সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:৪০ অপরাহ্ন

সিকিম : স্বর্গের হাতছানি

  • আপডেট সময় রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৫

নেপালি ভাষায় ‘নতুন প্রাসাদ’, তিব্বতীদের মতে ‘ধ্যানের দেশ’ এবং লেপচারা যাকে ‘স্বর্গ’ বলে সেই সিকিমই হলো ভারতের বাইশতম রাজ্য। তিনদিকে নেপাল, তিব্বত এবং ভুটানের সীমান্ত ছোঁওয়া এই স্বর্গরাজ্যটি পশ্চিমবঙ্গের ঠিক শীর্ষদেশে যেন রত্নখচিত উজ্জ্বল মুকুটের মতই শোভা পাচ্ছে। আর সেই মুকুটের মধ্যমণি যে হীরকখণ্ডটি জ্যোর্তিময়ী প্রভায় সমগ্র রাজ্যটিকে আলোকিত করে কাথে সে হলো কাঞ্চনজঙ্ঘা। বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম এই শৃঙ্গটির অপূর্ব শোভা বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করলেও সিকিমিসদের কাছে এর তাৎপর্য আরো অনেক গভীরে। পর্বতের দেবতা, কাঞ্চনজঙ্ঘা তাদের বিপদ-আপদে রক্ষাকর্তাও বটে।

গ্যাংটক সিকিমের রাজধানী যেখানে ৫০ বছর আগেও মানুষ যাওয়ার কথা খুব একটা ভাবতে পারত না। তবে এখন দু-দশ দিনের ছুটি জোগাড় হলেই ভ্রমণপিপাসু মানুষ সিকিমে যাবার চেষ্টা করে। দুর্গাপুজোর সময় এই বেরিয়ে পড়ার জন্য একটা বিরাট তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। হাওড়া-শিয়ালদা স্টেশন থেকে এই সময় বেশ কিছু ‘পুজো স্পেশাল’ ট্রেনেরও ব্যবস্থা থাকে। অনেকে আবার বাসে করেও সিকিম যান।

আমরা পুজোর ছুটিতে শিলিগুড়ি থেকে বাসে প্রথমে কালিম্পং যাই। সেখান থেকে সোজা গ্যাংটক।  সকাল সাড়ে ছ’টায় যখন বাস ছাড়ল, শিলিগুড়ি শহর তখন সদ্য ঘুম থেকে জেগে উঠছে। সেবক রোড ধরে বাস ছুটছে। বস্তুত এই বাসগুলোর জন্যই সিকিম আজ আমাদের ঘরের পাশেই মনে হয়। এক সময়ে যা বহু দূরের দেশ হয়ে হাতছানি দিত। শিলিগুড়ি ছাড়াও দার্জিলিং এবং কালিম্পং থেকেও সিকিম যাওয়ার বাস পাওয়া যায়।

জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। বাস চলেছে জলপাইগুড়ির ভেতর দিয়ে। যতদূর দৃষ্টি যায় দু-পাশে দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগান। যেন গাঢ় সবুজের গালিচা পাতা। সমতল ছেড়ে বাস এঁকে বেঁকে পাহাড়ী পথে উঠছে। জায়গার নাম কোথাও পাঁপড়খোতি কোথাও বা গরুবাথান। পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে ধানের চাষ। চেনা অচেনা নানা ফুলের গাছ। চারপাশে শরতের ঝকঝকে সোনালী রোদ। যে কোনও সবুজ পাহাড়ী অঞ্চলে গেলে একটা জিনিস লক্ষ করা যায়— সবুজ রঙের বৈচিত্র্য। কোথাও হাল্কা কচি কলাপাতা, কোথাও গাঢ় সবুজ, কোথাও বা শ্যাওলা কিংবা কালচে সবুজ, আবার কোথাও টায়া সবুজ। মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজ হাতে রং তুলি নিয়ে বিশাল এক ক্যানভাসে সবুজ রক্ষের খেলায় মেতেছে। তিস্তা অনেকক্ষণ আমাদের সঙ্গী হয়ে চলেছে।

