শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৭ পূর্বাহ্ন

মোহনীয় মালদ্বীপ

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪

বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম রাষ্ট্র মালদ্বীপের মোট আয়তন মাত্র ২৯৮ বর্গ কিলোমিটার।  এটি ১১৯২ টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র  দ্বীপ নিয়ে গঠিত।  মালদ্বীপের অর্থনীতি মূলত পর্যটন এবং মাছ শিকারকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। মালদ্বীপের জনসংখ্যা মাত্র ৩ লাখ ৫০ হাজার যার প্রায় শতভাগই মুসলমান।  বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছে প্রায় ১ লাখ। বিধাতা এ দ্বীপ রাস্ট্রটিকে দুহাত ভরে অপরুপ সাজে সাজিয়েছেন। মালদ্বীপের মূল আকর্ষণ এর স্নিগ্ধ, শান্ত, সরল মনোরম প্রকৃতি।  মালদ্বীপকে সারা বছর এক ঋতুর দেশ বলা হয়। তাপমাত্রা ২৫-৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে ভাল।

আমরা দুইজন – প্রবীন দম্পতি মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে এক দুপুরে শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সে  রওয়ানা দেই। কলম্বো হয়ে প্রায় সাড়ে ৪ ঘন্টায় মালদ্বীপের রাজধানী মালে এয়ারপোর্টে  নামি। তখন রাত ৯ পার হয়ে গেছে। সমূদ্রতীর ঘেঁষে খুবই ছোট এই এয়ারপোর্ট। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা নেই। সহজেই বের হয়ে হেঁটেই ফেরীঘাটে আসি।

আমাদের মূল গন্তব্য মাফুশি আইল্যান্ড। সমূদ্রপথে দু’ঘণ্টার পথ। ফেরিঘাটটি  সুন্দর, পরিস্কার ও কোলাহল মুক্ত। রাত তখন দশ বাজে। স্পীডবোটে রওয়ানা হলাম মাফুশি দ্বীপের  উদ্দেশ্যে।

সমুদ্রতীরের মালে শহরের আলো সমূদ্রের ঢেউয়ের সাথে নাচছে। লোকালয় ছেড়ে অন্ধকারে আমাদের নৌযানটি  চলতে শুরু করলো। অন্ধকারে সাদা ফেনিল ঢেউ উথলে উঠছে দূরে।  হু হু ঠান্ডা বাতাস। আকাশে পূর্নিমা শেষের ক্লান্ত চাঁদ । আলো আঁধারিতে উন্মত্ত উর্মিচূড়া ভেঙে আমাদেরএই এগিয়ে চলা রহস্যময় হয়ে উঠে ক্রমে। মানব জীবন রহস্য ভালবাসে। আমরাও ভালবাসায় বুদ হয়ে রইলাম।

মাফুশি আইল্যান্ডে –

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে

রাত ১২ টা নাগাদ পা রাখলাম মালদ্বীপের পর্যটকবান্ধব ব্যস্ত ও জনপ্রিয় দ্বীপ মাফুশিতে। এখানে সিমেন্ট বা ইটের রাস্তা নেই। মোটা দানার সাদা বালি পথে বিছানো। লাইটপোষ্ট ও চাঁদের আলোয় বালিগুলি মুক্তোদানার মতন ঝিকমিক করছে। হেঁটেই হোটেল গ্র‍্যান্ড ক্যানিতে উঠলাম। এটি  সমূদ্রে একেবারে ধার ঘেঁষে।

পর্যটকদের বেশিরভাগই ইউরোপিয়ান। রাতের  নির্জন দ্বীপ। দল বেঁধে বা দুজনা হেঁটে বেড়াচ্ছে। পথের পাশ থেকে  গান  হই হুল্লোরের শব্দ আসছে। বড় তারকা হোটেলের সামনের চেয়ারে কেউ আবার গা এলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে সমূদ্র। উশৃংখলতা নেই, কি নিরাপদ পরিবেশ!

সবরকম খাবারই এখানে পাওয়া যায়। তবে  মালদ্বীপ এসে সামূদ্রিক মাছ খেতে ভুলবেন না। ছোটছোট সুভেনিরের দোকান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নারিকেল ও কাঠের তৈরি ক্রাফটস খুবই আকর্ষণীয়।

দু্’দিন ছিলাম মাফুশি আইল্যান্ডে। যেদিকে তাকাই সমূদ্র আর বেলাভূমি।  বেলাভূমিতে আছড়ে পরা ঢেউ।  অপূর্ব সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের দৃশ্য। নীল  ঢেউয়ের মাঝে শিলাখন্ডের ফাঁক গলিয়ে বর্ণিল রংধনু । এইসব দৃশ্য কি সম্মোহিত না করে পারে!

মালদ্বীপের প্রাইভেট রিসোর্ট ওয়াটার ভিলা (Olhuvelli) ভ্রমন

ভারত সাগরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু  দ্বীপ নিয়ে মালদ্বীপ। এর মধ্যে রয়েছে পাবলিক  আর প্রাইভেট দ্বীপ। পাবলিক দ্বীপগুলোতে স্থানীয়রা বসবাস করেন। প্রাইভেট দ্বীপগুলোর বিলাস বহুল রিসোর্ট ট্যুরিস্টদের টার্গেট করেই তৈরি করা।

এখানে বিশ্বের অনেক ধনকুবের,  সেলিব্রেটিদের নিজস্ব আইল্যান্ড রিসোর্ট আছে। তারা ছুটি বা অবসর কাটাতে আসেন। বিলাসবহুল এই রিসোর্টগুলোতে রাজধানী মালে থেকে স্বল্প সময়ে জলযান বা সি-প্লেনে আসা যায়।

