মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:০২ পূর্বাহ্ন

থার্ড টার্মিনালে মেগা দুর্নীতি

  • আপডেট সময় সোমবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৫

অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পে। গত সরকারের আমলে যে টার্মিনাল চালুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘যোগাযোগের নতুন যুগের সূচনা হবে’ বলা হচ্ছিল তার ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে ৭ হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয় কীভাবে ২২ হাজার কোটি টাকা হলো? প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কমপক্ষে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে এই মেগা প্রকল্পে।

জানা গেছে, টার্মিনালের টেকসই কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ, এই প্রকল্পে ঘুস ছাড়া কোনো ফাইলে স্বাক্ষর করেন না প্রকল্প পরিচালক। তাকে ঘুস দিতে হয় ডলারে এবং দেশের বাইরে। এসব নিয়ে ইতোমধ্যে জাপানি ঠিকাদারের সঙ্গে প্রকল্প পরিচালকের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন কাজও বন্ধ ছিল। প্রকল্প পরিচালক স্বাক্ষর না করায় এবং সরকারি ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধ না করায় অর্ধশত গুরুত্বপূর্ণ ইকুইপমেন্ট দীর্ঘদিন চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শুল্ক বন্দরে আটকা ছিল। এখনো অনেক পণ্য আটকা আছে। কাস্টমস থেকে বারবার এসব পণ্যের ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) পাঠানো হলেও তিনি রেসপন্স না করায় পণ্যগুলো ছাড় করতে বেঘাত ঘটছে। এতে কোটি কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি ও জরিমানা দিতে হয়েছে।

শুরুর দিকে প্রকল্প পরিচালকসহ সিন্ডিকেটের সহায়তায় চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা নিম্নমানের প্রায় ২০-২৫টি পণ্য ফেরত পাঠানো হয়। পরে ওই পণ্যগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হয়। এতে প্রকল্প পরিচালকসহ সিন্ডিকেটের কমিশন বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষুব্ধ হয়ে প্রকল্প পরিচালক দীর্ঘদিন এসব পণ্য বন্দর থেকে ছাড় করেননি। এমনকি ইউরোপীয় মানের হওয়ায় পণ্যগুলোর দামে যে ভেরিয়েশন হয়েছিল সেটির অনুমোদনও আটকে রাখেন তিনি। যার কারণে প্রকল্পের ঠিকাদার এডিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার চরম দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

জানা গেছে, প্রকল্পের জন্য পাথর কেনা হয়েছে সিলেট থেকে কিন্তু ইতালি থেকে ক্রয় দেখিয়ে সে পাথরের ইন্সফেকশন করতে প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইতালি ভ্রমণের অভিযোগ আছে। এছাড়া ১৮শ স্কয়ার ফুট টাইলসের মান দেখতেও বিদেশ ভ্রমণের অভিযোগ আছে প্রকল্প পরিচালকসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে। প্রকল্পের কেনাকাটা নিয়ে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। শুরুর দিকে দক্ষিণ কোরিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য নিম্নমানের ইকুইপমেন্ট ও পণ্য কেনা হয়েছিল। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নজরে আসার পর এসব পণ্যের মান যাচাই করা হয়। এতে বেশির ভাগ পণ্য ও ইকুইপমেন্ট নিম্নমানের প্রমাণ হওয়ায় সেগুলো সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে খোদ তৎকালীন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান সে সময়  বলেছিলেন, থার্ড টার্মিনালের প্রতিটি পণ্যের মান ও গ্রেড স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সুইচ, বাল্বসহ বেশ কিছু মানহীন বৈদ্যুতিক পণ্য আনা হয়েছিল। এগুলো যাচাই-বাছাই করার পর দেখা গেছে সব নিম্নমানের। এ কারণে সব ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এছাড়া একটি গ্রুপ নানাভাবে চেষ্টা করেছে টার্মিনাল ভবনের লিফট, স্কেলেটর, বডিং ব্রিজ, সাবস্টেশন, রাডারসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইটেম কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশ থেকে আনার। আমরা বলে দিয়েছি ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ডের বাইরে কোনো পণ্য আনা হলে সেগুলো ফেরত পাঠানো হবে।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফ  বলেন, থার্ড টার্মিনালের অস্বাভাবিক ব্যয় খতিয়ে দেখা হবে। প্রকল্পের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দ্রুত থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পসহ বেবিচকে সংস্কার করা হবে বলেও তিনি জানান।