এখন অবশ্য সে আমাদের থেকে বহু নীচে। তবে বাঁক ঘুরলেই তার ফেনিল নীল জলরাশির দুরন্ত উচ্ছ্বাস দেখে মুগ্ধ হয়েছি। রাস্তা ক্রমেই ওপরে উঠছে। দুপাশের পাহাড় ঘন সবুজ বনে ঢাকা। এখানে পাহাড়ের গায়ে বেশ বসতি রয়েছে। রাস্তায় ছেলে মেয়ে দেখে অবশ্য বোঝা গেল না তারা নেপালি না লেপচা। পাহাড়ী অঞ্চলে এই এক মুশকিল, সবাইকে একই রকম মনে হয়। রাস্তার দুপাশে দোকান বাজার সুন্দর সব কাঠের বাড়ি ছাড়িয়ে বাস গোঁ গোঁ শব্দে উঠে যাচ্ছে আকাশের কাছাকাছি। আমাদের বাস যেন মেঘেদের রাজ্যে ক্রমাগত হানা দিয়ে চলেছে। কোথাও গড়িয়ে গড়িয়া তারা নেমে যাচ্ছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, কোথাও গুঁড়ি মেরে উঠে আসছে পাহাড়ের চুড়োর দিকে। বাস্তবিকই দেখে মনে হচ্ছিল — ‘এখানে মেঘ গাভির মত চরে।’

মাইলস্টোন দেখে বুঝলাম আমরা কালিম্পঙের কাছাকাছি। সূর্য তখন মধ্যগগনে। দূর থেকে শহরের ঘর-বাড়ি দেখা যাচ্ছে। শহরে ঢোকার আগে ছবির মত সুন্দর সব কাঠের বাড়ি দেখছিলাম। পর্দা ঢাকা কাঁচের জানলা। জানালার ফ্রেমে অসাধারণ সব কারুকাজ। প্রতিটি বাড়িতেই কিছু না কিছু ফুলের গাছ। বাস যখন শঙরে ঢুকল তখন অবশ্য দেখলাম, কাঠের বদলে কংক্রেটের বাড়িই সেখানে বেশি। বিশেষ করে শহরের একদম মাঝখানে হোটেল, রেস্তরাঁ, দোকানপত্র সবই প্রায় কংক্রিটের এবং বেশ ঘিঞ্জিও বটে। বাস গিয়ে থামতেই ট্যাক্সি চালকদের মধ্যে দারুণ এক ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। সবাই ‘গ্যাংটক’ বলে চেঁচালেও তাদের ভাড়া শুনে চক্ষু-চড়ক গাছ।

দূরে দূরে পাহাড়ের গায়ে যেন দেওয়ালির আলোকসজ্জা।

বেলা আড়াইটে নাগাদ আমরা জিপ গাড়ি করে কালিম্পং ছেড়ে রওনা দিলাম। গ্যাংটকের হোটেলে ঢুকে ফ্রেস হয়ে সন্ধেবেলা যখন বাইরে বেরলাম, শহরটি তখন আলোয় ঝলমল করছে। দূরে দূরে পাহাড়ের গায়ে যেন দেওয়ালির আলোকসজ্জা। অক্টোবর শেষ হলেও শীত তখনও আসর জাঁকিয়ে বসেনি। উজ্জ্বল রঙীন পোশাকে সিকিমি ছেলেমেয়েরা ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। উচ্ছ্বল তারুণ্যের সুন্দর মুখগুলি দেখে মুহূর্তে আমাদের পথের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। এককথায় ছোট্ট সুন্দর ওই পাহাড়ি শহরটি আমাদের এক নজরেই মন জয় করে নিল।

