মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইটের ভাড়া বেড়েছে কয়েক গুণ। এতে কর্মস্থলে ফিরতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের। অন্যদিকে পর্যটন মৌসুমকে কেন্দ্র করে বাড়তি ভ্রমণের সুযোগ নিয়ে আকাশপথের ভাড়া এখন আকাশচুম্বী।
পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকার পতন ও নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদেশযাত্রায় অনেকটাই ভাটা পড়ে।
তবে শীতে পর্যটন মৌসুমেও বেড়েছে টিকিটের চাহিদা। এই সুযোগে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম।
এমন পরিস্থিতিতে টিকিটের দাম সহনীয় রাখতে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশও (আটাব) উড়োজাহাজভাড়া সহনীয় রাখার অনুরোধ জানিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল।
পরে মন্ত্রণালয় থেকে আবার ভাড়া সহনীয় রাখতে এয়ারলাইনসগুলোকে নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বেবিচককে চিঠি দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রোকসিন্দা ফারহানা গত ১২ ডিসেম্বর ওই চিঠি পাঠান। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বেবিচক এই চিঠি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন আটাবের সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ।
কোন কোন গন্তব্যে ভাড়া বেড়েছে জানতে চাইলে আটাবের সভাপতি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেশি বেড়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাড়া বেড়েছে জেদ্দা, মদিনা, রিয়াদ ও দাম্মাম রুটে। এসব গন্তব্যে ভাড়া বাড়লে সংশ্লিষ্ট অন্য গন্তব্যগুলোতেও এয়ারলাইনসগুলো ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। সামগ্রিকভাবে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘উড়োজাহাজগুলোর টিকিটের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। দুই মাস আগেও যে টিকিটের দাম ছিল ৪০ হাজার টাকা, সেটি এখন বেড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা হয়েছে।
দাম বাড়লে ৫ থেকে ৭ শতাংশ বাড়তে পারে। কিন্তু অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে। এতে যাত্রীরা জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন রুটে টিকিটের স্বল্পতাও আছে। কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এ জন্য আমরা বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিলাম। পরে মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন বিমান সংস্থাকে বেবিচকের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেবিচক এয়ারলাইনসগুলোকে চিঠি দিয়েছে।’
আব্দুস সালাম আরেফ বলেন, দেশি এয়ারলাইনসগুলোরও ভাড়া কমানো উচিত। পাশাপাশি ফ্লাইট ক্যাপাসিটি বাড়ানো উচিত। ৫ আগস্টের পরে যাত্রী কমে যাওয়ায় ফ্লাইটের সংখ্যাও কমানো হয়েছে। তখন কমানো ফ্লাইটগুলো পরে আর বাড়িয়ে সমন্বয় করা হয়নি। ক্যাপাসিটি বাড়লে টিকিটও সহজলভ্য হবে, দামও কমবে।
বেবিচকের চিঠি দেওয়ার পর ভাড়া কমেছে কি না জানতে চাইলে আটাবের সভাপতি বলেন, তারা এটা মানছে না। তারা ভাড়া সহজে কমায় না। যখন ফ্লাইট বাড়ানো হয়, যাত্রী কম থাকে, তখন ভাড়া এমনিতেই কমে আসে। এ ছাড়া পিক সিজনে ভাড়া কমানোর নজির শুধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসেই আছে। বতর্মান সমস্যা নিরসনে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এতে যাত্রীর চাপ কমার সঙ্গে ভাড়াও কমে আসবে। কিন্তু এখন তো ফ্লাইটেরই সংকট। এই পরিস্থিতি যাত্রীদের জন্য মোটেও সুখকর নয়
এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করা বিদেশি ২৪টি এয়ারলাইনসকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠিটি পাঠান বেবিচকের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি রেগুলেশনস ও ইন্সপেকশন অথরাইজেশন) গ্রুপ ক্যাপ্টেন আহসান হাবীব।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে উড়োজাহাজের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে প্রায়ই জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে বছরের যে সময়ে যাত্রীদের যাতায়াত বৃদ্ধি পায়, সে সময়ে বিমানভাড়া বাড়ানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আমরা এয়ারলাইনসগুলোর পরিচালন ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। অধিকন্তু এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির সমৃদ্ধির স্বার্থে এবং যাত্রীদের ভ্রমণে আরো বেশি উৎসাহিত করতে উড়োজাহাজভাড়া বাড়ানোর প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ।’
চিঠিতে বলা হয়, উড়োজাহাজের ভাড়া ভ্রমণকারীদের সাধ্যের মধ্যে রাখাটা তাদের যেমন স্বস্তি ও আস্থা দেবে, সেই সঙ্গে টেকসই এভিয়েশন খাত গড়ে উঠতে সাহায্য করবে এবং এতে আকাশপথে ভ্রমণ আরও বাড়বে। এজন্য এয়ারলাইন্সগুলোকে তাদের ভাড়ার তালিকা পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।
সম্প্রতি ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন আরো ২৭ হাজার ৮২০ টাকা কমিয়ে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা বিমানভাড়া নির্ধারণ করতে আধাসরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা প্রয়াত এ এফ হাসান আরিফকে।
পত্রে খালিদ হোসেন বলেন, বিমানভাড়া কমানো হলে বাংলাদেশের হজ কোটা পূরণ সহজ হবে। সৌদি সরকারের কাছে দেশের সম্মান বৃদ্ধি পাবে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসও বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদ উল আলম বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কোনো কর্তৃপক্ষ ভাড়া কমানোর কথা বলতে পারে না। যখন চাহিদা অনেক বেড়ে যায় তখন ভাড়া বাড়ে। আর যখন চাহিদা কমে যায় তখন ভাড়াও কমে যায়। এটাই বৈশ্বিক নিয়ম। প্রতিটি এয়ারলাইনস তাদের নিয়ম-কানুন মেনে ভাড়া নির্ধারণ করে। বেবিচকের চিঠি কোনো ফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি না। কোনো এয়ারলাইনসই ভাড়ার ব্যাপারে কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে দায়বদ্ধ নয়। তারা দায়বদ্ধ নিয়ম-কানুন, ফ্লাইট অপারেশনস, নিরাপত্তা—এসব ক্ষেত্রে।’
তিনি বলেন, ট্যাক্স বাড়িয়ে দিলে ভাড়া কমবে না। ডলারের উচ্চমূল্যের কারণেও ভাড়া বেড়েছে। ভাড়া কমাতে হলে জনগণের স্বার্থে কর কমাতে হবে, আরো বেশি এয়ারলাইনসকে ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ দিতে হবে।