নকশা পরিবর্তন করে টাকা লোপাট : থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়েছে নকশা পরিবর্তন করে। এতে প্রায় ৭১১ কোটি থেকে ৯শ কোটি টাকা লোটপাটের অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, প্রকল্পের সাড়ে ৬ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পর রহস্যজনকভাবে পরিবর্তন করা হয় নকশা। শুধু লুটপাটই নয়, এই নকশা পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরো প্রকল্পটি এখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলেও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, প্রকল্পের মূল নকশায় টার্মিনাল ভবনের পাইলিং করার কথা ছিল বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির স্টিল স্ক্রুয়েড পাইল (এসএসপি)। কিন্তু নকশা পরিবর্তন করে করা হয় মান্ধাতা আমলের বোরড পাইলিং।

প্রকল্পের সয়েল টেস্ট নিয়ে অনিয়ম : প্রকল্পের সয়েল টেস্ট নিয়েও বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এতেও বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের মূল কাজ শুরুর আগে সয়েল টেস্টের রিপোর্টে স্টিল স্ক্রুয়েড পাইল করা যাবে বলে জানানো হয়। কিন্তু কাজ ৬ শতাংশ শেষ হওয়ার পর সয়েল টেস্টের রিপোর্টে বলা হয়, টার্মিনাল ভবনের পাইলিংয়ে স্টিল স্ক্রুয়েড (এসএসপি) অনুপযুক্ত। বলা হয়, পরিবর্তন করতে হবে পাইলিং। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে পরিবর্তন করা হয় পাইলিংয়ের নকশা। প্রকল্পে ইউরোপীয় মানের যন্ত্রাংশ সংযোজনের কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে চায়নিজ মানের। সরকারের কোষাগার থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়েও কোরিয়া থেকে উচ্চমূল্যের বৈদ্যুতিক কেবল ও অন্যান্য সরঞ্জাম আমদানি করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নকশায় ভুল ও কয়েক বছরের ব্যবধানে ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে ২২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বাহ্যিকভাবে এ টার্মিনাল সুন্দর মনে হলেও সর্বস্তরে নিম্নমানের সামগ্রী, অখ্যাত ব্র্যান্ডের অনেক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে।

সিন্ডিকেটে যারা ছিলেন : অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পটি জাপানি কোম্পানির তত্ত্বাবধানে হলেও পুরো প্রকল্পের কেনাকাটা ও ইকুপমেন্ট সংযোজনের অলিখিত নেতৃত্বে ছিলেন মন্ত্রী ও বেবিচকসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। তার ডান হাত হিসাবে সবকিছু সামলাতেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মাকসুদুর রহমান। পুরস্কার হিসাবে পরপর তিন দফা চুক্তি নবায়ন করেন এই কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এত বড় একটি কাজে এমন অদক্ষ ও অযোগ্য পিডি (প্রকল্প পরিচালক) বাংলাদেশের আর কোনো প্রকল্পে দেখা যায়নি। তারপরও তিন দফা চুক্তি নবায়ন করেছেন শুধু সিন্ডিকেটের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে। মূলত অদক্ষ প্রকল্প পরিচালকের কারণে গত দুই বছরেও থার্ড টার্মিনালের অপারেশন শুরু করা সম্ভব হয়নি। যখনই তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায় তখনই প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে বলে মিথ্যা সংবাদ সম্মেলন করে নিজের চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে নেন।

এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী ও বেবিচকসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মিরপুর শেওড়াপাড়া থেকে পহেলা নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে কারাগারে আছেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের এই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাকসুদুর রহমানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন একাধিকবার তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েও রহস্যজনক কারণে সরে আসে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, অতিধূর্ত প্রকৃতির মাকসুদুর রহমানের দেশে বিশেষ কোনো সম্পদ নেই। তিনি ঘুস নেন ডলারে এবং দেশের বাইরে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে তদন্ত করা হলে বেবিচকের এই গডফাদারের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এছাড়া এই সিন্ডিকেটে ছিলেন সাবেক দুই মন্ত্রী এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনের এক এমপি। জানা গেছে, প্রকল্পটিকে সামনে রেখে প্রকল্প পরিচালক তিন দফা চুক্তি নবায়ন করেন। একইভাবে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী, তৎকালীন বেবিচক চেয়ারম্যান ও বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব একাধিকবার চুক্তি নবায়ন করেন। প্রকল্প কাজ শেষ না করে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটির সফট উদ্বোধন করান। এতে অর্ধশত কোটি টাকা অযৌক্তিক খরচ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।

এ প্রসঙ্গে বক্তব্য নিতে প্রকল্প পরিচালক মাকসুদুর রহমানকে টেলিফোন করা হলে তিনি বলেন, অনেক কিছু করতে হয়েছে। তবে নিজে কোনো দুর্নীতি করিনি, ঘুস খাইনি। আমার নিজের কোনো ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি নেই। উপরমহল কিছু করতে বললে আপনি কী করবেন-উলটো প্রশ্ন ছোড়েন মাকসুদ। তিনি বলেন, ভাই এসব কিছু লেইখেন না। আমারে আর ডুবাইয়েন না।

থার্ড টার্মিনালের স্থাপনায় ঝুঁকি : প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, নকশায় পরিবর্তন আনায় প্রকল্প ব্যয় সাশ্রয় হয় ৯শ কোটি টাকার বেশি। এই টাকা দিয়ে একটি অত্যাধুনিক ভিভিআইপি টার্মিনাল ও প্রকল্পকে ইউ আকৃতির রূপ দেওয়ার জন্য দুটি পিয়ার যুক্ত করার কথা ছিল। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে ফান্ডে কোনো টাকা নেই। প্রকল্পকে ইউ আকৃতির করার জন্য অতিরিক্ত ৩ হাজার কোটি টাকা লাগবে। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে ৯শ কোটি টাকা গেল কোথায়?

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ধরনের একটি মেগা প্রকল্পের মাঝপথে এসে হঠাৎ মূল কাজ অর্থাৎ টার্মিনাল ভবনের পাইলিংয়ের ধরন পরিবর্তন হওয়ায় পুরো প্রকল্পটিতে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাছাড়া প্রকল্পটির ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তিতে স্টিল স্ক্রুয়েড পাইল (এসএসপি) একটি সিলেকশন ক্লাইটেরিয়া ছিল। এটি দরপত্রের অত্যাবশ্যকীয় শর্তেও ছিল। মূলত এই শর্তের ভিত্তিতেই উপযুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নির্বাচন করা হয়েছিল। এ অবস্থায় অত্যাবশ্যকীয় এই শর্ত বাদ দেওয়া হলে এই দরপত্রের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়। কিন্তু প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের হস্তক্ষেপের কারণে এ নিয়ে কেউ কোনো টুঁ শব্দ করতে পারেনি। খোদ ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি, সিপিটিইউসহ সব সংস্থা কোনো ধরনের টুঁ শব্দ ছাড়া নকশার পরিবর্তনটি অনুমোদন করে দেন।