সিকিম বোঝহয় ভারতের ক্ষুদ্রতম অঙ্গরাজ্য, যার আয়তন মাত্র দু-হাজার আটশ আঠারো স্কোয়ার মাইল এবং আশ্চর্যের বিষয় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই সমগ্র অঞ্চলের উচ্চতা কোথাও আট শ’ ফুট কোথাও আটাশ হাজার ফুট। গ্যাংটকের উচ্চতা পাঁচ হাজার আটাশ ফুট। সিকিমে যারা বাস করেন তারাই সিকিমি। সিকিমি বলতে কোনও বিশেষ ভাষাভাষী জাতিকে বোঝায় না। এক সময়ে লেপচারাই ছিল সিকিমের প্রধান অধিবাসী। আজ থেকে বহু আগে, সম্ভবত ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তারা আসাম থেকে সিকিমে গিয়েছিল। মূলত অরণ্য-সম্পদ শিকার এবং অল্প কিছু ভুট্টা বা মকাই চাষের ওপর লেপচাদের জীবন নির্ভরশীল ছিল। ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লেপচারাও ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু জাতিতে পরিণত হলো। বর্তমানে সিকিমে ষাট শতাংশ লোকই নেপালি।

গ্যাংটক শহর থেকে একটু নীচে দেওরালীর হোটেলে আমাদের অস্থায়ী আস্তানা হয়েছিল। পুজোর সময়ে কোনও পাহাড়ি অঞ্চলে বেড়াতে গেলেই বাঙালিরা ঠকঠকে জমে যাওয়া শীতের কল্পনায় গরম পোশাকের গন্ধমাদন পিঠে নিয়ে বেরোয়। অথচ সদ্ব্যবহারের অভাবে বহু পোশাকই ব্যাগের ভেতরে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। শীতকালে গ্যাংটক যদিও খুব ঠাণ্ডা হয়, তবু এবারে তখনও তেমন শীত না পড়ায় আমার তো একটা হাতকাটা সোয়েটার এবং কম্বলেই শীত কাটছিল।

সিকিমে বেশ কিছু দ্রষ্টব্য স্থান থাকলেও আমার গ্যাংটকের আশপাশ ছেড়ে বেশিদূর এগোতে পারিনি। খারাপ এবং অনিশ্চিত আবহাওয়ার জন্য গ্যাংটকে আমরা তিন-চার দিন থাকতে পেরেছিলাম। যে কোনও সময় ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছিল সব সময়েই। প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে সিকিম যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি প্রাচীন সব মনাস্টারিগুলো সিকিমকে অন্য এক মর্যাদা দিয়েছে। আমরা প্রথমেই ট্যুরিস্ট অফিসে খোঁজ নিতে গেলাম। শুনলাম কয়েক মিনিটের মধ্যেই রূমটেক মনস্টারির উদ্দেশ্যে ট্যুরিস্ট বাস ছাড়ছে। আমরা তৎক্ষনাৎ টিকিট কেটে দৌড়ালাম। গ্যাংটক থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরত্বে রূমটেক মনাস্টারি। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের বাস ছাড়ল।

সুন্দর পাহাড়ি পথ। বাস কখনও পাহাড়ের পাদদেশে কখনও চূড়োয়। অজস্র পাহাড়ি ঝোরা নাচতে নাচতে নেমে গেছে রাণীখোলা নদীতে। রাণীপুল তাডং পেরিয়ে বাস চলেছে। রাস্তার বাঁক ঘুরলেই সুন্দর রঙীন কাঠের বাড়ি, নাকি স্বপ্নের বাড়ি চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। কোথাও জানালায় দাঁড়ানো পাহাড়ি আয়ার সুন্দর হাসিমুখ যেন ফ্রেমে বাঁধান স্থির চিত্র। পাহাড়ের গায়ে অজস্র ফুল ফুটে আছে। কোথাও বা ক্যাকটাসের সমারোহ। সিকিমের মত এত সবুজ পাহাড় খুব কমই আছে কাছেপিঠে। যদিও বেশ কিছুদিন ধরেই এখানেও বন কাটা হচ্ছে।

