলে। পরে লোক সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং পানির ওপর গড়ে উঠে এ শহর। সবশেষ জরিপ অনুযায়ী ভেনিসের লোকসংখ্যা ২ লাখ ৬৫ হাজার। এখানে বিভিন্ন ধরনের রেস্টুরেন্ট এবং নানা ধরনের স্যুভেনিরের দোকানগুলো আকর্ষণ করে পর্যটকদের।