জলমগ্ন প্রকৃতিতে বিস্ময় মগ্নতা, গাঢ় নীল আকাশের চেয়েও নীল জলের সাথে কানাকানি, প্যানোরামিক সমুদ্র দৃশ্য – সব মিলিয়ে স্বর্গীয়! পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে পর্যটক আসছে।

প্রাইভেট রিসোর্টে ডে টুরের ব্যবস্থা আছে। এক প্যাকেজে মাফুশি আইল্যান্ড থেকে স্পীডবোটে  একঘন্টায় চলে গেলাম। আসার পর প্রত্যেককে আলাদা কোড নাম্বার ও ওয়াইফাই নাম্বার দেয়া হলো। অভ্যর্থনা কেন্দ্রে গাইড  কোথায় কি আছে, কখন কোথায় যেতে হবে, লাঞ্চের সময় ও স্থান বিস্তারিত জানিয়ে দিল।

অরুভিলা নামের প্রাইভেট রিসোর্টটি।  পৌঁছে যে যার মতন ঘুরতে বেড়িয়ে গেল। কাঠের পাটাতনের সেতু দিয়ে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে হেঁটে যাওয়া যায়। সমূদ্র  কিনারায় বনের মধ্যে ছোট ছোট কাঠের ঘর পর্যটকদের রাত যাপনের। এমন কয়েক হাজার কটেজ আছে এখানে।  একরাতের ভাড়া আমাদের দেশের টাকায় ৩/৪  থেকে ১৫/২০ লক্ষ। তবে হানিমুন জুটিই বেশি। বাংলাদেশী সদ্য বিবাহিত জুটির দেখাও মিললো।  কারো হাতে  মেহেদির রঙ, নতুন আংটি, চুড়ি। লেহাংগা, লং গাউন পড়ে ফটোশুট চলছে। আমরা  বুড়োবুড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছি চারিদিক, উপভোগ করছি।  প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর  রুপ। মালদ্বীপ ভ্রমনে সবচেয়ে উপভোগ্য হলো নির্জনতা। নির্জনতারও আছে মুখর  ভাষা। তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।

সমূদ্রের একটা নির্দিষ্ট এলাকায় স্কুবি ড্রাইভ ও অন্যান্য জলক্রীড়ার ব্যবস্থা আছে পর্যটকদের জন্য।  ডুবুরীর পোষাক পরিয়ে সমুদ্রের নীচে নামিয়ে দেয়া  হয় গাইডের নেতৃত্বে। ‘ যেমন করে বীর ডুবুরি সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে’ এই ভাব নিয়ে আমিও নেমে গেলাম স্কুবিডাইভে।  সাগরের তলদেশে দেখে এলাম এক বর্ণিল জগৎ। রঙিন মাছ, প্রবাল প্রাচীর, শৈবাল কচ্ছপ, ক্ষুদ্র রীফ, টুনা,  অক্টপাসের সে জগতের অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চকর। এর কিছু অংশ দেখে স্বল্প দমের জন্য সাগরের তল থেকে উঠে আসতে হলো।

এবার গেলাম স্পীডবোটে আরেক দ্বীপ ‘ বিকিনি দ্বীপে-‘ ।  নীল সমূদ্র পাড়ে নীল চোখের কোনো রমনী সংগী নিয়ে বসে আছে।  কেউ সাঁতার কাঁটছে। পর্যটকদের কেউ ওয়াটার স্কি করছে, ঘুড়ি উড়াচ্ছে। সমূদ্রের মধ্যে টানানো দোলনায় দুলছে।

অসংখ্য নারিকেল গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দ্বীপ জুড়ে। কাঠের রেস্তোরাঁ, বাথরুম ও গোসলের ব্যবস্থা আছে । এক টুকরো ময়লা চেষ্টা করেও খুঁজে পেলাম না। পর্যটক বান্ধব বলেই  লক্ষ মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে মালদ্বীপে।

ঝিরঝিরি বাতাসে নারিকেল পাতা দুলছে ।

সমূদ্র, বেলাভূমি আর আকাশ। আমরা লাঞ্চ সেরে হাঁটতে থাকি। দেখি দুটো সাদা ধবধবে চেয়ার পাতা গাছের নীচে।  যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষায় গাইছে  — ‘ তুমি কোন সে পথিক এলে —‘ ।  আমরা গা এলিয়ে দেই চেয়ারে । নির্জনতা ভেংগে কোথা থেকে এক কোকিল ডেকে উঠে। সামনে আদিগন্ত নীল সমুদ্র, গাঢ় নীল আকাশে দুধসাদা মেঘ ভাসছে পায়রার  মতন। ক্ষনেক্ষনে  ঝিরিঝিরি দমকা বাতাস বেলাভূমির সাদা বালু  নিয়ে হোলি খেলছে।

কাছেধারে কোথা থেকে যেন অচেনা পাখির অচেনা সুর ভেসে আসে। নারিকেল পাতা অনাঘ্রাত যুবতীর মতন থরথর কেঁপে উঠছে  বাতাসে। আমার মন সমর্পিত হলো,  নিমজ্জিত হলো প্রকৃতিতে, নিজের মাঝে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্যময় সুন্দরের কাছে।

সময় গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে এলো। ডাক এলো গাইডের। ফেরার পালা। স্বপ্ন থেকে জেগে উঠবার পালা। ফিরে যাবার জন্যই আসা। তাই ফিরে যেতে হয়, মানুষ ফিরে যায়।

ডাঃ মালিহা পারভীন

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com