মনাস্টারি শুনলেই তার প্রাচীনত্ব সম্পর্কেই আমাদের প্রথম কৌতূহল জাগে। রূমটেক অবশ্য সেদিক থেকে নবীনতম। ওখানকার লামার মুখে শুনেছিলাম এই রূমটেকের বয়স সবে একশো পার করেছে। গাঢ় নীল আকাশের নীচে রং-রূপে, শিল্প-স্থাপত্যে রূমটেক যেন এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। শিয়ালগুয়া কারমাপা তিব্বতী মনাস্টারির অনুকরণে এই রুমটেক তৈরি করেছেন। আমরা যখন রূমটের পৌঁছলাম সেখানে তখন দ্বিপ্রহারিক আহারের ব্যস্ততা চলেছে। তোরণ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই বিশাল বাঁধান চত্বর। চারপাশে সারি দিয়ে অজস্র কুঠরি। ওইগুলোই লামাদের বাসস্থান। দেখলাম একদিকে কুঠরির সামনের বারান্দা থেকে লামাদের দুপুরের মাংস-ভাত পরিবেশন কথা হচ্ছে। মুণ্ডিত মস্তক, লালচে পোশাকে প্রচুর খুদে লামাদের দেখলাম।

বাইরের ঝকঝকে রোদের আলো ছেড়ে মূল প্রকোষ্ঠে ঢুকতেই প্রথম চোখে অন্ধকার দেখলাম। পরে চোখ সয়ে গেলে লক্ষ করলাম বুদ্ধের প্রধান মূর্তির পাশে অসংখ্য ছোট ছোট বুদ্ধের মূর্তি। মূর্তিগুলির সামনে লাইন দিয়ে ল্যাম্প জ্বলছে। আলোর অভাবে দেওয়ালচিত্রগুলো খুবই অস্পষ্ট। একদিকে বিশাল ড্রামের মত বাদ্যযন্ত্র। উপাসনা এবং পুঁথিপড়ার জন্য বসার আসন এবং সামনে জলচৌকির মত রয়েছে। প্রকোষ্ঠের বাইরের দেওয়ালচিত্রগুলি অবশ্য উজ্জ্বল রঙে ভাস্বর হয়ে আছে। এখানে অন্তত দুশো লামা আছেন। প্রধান উৎসব হয় জানুয়ারি মাসে। অনেকক্ষণ থেকেই বাসের ক্রমাগত হর্ন আমাদের তাড়া লাগাচ্ছিল। ভাল করে দেখাশোনার আগেই বেরিয়ে আসতে হলো। তোরণের বাইরে এসে দেখি আমাদের বাসের ড্রাইভার দ্রুত হাতে ধর্মচক্রগুলি ঘুরিয়ে চলেছেন। যদিও তিনি লেপচা খ্রিস্টান। কিন্তু পূর্বপুরুষ নিশ্চয়ই এক সময়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাই মনে হয় সনাতন বিশ্বাস থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি।

রূমটেক থেকে আমাদের বাস গিয়ে পৌঁছল অর্কেডরিয়ামে। গ্যাংটক থেকে প্রায় চোদ্দ কিলোমিটার দূরত্বে। সিকিমকে ট্রেকিং-এর স্বর্গরাজ্য বলা হয়। আমার মনে হয় তাকে অর্কিডেরও স্বর্গরাজ্য বলা যেতে পারে। অন্তত ছ-শ রকমের অর্কিড আছে। বেশ কিছু ধরনের ক্যাকটাসও দেখা যায়। সারা বছরের বিভিন্ন সময়ে অর্কিডের ফুল ফোটে। তবে এপ্রিল-মে সব থেকে ভালো সময়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও ফুল ফোটে। অর্কিডরিয়ামে গিয়ে ক্যাকটাস এবং অর্কিডের ঘরগুলি ঘুরে দেখলাম। প্রতিটির গায়ে নাম লেখা থাকলেও আমার মতো অনভিজ্ঞের পক্ষে তাদের পরিচয় জানা সম্ভব হলো না। কোনও কোনও অর্কিডের অসাধারণ সুন্দর ফুলও দেখলাম। অর্কিড ক্যকটাস ছাড়াও অন্যান্য ফুল ও ফলের গাছ রয়েছে বহু। বোটানিক্‌সের ছাত্রছাত্রীদের কাছে এটা নিঃসন্দেহে তীর্থস্থান। বিশাল এলাকা নিয়ে এই অর্কিডরিয়ামটিকে বনবিভাগ তত্ত্বাবধান করে।

