“বিমানে ওঠার পর বেশিরভাগ বাচ্চারা কান্নাকাটি করে সবাইকে বিরক্ত করলেও আমি অনেক শান্ত ও কৌতূহলী ছিলাম। আমার এখনো মেঘের ভিতর দিয়ে সেই যাত্রার কথা মনে পড়ে, আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম এবং তখন আমার নিজেকে একটি পাখি মনে হচ্ছিল”- কথাগুলো মালিহা ফাইরুজের। মাত্র চার বছর বয়সেই বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে যাওয়ার তার প্রথম বিমান ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করে যা তিনি বলেন।
এ পর্যন্ত ফাইরুজের ভ্রমণ করা দেশের সংখ্যা ১০২টি। তিনি ইতোমধ্যে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি দেশ ভ্রমণ করে ফেলেছেন। হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের দুর্বলতম পাসপোর্টের মধ্যে অষ্টম স্থানে থাকা বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিয়েই এতগুলো দেশ ভ্রমণ করায় গত অক্টোবরে তাকে নোমাডম্যানিয়া অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়।
পাসপোর্ট র্যাংকিয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট, যেটি দিয়ে বিশ্বের ১৯৩টি দেশে বিনা ভিসায় ভ্রমণ করা যায়। অপরদিকে, বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিয়ে ভিসাহীন ভ্রমণ করা যায় মাত্র ৪০টি দেশে। আর এ বিষয়টিই ফাইরুজের বিদেশ ভ্রমণকে আরো কঠিন করেছে।
যেমন, কিরগিজস্তানে ফাইরুজের ভিসার আবেদনপত্র জমা দেওয়ার আগে ঐ দেশের একটি ট্রাভেল এজেন্সির কাছ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্রের প্রয়োজন পড়ে। আর ঐ আমন্ত্রণপত্রটি পেতে, তাকে আগে প্রথমে বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্সি থেকে একটি ভ্রমণ প্যাকেজ কিনতে হয়। এর পরে আরো পাঁচ থেকে ছয় সপ্তাহ তাকে অপেক্ষা করতে হয়– ভিসার অনুমোদন পেতে।
মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ফাইরুজ বাংলাদেশ ত্যাগ করেন এবং তার মায়ের সাথে পূর্ব আফ্রিকা, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করা শুরু করেন। বর্তমানে তিনি বার্লিনে বাস করছেন এবং সেখানে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে কাজ করছেন।
হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের দূর্বলতম পাসপোর্ট হিসেবে অষ্টম স্থানে থাকা বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিয়েই এতগুলো দেশ ভ্রমণ করায় গত অক্টোবরে মালিহা ফাইরুজকে নোমাডম্যানিয়া এওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়।
কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
ভ্রমণের ক্ষেত্রে ফাইরুজের প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশি হওয়ায় বিভিন্ন স্টেরিওটাইপ/গৎবাঁধা আচরণ এর সম্মুখীন হওয়া। অন্যান্য দেশের শক্তিশালী পাসপোর্ট এর নাগরিকদেরকে ধনী পর্যটক মনে করার বিপরীতে বাংলাদেশিদের ধরে নেওয়া হয় অবৈধ অভিবাসী হিসেবে। এ ছাড়া, নারী ভ্রমণকারী হিসেবেও তাকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, কিন্তু যখন এর সাথে বাংলাদেশি পরিচয়টা যোগ হয়– তখন তা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ফাইরুজ এর মতে, শ্রেণি, শিক্ষা কিংবা আর্থিক দিক বিবেচনায় তিনি অনেক সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও বেশিরভাগ মানুষ তাকে শুধু একটি সংখ্যা কিংবা পরিসংখ্যানের তথ্য হিসেবে দেখে। ফাইরুজ জানান, তার সব থেকে খারাপ অভিজ্ঞতা হয় যখন আফ্রিকার কেপ ভার্দেতে প্রবেশ করার সময় তাঁকে এয়ারপোর্টে আটকে দেওয়া হয়। তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় ভিসা এবং সকল কাগজাদি থাকার পরও কর্তৃপক্ষ তাকে ওই দেশে প্রবেশ করতে দেয়নি। এমনকি তাঁরা ফাইরুজকে সেনেগালে ফেরত পাঠানোর হুমকিও দেয়, যেখান থেকে তিনি কেপ ভার্দে গিয়েছিলেন, অথচ ওইখানে ফেরত যাওয়ার জন্য তার কাছে ওই দেশের কোনো ভিসাও ছিল না।
এ বিষয়ে সিএনবিসি কেপা ভার্দের পর্যটন কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে তারা কোনো মন্তব্য করেনি।
ফাইরুজ বলেন, “দেশটি একটি ছোট দ্বীপরাষ্ট্র, অথচ তারা আমাকে আটকানোর কারণ হিসেবে দেখায় যে, কেউ-ই এখানে শুধু তিন চারদিনের জন্য ভ্রমণ করতে আসবে না।”
ফাইরুজকে প্রায় ১৭ ঘণ্টার মতো আটকিয়ে রাখা হয়। জাতিসংঘ কর্মরত ফাইরুজের মা যখন সেখানকার জাতিসংঘ অফিসের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন তখন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় তাঁকে ছেড়ে দিতে।
ফাইরুজ বলেন, “তারা আমাকে অনেক খারাপ সময়ের অভিজ্ঞতা দেয় এবং আমি ওই সময় মানসিকভাবেও প্রচুর বিপর্যস্ত ছিলাম।” এভাবে একটি কক্ষের ভিতরে আটকে থাকার ভয় ও অনুভূতি খুবই বাজে। তিনি জানান, তিনি এখনো কোনো বিমানবন্দরে গেলে আগের সেই খারাপ অভিজ্ঞতা তার মধ্যে এক ধরনের ভয়ের সৃষ্টি করে।
এরপরেও ভ্রমণ অব্যাহত রাখবেন?
কোনো খারাপ অভিজ্ঞতাই ফাইরুজকে ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। তার মতে ভ্রমণের সুন্দর সুন্দর স্মৃতির ভিড়ে এসব খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো চাপা পড়ে যায়। ফাইরুজ বলেন, “এ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন মানুষের দয়া ও উদারতা তাকে মুগ্ধ করে এবং তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন এসব মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার কারণে।” তিনি আরও বলেন, “তিনি ভ্রমণ করেন যান্ত্রিক এই পৃথিবী থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে, একঘেঁয়ে জীবনে নতুনত্ব আনতে।”
মানুষ গাড়ি-বাড়ি কেনার জন্য টাকা সঞ্চয় করলেও ফাইরুজ সঞ্চয় করেন বিশ্ব ভ্রমণের জন্য। এ বিষয়ে তিনি আরো জানান, “আমি বাংলাদেশের বাইরে থেকে যত টাকা-ই আয় করি না কেনো, আমি এর সবটুকুই ভ্রমণে ব্যয় করি এবং এটি আমার কাছে সেরা মনে হয়।”
তাঁর মতো যারা ভ্রমণ পিপাসু হতে চান, তাঁদের জন্য ফাইরুজের উপদেশ হলো– যেকোনো একটি জায়গা দিয়েই প্রথমে শুরু করতে হবে। এ বিষয়ে বলেন, “আমরা অনেকেই ভ্রমণের জন্য একটি বড় লক্ষ্য নির্ধারণ করতে গিয়ে পুরো বিষয়টিকে অনেক জটিল করে ফেলি। তাই আগে ছোট ছোট ধাপে শুরু করতে হবে। নিজের দেশের বিভিন্ন স্থানে একা ভ্রমণ কিংবা দেশের কাছের দেশগুলো ভ্রমণ দিয়ে শুরু করতে হবে, তারপরই নিজের মধ্যে আরো ভ্রমণের সাহস তৈরি হবে।”
এ ছাড়াও ফাইরুজ বলেন, “চারপাশে এমন মানুষকে সাথে রাখুন যারা আপনাকে নিয়ে ভাবে এবং আপনার লক্ষ্যের উপর বিশ্বাস রাখে, এই বিষয়গুলোই আপনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”