জানা গেছে, প্রকল্পের এই ভেরিয়েশনজনিত কাজের জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান যে টাকা সাশ্রয় হওয়ার কথা জানিয়েছে সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ প্রকল্পের ঠিকাদার জানিয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তির স্টিল স্ক্রুয়েড পাইল (এসএসপি) পরিবর্তন করে সাধারণ বোরড পাইলিং করায় ৮৪.৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৭১১ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাইলিং পরিবর্তন করায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ১২শ থেকে ১৫শ কোটি টাকার বেশি অর্থ সাশ্রয় হয়েছিল। এখানেও বড় ধরনের অনিয়ম করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, তৃতীয় টার্মিনাল ভবনের ফাউন্ডেশনের কাজে প্রায় তিন হাজার পাইলিং লেগেছে। এর মধ্যে ১৫৪৯টি পাইল স্টিল স্ক্রুয়েড পাইল দিয়ে সম্পাদনের বিষয়টি ঠিকাচুক্তিতে উল্লেখ ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বড় কাজটিই ছিল এই স্টিল স্ক্রুয়েড পাইল। কিন্তু প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট যাচাই-বাছাই ছাড়াও ৮৪.৫০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয়ের বিষয়টি মেনে নেয়। এতে কমপক্ষে ১ হাজার কোটি টাকা বেশি অর্থ গচ্চা গেছে সরকারের।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য অযৌক্তিক কাজ : সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য প্রকল্প পরিচালক মাকসুদুর রহমান জাপানি ঠিকাদার এডিসিকে পাশ কাটিয়ে তার পছন্দের কয়েকজন ঠিকাদার দিয়ে বেশ কিছু অতিরিক্ত কাজ করান থার্ড টার্মিনালে। এর মধ্যে ভিভিআইপি সড়ক থেকে থার্ড টার্মিনালে প্রবেশের জন্য একটি সাধারণ ব্রিজ ছিল নকশায়। এই ব্রিজ তৈরির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৪ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক তার পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে সেই ব্রিজটির কাজ করান। তাতে খরচ হয় ১২ কোটি টাকার বেশি অর্থ।

থার্ড টার্মিনালের কাজ বিক্রি করে কমিশন বাণিজ্য : থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের তিনটি বড় কাজ নির্ধারিত ঠিকাদারের পরিবর্তে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ আছে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে। জানা যায়, কাজগুলো থার্ড টার্মিনালের অংশ হলেও মাকসুদুর রহমান সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য গোপনে চুক্তিবহির্ভূত অন্য ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেয়। এতে মোটা অঙ্কের টাকা ‘কমিশন বাণিজ্য’ হয়। পাশাপাশি সরকারকে গচ্চা দিতে হয় কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা। কারণ যেহেতু কাজটি থার্ড টার্মিনালের অংশ সেহেতু সংশ্লিষ্ট বিদেশি ঠিকাদার কাজ না করলেও তাদের এজন্য মোটা অঙ্কের টাকার লাভ (ইনডাইরেক্ট কস্ট) দিতে হবে। অপরদিকে অন্য ঠিকাদারকে দিয়ে করানোর কারণে দুটি কাজে বেবিচকের ব্যয় হয় মোটা অঙ্কের টাকা।

অপারেশন শুরু হওয়ার আগে যন্ত্রপাতির ওয়ারেন্টি শেষ : প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতা, দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে থার্ড টার্মিনালে স্থাপিত অনেক যন্ত্রপাতির ওয়ারেন্টি শেষ হয়ে গেছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে রয়েছে আরও অনেক যন্ত্রপাতি। ফলে এসব যন্ত্রপাতির কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নতুন করে ওয়ারেন্টি (রক্ষণাবেক্ষণ) মেয়াদ বাড়ানোর জন্য চুক্তি করতে হবে বেবিচককে। এতে গচ্চা যাবে বাড়তি অর্থ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে মেগা প্রকল্প থার্ড টার্মিনালের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর তড়িঘড়ি উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, থার্ড টার্মিনালের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে তৃতীয় টার্মিনাল থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করা যাবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। এখন বলা হচ্ছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের আগে টার্মিনালটি চালু করা সম্ভব নয়। এখনো টার্মিনাল পরিচালনার মাস্টারপ্ল্যান (রূপরেখা) তৈরি হয়নি।

এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ও নভো এয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান  বলেন, ‘গাড়ি পার্কিং ছাড়াই ২০১৬ সালের দিকে থার্ড টার্মিনালের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। তিনি বলেন, টার্মিনালের সঙ্গে একই সময়ে কাজ শুরু হওয়া বেঙ্গালুরুর ক্যাম্পাগাউড়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ২০২২ সালেই চালু হয়েছে। কোনো ধরনের ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই ওই বিমানবন্দর তৈরিতে পাঁচ হাজার কোটি রুপি খরচ হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। ওই বিমানবন্দরটি আয়তনে ঢাকার থার্ড টার্মিনালের চেয়ে ২৩ শতাংশ বড়। থার্ড টার্মিনালের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এত খরচের পরও সেখানে ‘নিম্নমানের অচেনা ব্র্যান্ডের যন্ত্রপাতি’ বসানো হয়েছে। হাজারটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের মাঝে বিরাট আয়োজনে আর ঢাকঢোল পিটিয়ে নির্মাণ শেষ হওয়ার অনেক আগেই শুধু রাজনৈতিক স্টান্টবাজি আর নির্বাচনের মাঠে ফায়দা লোটার জন্য বিগত সরকার থার্ড টার্মিনালের উদ্বোধন করে।

প্রকল্পের কাজ শেষ, পাথরের মান দেখতে ইতালি গেলে প্রকল্প পরিচালক : এদিকে প্রকল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ শেষ হয়ে গেলেও থার্ড টার্মেনালের জন্য পাথর ও টাইলস ক্রয়ের মালামালের মান যাচাই-বাছাই করতে ইতালি গেছেন প্রকল্প পরিচালক মাকসুদুর রহমানের নেতৃত্বে তিনজন। অভিযোগ আছে প্রকল্পে সরবরাহকারী পাথরের উৎপাদন স্থান ইতালি দেখানো হলেও বাস্তবে পাথর সরবরাহ করা হয়েছে স্থানীয়ভাবে। শুধু এই খাতেই নয়, প্রকল্প পরিচালক মাকসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতি মাসে একাধিকবার অহেতুক বিদেশ ভ্রমণের অভিযোগ আছে।

সাবেক এক মহিলা এমপিকে দেওয়া হয়েছে থার্ড টার্মিনালের সিলিংয়ের কাজ : বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল মুকতাদির চৌধুরী এবং সংরক্ষিত আসনের সাবেক মহিলা এক এমপির নেতৃত্বে পুরো থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। প্রকল্পের নকশায় না থাকার পরও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপিকে থার্ড টার্মিনাল ভবনের সিলিংয়ের কাজ দেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা কারুকাজখচিত সিলিং লাগানোর এই কাজটি দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকায়। অভিযোগ আছে, মূল প্রকল্পে এ ধরনের সিলিং ছিল না। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নানা কারুকাজখচিত এই সিলিংটি দেখতে প্রথম প্রথম দৃষ্টিনন্দন মনে হলেও আস্তে আস্তে এটি প্রকল্পের বোঝা হয়ে দেখা দেবে। কারণ নানা কারুকাজখচিত থাকায় এই সিলিংয়ে প্রতিনিয়ত ধুলোবালি আটকাবে। তাছাড়া ঢাকার বাতাসে প্রচুর পরিমাণ কালো ধোঁয়া থাকায় ২-৩ বছরের মধ্যে এই সিলিং কালো হয়ে যাবে। তাছাড়া সিলিংটি প্রতিনিয়ত পরিষ্কারে ব্যয়ও অনেক বেশি পড়বে।

এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য সাবেক মাহিলা এমপির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। সরকার পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন বলে জানা গেছে।

থার্ড টার্মিনালসহ বেবিচকের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রসঙ্গে সংস্থার চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবির ভুঁইয়া গণমাধ্যমে বলেছেন, আমি এখানে আসার পর বলেছি, সিভিল এভিয়েশনে দুর্নীতি হবে জিরো টলারেন্স। যদি কেউ করাপশনে এনগেজ হয়ে থাকেন তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। ক্লিয়ার মেসেজ হচ্ছে কোনো ধরনের করাপশন করা যাবে না।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com