শেষ দুপুরে আমরা গ্যাংটক শহরে ফিরে এলাম। গ্যাংটকের রেস্তরাঁগুলোতে চীনে খাবার ভালো পাওয়া যায়। স্বাদে অসাধারণ। আমরা যে সময় গ্যাংটকে, সে সময় সর্বত্রই একটা উৎসবের মেজাজ চলছিল। নেপালিদের দশেরা উৎসবের জন্য অফিস আদালতও বন্ধ ছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে এই ছোট্ট শহরটি কিন্তু একদা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আগে তুমলুঙে ছিল সিকিমের রাজধানী। পরে সেটি স্থানান্তরিত হয়ে আসে গ্যাংটকে।

১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতের লাসা থেকে একজন রেড হ্যাট লামা দুজন সঙ্গী নিয়ে সিকিমে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধধর্ম প্রচার এবং ধর্মান্তরকরণ। ওই লামাই পেন্চু নামগিয়েলকে সিকিমের প্রথম রাজা হিসেবে ওই সালেই অধিষ্ঠিত করেন এবং ওই ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দ থেকে সিকিমের রাজনৈতিক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। যতদূর জানা যায়, ওই প্রথম রাজা সিকিমে বারো বছর রাজত্ব করেছিলেন। চতুর্থ রাজা চোগিয়েল গিয়ারমার সময়ে ভুটানিরা সিকিম আক্রমণ করে। ষষ্ঠ রাজা তেনজিং নামগিয়েল অবশ্য ১৭৮০ সালে পূর্বদিকে ভুটানী এবং পশ্চিমের গুর্খা আক্রমণকে প্রতিহত করেছিলেন। সময়ে নেপালের ‘ইলাম’, তিব্বতের ‘চাম্বি’ এবং ভুটানের ‘হা’ উপত্যকা সিকিম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

অবশ্য সিকিমের অনেক ভূখণ্ড ভুটানের কাছে হারাতে হয়েছিল। ষষ্ঠ রাজার উত্তরাধিকার সুংফু নামগিয়েল প্রথম ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নেপাল থেকে গুর্খাদের ক্রমাগত হানাদারিকে বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮১৪ সালে শেষ পর্যন্ত এক শক্তিশালী বাহিনী পাঠিয়ে গুর্খাদের বিতাড়িত করে। সিকিম নেপাল সীমান্তও ওই সময় ব্রিটিশরাই নির্ধারিত করে দেয়। বন্ধুত্বের স্বরূপ হিসেবে সিকিমের রাজা ১৮৩৫ সালে তৎকালীন ভারতীয় গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংককে দার্জিলিং উপহার দেন। রঙ্গিত নদীর দক্ষিণে ওই বিশাল অঞ্চল ব্রিটিশ শাসনাধীনে চলে আসে। এর পরিবর্তে সিকিমকে বছরে তিন হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে। তবে এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। একটি বিশেষ ঘটনায় ব্রিটিশ সরকার সিকিমের ওপর বিরক্ত হয় এবং গ্যাংটকে পাকাপাকিভাবে একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধি থাকার চুক্তিও তারা করে ফেলে সিকিমের সঙ্গে। ১৯৬১ সালে সিকিমে প্রথম ভোটের সময় সরকার গঠিত হয়। বর্তমানে অবশ্য সিকিম আর কোন আলাদা দেশ নয়। ভারতেরই বাইশতম অঙ্গরাজ্য। গ্যাংটক শহরের মাথায় রাজপ্রাসাদ আজও বর্তমান।

