ইতিহাস
ইরাকের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। পৃথিবীর প্রথম সভ্যতার উদ্ভব ঘটে এখানে, বিশেষ করে মেসোপটেমিয়া (যা আধুনিক ইরাকের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত)। এখানে সুমেরীয়, একাদীয়, বেবিলনীয় এবং অ্যাসিরীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া বিশ্বের প্রথম লেখনী পদ্ধতি, আবিষ্কার, আইন (হামুরাবির কোড) এবং অন্যান্য বহু বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক অর্জনের জন্য পরিচিত।
বেবিলনীয় সাম্রাজ্য এবং অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য বিশ্ব ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে, ইরাক একাধিক সাম্রাজ্য এবং শাসকগণের অধীনে শাসিত হয়েছে, যার মধ্যে পারস্য, রোমান, উমাইয়া এবং আব্বাসী খিলাফতও অন্তর্ভুক্ত। মধ্যযুগে, বিশেষ করে আব্বাসী খিলাফতের সময়ে, বাগদাদ ছিল পৃথিবীর প্রধান শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং বাণিজ্যের কেন্দ্র।
অবশেষে, ১৯২০ সালের দিকে ইরাক ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ছিল এবং ১৯৩২ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে এবং তখন থেকেই দেশটি রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সশস্ত্র সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সংস্কৃতি
ইরাকের সংস্কৃতি একে একে ইসলামী, আরবি এবং মেসোপটেমীয় ঐতিহ্যগুলির মিশ্রণ। ইরাকের প্রধান ধর্ম ইসলাম, যার মধ্যে সুন্নি এবং শিয়া মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে। শিয়া মুসলিমদের প্রধান পবিত্র স্থান কেরবালা শহর, যেখানে ৬৮০ সালে হুসাইন ইবনে আলি শহীদ হন। আরবি ভাষা ইরাকের সরকারি ভাষা এবং এখানে কুর্দি ভাষাও প্রচলিত।
ইরাকের সাহিত্যও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রাচীন যুগে, সুমেরীয়দের লেখা ইপিক সাহিত্য যেমন “এপিক অফ গিলগামেশ” পৃথিবীজুড়ে পরিচিত। ইসলামিক যুগের সাহিত্যেও ইরাকের অবদান ছিল বিশাল, যেমন আরব কবিতা এবং ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থের সাহিত্যিক কাজ।
আরবি খাবার যেমন হুমাস, ফালাফেল, মজেদরা, বকরা এবং কাবাব ইরাকের জনগণের প্রধান খাদ্য। আরব সঙ্গীত, নৃত্য এবং পোশাকও ইরাকের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।
অর্থনীতি
ইরাকের অর্থনীতি প্রধানত তেলনির্ভর। তেলের খনি ইরাকের অর্থনৈতিক অবস্থা নির্ধারণ করে। পৃথিবীর তেল রপ্তানির শীর্ষস্থানীয় দেশগুলির মধ্যে ইরাক অন্যতম। দেশটির প্রধান রপ্তানি পণ্য তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস, যার উপর ইরাকের অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। যদিও দেশটি কৃষির ক্ষেত্রেও কিছু উন্নতি লাভ করেছে, তবে যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে কৃষি খাতে পূর্ণ সম্ভাবনা পূর্ণ হয়নি।
ইরাকের তেল উৎপাদন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হলেও, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। পুঁজির অভাব, যুদ্ধের ক্ষত, এবং সরকারি দুর্নীতি অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
রাজনীতি
ইরাকের রাজনীতি ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পর ব্যাপক পরিবর্তনের মুখে পড়ে। সাদ্দাম হুসেইন সরকারের পতনের পর দেশটিতে নতুন সংবিধান গৃহীত হয়, এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে, ইরাকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই অস্থিতিশীল, যেখানে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী, জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজন এবং বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ রাজনৈতিক সংঘাতকে আরও জটিল করেছে।
বর্তমানে ইরাক একটি ফেডারেল সংসদীয় প্রজাতন্ত্র, যেখানে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন। শিয়া, সুন্নি, এবং কুর্দি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই দেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বর্তমান পরিস্থিতি
ইরাক বর্তমানে ব্যাপক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং নিরাপত্তা সমস্যার মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী, যেমন ইসলামিক স্টেট (আইএস), দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও অবনতি ঘটিয়েছে। একদিকে সরকার এবং বিদেশী শক্তির সহায়তায় ইরাক আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং রাজনৈতিক দুরবস্থা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য বিপদজনক।
তবে, ইরাকের জনগণ অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং দেশপ্রেম ধরে রাখার চেষ্টা করছে। দেশটি পুনর্গঠনের পথে হাঁটছে, যদিও সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন একটি প্রক্রিয়া এটি।
ইরাক, প্রাচীন সভ্যতার জন্মস্থান এবং ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক, আজও তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। যদিও এই দেশটি কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন, তবে এর ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং জনগণের সংকল্প দেশটির ভবিষ্যতকে আলোকিত করতে সহায়তা করবে।