গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সেবার মান নিয়ে বহু বছর ধরে যাত্রী ও এয়ারলাইন্সগুলোর অভিযোগ রয়েছে।
দক্ষ জনবল, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকা ও অব্যবস্থাপনায় সময়মতো যাত্রীদের ব্যাগেজ না পাওয়া এমন অভিযোগ হর-হামেশা পাওয়া যাচ্ছে। আবার ব্যাগেজে কাটাছেঁড়া, মূল্যমান মালামাল চুরির ঘটনাও অহরহ। দেরিতে ব্যাগেজ আসা ও চেক-ইন ব্যাগ দেরিতে উড়োজাহাজে পৌঁছানোর অভিযোগ রয়েছে। এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে কাজ পাচ্ছে বিমান। আগামী দুই বছরের জন্য তাদের এই দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে।
এই যখন অবস্থা তখন প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে বিমান টার্মিনাল-১ ও ২ এর দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছে না। সেবার মান একেবারে তলানিতে। ৯৩ শতাংশ যাত্রী ও এয়ারলাইন্স বিমানের সেবার মান নিয়ে বিরক্ত। তবুও কীভাবে বিমানকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ দেয়া হচ্ছে। থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব নেয়ার জন্য বিমানের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের জন্য বিমানের পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নেই। আগের টার্মিনাল পরিচালনা করতেই বিমান হিমশিম খাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিমানকে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৃতীয় টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব দেয়া উচিত হবে না।
বিমান থার্ড টার্মিনালের কাজ পাচ্ছে এমন খবরে আপত্তি জানিয়েছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো। বেশির ভাগ এয়ারলাইন্সের অভিযোগ, বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার মান স্ট্যান্ডার্ড নয়। তারা অভিজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে সেবা দিবে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার বিষয়ে দাবি জানিয়েছেন। প্রয়োজনে বিমানের সঙ্গে আরও কোনো প্রতিষ্ঠানকে যৌথভাবে দেয়া গেলে সেবার মানের পার্থক্য উঠে আসবে বলেও মত দিয়েছেন অনেকে। কারণ শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের এক জরিপেই উঠে এসেছে ৯৩ শতাংশই বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এমন অবস্থায় তৃতীয় টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব বিমানকে দেয়া হলে মুখ থুবড়ে পড়বে। এ ছাড়া সেবার মান যদি বিমান উন্নত করতে না পারে তবে এভিয়েশন শিল্প সংকটে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
১৯৭২ সাল থেকে দেশের সব বিমানবন্দরে এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করে আসছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। নিজেদের ফ্লাইটের পাশাপাশি বিদেশি ৩৫টির মতো এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের সেবা দিচ্ছে তারা। চলতি বছরের ডিসেম্বরে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের শতভাগ অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হবে। এরপর টার্মিনালটি যাত্রীদের জন্য খুলে দিতে আরও এক বছরের মতো সময় লাগবে। এই সময়ে টার্মিনাল পরিচালনায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিবে বেবিচক। আর এই পরিচালনার বড় একটি কাজ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং। এই কাজটি কে পাবে তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছিল। এর মধ্যে বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার কারা হবে, তাদের কীভাবে এবং কী কী সার্ভিস দিতে হবে, সেই সার্ভিস দিয়ে রাজস্ব আয় কতো হবে সেগুলো নির্ধারণে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি) পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে তৃতীয় টার্মিনালের প্রাইভেট সেক্টর পার্টনারশিপের (পিএসপি) জন্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়ন করা হয়েছিল। তবে গত ২৪শে অক্টোবর গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব বিমানকে দিতে চিঠি ইস্যু করেছেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পিপিপির পরিচালক (ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন) মো. আলী আজম আল আজাদ। পিপিপি’র চিঠিতে বলা হয়েছে, আগামী দুই বছরের জন্য বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। আর বিমান প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে না পারলে বিদেশি স্বনামধন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দিতে হবে।