দেওরালীর একদম নীচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রোরুচু (নদী)। একদিন সকালে তার উদ্দেশে পাহাড়ের গা বেয়ে নামা শুরু করলাম। গড়গড়িয়ে নেমে যাবার মতো কোনও রাস্তা নেই। লোকজনদের জিজ্ঞেস করে চোরবাটো ধরে নামতে হয়। মনে তখন অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। ধানের ক্ষেত, কমলালেবুর বাগান পিরিয়ে ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে নেমে চলেছি। বাড়িগুলোতে শুয়োর, মুরগি কিছু না কিছু চোখে পড়ছে। পাহাড়টা বেশ খাড়া বলে নামতেই বেশ পরিশ্রম হচ্ছিল। বহু উঁচু থেকে যাকে কেবল নীল সাদা বঙ্কিম এক রেখা মনে হয়েছিল, কাছে গিয়ে দেখি সে রীতিমত খরস্রোতা। নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে প্রবল উচ্ছ্বাসে ছুটে চলেছে। ওপরের নীল আকাশও তার দুরন্ত প্রবাহে গা ভাসিয়ে গতিশীল হয়ে উঠেছে। আমাদের পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া লোকদের দেখি, রোরুচুর ব্রিজ পেরিয়ে ওপাসের আরো সবুজ পাহাড়ি গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। গাছপালার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের শরীর।

‘জলই জীবন’ এ সত্যের উপলব্ধি হয় যখন বুকে হেঁটে কোনও পাহাড়ে উঠতে হয়। আমাদের কাঠের মত শুকনো গলা ভিজিয়ে নেবার জন্য একটা বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরের ভেতর থেকে গান বাজনার মিষ্টি সুর বাইরেও শোনা যাচ্ছে। একজন মহিলাকে দেখে জল চাইতে ঘরের ভেতর থেকে পুরুষকণ্ঠ পরিষ্কার বাংলায় — আসুন ভেতরে আসুন বলে অভ্যর্থনা করল। একটু অবাক হয়েছিলাম। কারণ সিকিমে হিন্দি, ইংরেজি, নেপালি এবং তিব্বতী মোটামুটি এই ভাষাতেই সবাই কথা বলে। কণ্ঠস্বরের মালিক দলসিং গুরুং আসলে বহুকাল পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন। সুন্দরবনে বেশ কিছুদিন চাকরি করেছেন। আমাদের আপ্যায়ন করে খাওয়ালের ছাঙের সরবৎ। সিকিমিরা খুবই অতিথিপরায়ণ হয়। গ্যাংটকে থাকাকালীন তাদের উষ্ণ সহৃদয় ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটেছিল আমাদের।

সিকিমের বেশ কিছু জায়গা ইয়ালি, পাংথাং, নামনাম, বরদাং, রাবং গভীর বনাঞ্চল। তবে নামচি জেলার রাবং বনই নাকি সব থেকে বড়। সাল, সেগুন, বাঁশ ছাড়াও আরো নানা ধরনের গাছ সেই সব অরণ্যকে নিবিড় করে রাখে। চিতা, ভালুক, বুনো শুয়োর, কয়েক জাতের হরিণ, সম্বর বিচরণ করে সেই সব অরণ্যভূমিতে। প্রায় একশো রকমের পাখি ও প্রজাপতি আছে। পাহাড়ি নদীগুলোতেও মাছের অভাব নেই। আর এপ্রিলের শেষ থেকে অগাস্ট পর্যন্ত পাহাড়ে পাহাড়ে রোডোডেনড্রনের রঙের খেলা। এক সময় সিকিম খুবই অরণ্যসমৃদ্ধ ছিল। আর অবশ্য সর্বত্র কুঠারের শব্দ শোনা যায়। যেদিন থেকে সিকিমের রাজনৈতিক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেদিন থেকেই তার প্রধান অধিবাসী লেপচাদের কপালে ঘনিয়ে এসেছিল দুর্ভাগ্য। ভুটিয়া এবং নেপালি আগন্তুকদের চাপে তারা ক্রমশই জমি জায়গা হারিয়ে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছিল। সেই থেকেই আগন্তুকরা বনাঞ্চল কেটে ধান চাষের জন্য জমি তৈরি শুরু করেছিল।

পাহাড়ে পাহাড়ে রোডোডেনড্রনের রঙের খেলা।

দেওয়ালী থেকে একটা রাস্তা নেমে গেছে নীচের দিকে আর একটা উঠেছে পাহাড়ের চূড়োর দিকে। সেই দিকে কিছুটা উঠে গেলেই রিসার্চ ইনস্টিট্যুট অফ টিবেটোলজি। মহাযান বৌদ্ধধর্মের ওপর তিব্বতি বইয়ের তৃতীয় বৃহত্তম সংগ্রহশালাটি বিশ্ববিখ্যাত। এখানে এই ধর্মের বিরল সব টঙ্কা (স্ক্রোল), প্রায় দুশোটি মূর্তি এবং শিল্পকলার নানা নিদর্শন রয়েছে। এই ইনস্টিট্যুটে পড়াশোনার জন্য বিশ্বের সব জায়গা থেকে বৌদ্ধ পণ্ডিতরা আসেন।

গ্যাংটক শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বে পাহাড়ের মাথায় এনচে মনাস্টারি, ডিয়ার পার্ক। সেক্রেটারিয়েটের পাশ দিয়ে একটু ঘুর পথে আমরা এনচেতে উঠেছিলাম। ডিয়ার পার্কে বেশ কয়েক রকমের হরিণ দেখলাম। পার্কের আশেপাশে দুই বিশাল দেহী ভালুক, পাণ্ডা, সুন্দর দর্শন হাঁস, মুরগি, রঙিন মাছ সব মিলিয়ে মিনি চিড়িয়াখানা। আরচারপাশে অজস্র ফুলের বাগান। ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, অজস্র মরসুমী ফুল। বাগানের মাঝখানে ধ্যানগম্ভীর বুদ্ধের কালো পাথরের মূর্তি। সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা রাজপ্রাসাদের সামনে গিয়ে পোঁছলাম। প্রাসাদের গেটে পাহারাদার। এই প্রাসাদের সামনের রাস্তা থেকেই এনচে মনাস্টারির চূড়োটি দেখা যায়। সর্টকাটের জন্য আমরা আবার মূল রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে লাগলাম। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবলই পাহাড়শ্রেণী আর সবুজ উপত্যকা।

ট্যুরিস্ট লজের পাশ কাটিয়ে একসময় এনচের তোরণের সামনে পৌঁছলাম। তোরণ পেরিয়ে গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা রাস্তা দিয়ে এনচের বাঁধানো চত্বরে গিয়ে হাজির হলাম। রাস্তার দুপাশে গাছে বাঁধা রঙিন প্রেয়ার ফ্ল্যাগগুলো হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। সিকিমে মনাস্টারি ছাড়াও রাস্তাঘাটে প্রচুর এই ধর্মীয় পতাকা হাওয়ায় উড়তে দেখেছি। এনচে মনাস্টারিটি মহাযান ধর্মের নিঙ্গমাপা শাখার অন্তর্গত। আপাতদৃষ্টিতে সব মনাস্টারিকে একরকম মনে হলেও খুঁটিয়ে লক্ষ করলে বৈসাদৃশ্য চোখে পড়ে। আসলে স্থাপত্য এবং দেওয়াল চিত্রের বিষয়বস্তু ও রঙের ব্যবহার সাদৃশ্যই ওই রকম মনে হবার কারণ। সিঁড়ির কয়েকটি ধাপ উঠে মূল প্রকোষ্ঠে ঢুকতে গেলেই দর্শককে একটু থমকে দাঁড়াতে হবে। দরজার দুপাশে ভয়ঙ্করদর্শন চারজনের দেওয়ালচিত্র। এমনিতে আমরা যারা বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে ততখানি অন্তরঙ্গ নই, তাদের পক্ষে ওইসব দেওয়ালচিত্রের অর্থ উদ্ধার করা অসম্ভব। কোথাও কোথাও হয়ত অনুমান করা যায় মাত্র।