বিমান বাংলাদেশের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের মান ও সার্ভিস চার্জ নিয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মধ্যেপ্রাচ্যভিত্তিক একটি বিদেশি এয়ারলাইন্স জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে একটি ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে দুই হাজার ২০০ ডলার পরিশোধ করতে হয়। আর কার্গোর জন্য প্রতি কেজিতে অতিরিক্ত শূন্য দশমিক শূন্য সাত সেন্ট (ডলার) চার্জও প্রদান করতে হয়। অথচ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য মাত্র ২ থেকে ৩ জন কর্মী সরবরাহ করে। ফলে প্রতিটি এয়ারলাইন্সকে বিমানবন্দরে গড়ে ২৫ জন করে নিজস্ব কর্মী নিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। এতে এয়ারলাইন্সগুলো পরিচালনায় ব্যয় বাড়ছে। আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, বিদেশি এয়ারলাইন্সের প্রতি ফ্লাইটের জন্য অতিরিক্ত ৫ হাজার ২০০ টাকা চার্জ দিতে হয়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমরা পারবো মনে করছি বলেই কাজ শুরু করেছিলাম। লাইসেন্সও পেয়ে গেছি। আমরা জনবল নিয়োগ করেছি, যন্ত্রপাতিও কেনা হচ্ছে। থার্ড টার্মিনালের পরিধি অনেক বড়। টার্মিনাল-১ ও ২ দেখে যদি থার্ড টার্মিনালের তুলনা করা হয় তাহলে হবে না। এই দুই টার্মিনাল অনেক ছোট। সেখানে অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মানুষ যেটা বলতেছে সেটা ওই টার্মিনালে কাজ দেখে ভাবছে বিমান পারবে না। থার্ড টার্মিনালের কাজ করার জন্য দুই বছর ধরে আমরা আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করছি।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার এটিএম নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, সক্ষমতার কথা বললে বিমান যন্ত্রপাতি, জনবল বা অন্য কিছু যদি থাকে তবে সেটা সংগ্রহ করতেই পারে। এটা নিয়ে খুব বেশি ভাবনার কিছু নাই। কারণ থার্ড টার্মিনাল চালু হলে খুব বেশি কাজ বেড়ে যাবে এমনটা নয়। যে এয়ারলাইন্স আছে সেগুলোর সঙ্গে হয়তো আরও কয়েকটা যোগ হতে পারে। কথা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্ব্বেও মানুষ বিমানের সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট না। এখানে দুটি বিষয়, যাত্রীরা যারা আসছে তারা তাদের লাগেজ সঠিক সময়ে পাচ্ছে না। আরেকটা হলো একজন যাত্রী যখন অসন্তুষ্ট থাকে তখন বিষয়টি এয়ারলাইন্সের ওপর বর্তায়। এতে করে অনেক এয়ারলাইন্স বিমানের সেবায় অসন্তুষ্ট। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে বিমান ইমেজ সংকটে পড়েছে। এটা থেকে তারা কীভাবে বেরিয়ে আসবে সেটা দেখতে হবে।
বেবিচকের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মো. মফিদুর রহমান গতকাল মানবজমিনকে বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ও দাবি থার্ড টার্মিনাল থেকে উন্নত, আন্তর্জাতিক মানের সেবা দেয়া। কিন্তু বিমানের সেই সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ আছে। স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা কোনো বিকল্প দেখছি না। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে শুধু বিমানেরই সেবা দেখছি। এ জন্য আমাদের পার্থক্য করারও সুযোগ হচ্ছে না। টার্মিনাল-১ ও টার্মিনাল-২ এ যাত্রী ও বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর প্রত্যাশা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না বিমান। সে জায়গায় নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনাল অনেক আকাঙ্ক্ষার।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, আমরা আশা করছি বিমান সেটা ভালোভাবে করতে পারবে। তারা জাপানি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। সবকিছুই তো পরিবর্তন হচ্ছে। বিমানও তাদের সেবার মান পরিবর্তন করবে বলে আশা করছি। তবে থার্ড টার্মিনালে আমরা একটা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে দিবো। জাপানি কোম্পানি কেপিআইটা মনিটরিং করবে। আমরা এর নিচে নামবো না।