পরে জেনেছিলাম ওই চারজন আসলে স্বর্গের কোনও রাজা। টাইটান এবং অন্যান্য অপদেবতার হাত থেকে স্বর্গ ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে রক্ষা করার জন্য তাঁরা সশস্ত্র প্রহরারত। ঘরের ভেতরের ফ্রেসকোগুলি মহাযান ধর্মে নানা দেবদেবী বজ্রপানি, তারা, অবলোকিতেশ্বরের। গুরু পদ্মসম্ভব, অতীশ দীপঙ্ক, বুদ্ধের নানা মূর্তি এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু ও অপদেবতাদের ফ্রেসকোতে দেওয়ালগুলি অলঙ্কৃত। সঙ্গমের প্রচুর দেওয়ার চিত্র লক্ষ্য করলাম। এখানের লামাদের সংখ্যাও একশোর অধিক। সিকিমের অষ্টম রাজা সিদকেয়ং নামগিয়েল আঠারশ চল্লিশ খ্রিস্টাব্দে এই এনচে মনাস্টারিটি তৈরি করেন। এখানে প্রধান উৎসব হয় ডিসেম্বরে। জাঁকজমকপূর্ণ সেই উৎসব কয়েকদিন ধরে চলে। উৎসবে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বাঁশি এবং ড্রামই প্রাধান্য পায়। এই ‘ছাম’ উৎসবে লামাদের মুখোশ নাচ খুবই দর্শনীয় বিষয়। প্রসঙ্গত, সিকিমের তৃতীয় রাজা চাগদোর নামগিয়েল সিকিমে প্রথম মুখোশ নাচের প্রবর্তন করেছিলেন। সেই ট্র্যাডিশন আজও বর্তমান।

এনচে থেকে যখন গ্যাংটক শহরের পথ ধরেছি তখন বিদায়ী সূর্যের লালিমায় সারা আকাশ লাল। কাঞ্চনজঙ্ঘা অবশ্য মেঘের রাজ্যে হারিয়ে গেছে। গ্যাংটক শহরটি ছোট বলে পায়ে হেঁটে কয়েক ঘণ্টাতেই মোটামুটি দেখে নেওয়া যায়। শহরে অসংখ্য দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ, নতুন পুরনো বাজার, লালবাজার, সিনেমা হল, ব্যাঙ্ক, লাইব্রেরি, হাসপাতাল, অফিসারস ক্লাব, হোয়াইট হল, কটেজ ইন্ডাস্ট্রি এই সবই রয়েছে। সিকিমি যুবক-যুবতীদের দেখলাম আধুনিক বেশভূষায় সজ্জিত। মেয়েরা অবশ্য ট্র্যাডিশনাল পোশাকও ব্যবহার করে দেখলাম। তবে ছেলেরা পুরোপুরি আধুনিক পোশাকের দিকে। শহরের কেন্দ্রবিন্দু থেকে পুরনো বাজারের দিকে একটু নেমে গেলে বেশ প্রাচীন একটা গন্ধ পাওয়া যায়। শহরের কেন্দ্রে আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্টের দোকানে ঢুকলে সিকিমের কুটিরশিল্পের একটা পরিচয় পাওয়া যায়। কার্পেট ছাড়াও অসাধারণ সব এমব্রয়ডারি, যেগুলোকে আঁকা ছবি বা ফটোগ্রাফি বলে ভুল হয়। রূপোর অলঙ্কার, বাঁশ, কাছ, ধাতুর নানা জিনিস, স্ক্রোল এবং অসাধারণ সব ছবি নিয়ে দোকানগুলো যেন এক একটা রত্নখনি।

সেদিন গ্যাংটক শহর পেছনে ফেলে দেওরালীর দিকে এগিয়ে চলেছি। অনেক আগেই সন্ধে নেমেছে। আকাশ জুড়ে সাদা মেঘেরা ক্রমে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। পরেরদিন আমাদের ফিরে যেতে হবে। মন কিছুটা ভারাক্রান্ত। ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দূর থেকে গ্যাংটকের আলোগুলোকে সেদিন আর আলোক-সজ্জা মনে হচ্ছিল না। আকাশ ক্রমেই মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কনকনে হাওয়া বইতে শুরু করেছে তখন। আমরাও দ্রুত পা চালিয়ে দেওরালীতে পোঁছে গেলাম।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com