স্কুলপড়ুয়া এক কিশোর। কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে বেশ পটু। তাই তাঁর ওপর ভরসা করেছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে একটি ক্লাস শিডিউল তৈরি করে দিতে বলেছিল তাঁকে। কাজটি ঠিকমতোই করেছিলেন তিনি। তবে একটু দুষ্টুমি করতে ভোলেননি। এমনভাবে শিডিউল তৈরি করেছিলেন যে একটি ক্লাসে তিনিই ছিলেন একমাত্র ছেলে। অন্য সবাই মেয়ে।
ওই কিশোরের নাম বিল গেটস। শুনলেই মাথায় আসবে মাইক্রোসফটের কথা। বিশ্বখ্যাত এই প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি, একজন ঝানু প্রযুক্তিবিদ। তবে এটিই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। বিল গেটস একজন দক্ষ ব্যবস্থাপক। শীর্ষস্থানীয় একজন ধনকুবের তিনি। সুনাম কুড়িয়েছেন অকাতর দান করে। এ ছাড়া লেখালেখিতেও বেশ পটু।
বিল গেটসের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটল শহরে, ১৯৫৫ সালের আজকের এই দিনে। সিয়াটলেই দুই বোনের সঙ্গে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর বাবা প্রয়াত উইলিয়াম এইচ গেটস ছিলেন একজন সরকারি কৌঁসুলি। মা মেরি গেটস ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা। তহবিল সংগ্রহকারী নেটওয়ার্ক ‘ইউনাইটেড ওয়ে’-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
২০০৫ সালের ৫ ডিসেম্বর স্ত্রী মেলিন্ডাকে নিয়ে ঢাকায় আসেন বিল গেটস। সেদিন দুপুরের পরপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন তিনি।
শৈশব থেকেই বিল গেটস ছিলেন ব্যতিক্রমী। ছিল কম্পিউটারের প্রতি তীব্র ঝোঁক। পরিবারও কখনো তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম সফটওয়্যার প্রোগ্রাম লেখেন বিল। হাইস্কুলে থাকতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ট্রাফ-ও-ডেটা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। রাস্তায় চলাচল করা যানবাহন সম্পর্কে স্থানীয় সরকারকে তথ্য দিত প্রতিষ্ঠানটি।
স্কুলজীবন পেরিয়ে বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বিল। তবে সেখানে বেশি দিন মন টেকেনি তাঁর। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন ত্যাগ করে ১৯৭৫ সালে শৈশবের বন্ধু পল অ্যালনের সঙ্গে মিলে মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সে সময় তাঁদের লক্ষ্য ছিল, প্রত্যেক বাসার টেবিলে যেন একটি করে কম্পিউটার থাকে। তাঁদের সে স্বপ্ন এখন যে সফল, তা বলাই চলে।
কম্পিউটারে যে ‘উইন্ডোজ’ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়, তা মাইক্রোসফটেরই তৈরি। বিশ্বের ৭২ শতাংশ কম্পিউটারে উইন্ডোজ ব্যবহার করা হয়। ১৯৮৫ সালে উইন্ডোজের ‘১’ সংস্করণ বাজারে এনেছিল মাইক্রোসফট। বর্তমানে চলছে ‘উইন্ডোজ ১১’। এ ছাড়া ‘ওয়ার্ড’, ‘এক্সেল’, ‘পাওয়ার পয়েন্ট’সহ বহু প্রযুক্তিপণ্য রয়েছে মাইক্রোসফটের। গেম খেলার জন্য রয়েছে ‘এক্সবক্স’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়েও কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে মাইক্রোসফটের মূল্য ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।
মাইক্রোসফটের শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ছিলেন বিল গেটস। ২০০০ সালে এ পদ ছাড়েন তিনি। নতুন সিইও হিসেবে দায়িত্ব দেন স্টিভ বালমারকে। ২০০৮ সালে মাইক্রোসফটে প্রতিদিন কাজ করা বন্ধ করেন বিল। ২০১৪ সালে পদত্যাগ করেন চেয়ারম্যানের পদ থেকে। তখন থেকে তিনি মাইক্রোসফটের প্রযুক্তিগত উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
মাইক্রোসফটের হাত ধরে কম রোজগার করেননি বিল গেটস। ১৯৯৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত টানা ২২ বছর মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের শীর্ষ ধনকুবেরদের তালিকায় ছিলেন। বর্তমানে তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ৪৮০ কোটি (১০৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন) ডলার। আর এখন পর্যন্ত তিনি দান করেছেন ৫ হাজার ৯০০ কোটি (৫৯ বিলিয়ন) ডলার।
বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়েও কর্মীকে নিয়ে উড়োজাহাজের ইকোনমি ক্লাসে যেতে গেটসের মধ্যে কোনো অস্বস্তি দেখা যেত না।
বিল গেটস মূলত দান করে থাকেন ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’ থেকে। মাইক্রোসফটের সিইও পদ ছাড়ার বছর, ২০০০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গেটস ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা। দীর্ঘ ২৭ বছর সংসার জীবনের পর ২০২১ সালে বিচ্ছেদ হয় তাঁদের। এই জুটির তিন সন্তান রয়েছে। বিচ্ছেদের পর ফাউন্ডেশনের একমাত্র চেয়ারম্যান এখন বিল।
যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বিপুল অর্থ দান করেছে গেটস ফাউন্ডেশন। দেশের বাইরেও তাদের দাতব্য কর্মকাণ্ড কম নয়। বিশেষ করে বিশ্বের স্বাস্থ্য খাতে খরচ করেছে হাজার হাজার কোটি ডলার। এসব দানের তালিকা বিশাল। এর মধ্যে রোগ প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কারে ১ হাজার কোটি ডলার দিয়েছে গেটস ফাউন্ডেশন। আর ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে পোলিও নির্মূলে দিয়েছে ৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। বতর্মানে তিনটি বাদে বিশ্বের সব দেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় সহযোগিতা করে থাকে গেটস ফাউন্ডেশন। সে সূত্রে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন বিল গেটস। ২০০৫ সালের ৫ ডিসেম্বরে স্ত্রী মেলিন্ডাকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। ঢাকায় ব্র্যাকের কিছু প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন তাঁরা। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্রের প্রকল্পও দেখেন।
সেদিন দুপুরের পরপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন বিল গেটস। এরপর বিকেলে হোটেল শেরাটনে (বর্তমান ইন্টারকনটিনেন্টাল, ঢাকা) কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে গোল টেবিল বৈঠক করেন। এ সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মাইক্রোসফটের ‘পার্টনারস-ইন-লার্নিং’ সমঝোতা চুক্তি সই হয়।
বিল গেটসের ওই সফর প্রথম আলোয় শিরোনামও হয়েছিল। ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিল ভারতের দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকায় তাঁর প্রায় ১২ ঘণ্টার ওই সফর দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তখন নতুন উৎসাহের সৃষ্টি করেছিল। এর এক বছর আগে ঢাকায় চালু হয়েছিল মাইক্রোসফট বাংলাদেশ অফিস।
শুরুতেই বিল গেটসের জীবনের মজার একটি ঘটনা বলা হয়েছে। এমন আরও ঘটনা রয়েছে। বিভিন্ন বই, ওয়েবসাইট ও বিলের সহকর্মীদের সাক্ষাৎকারে এসব কাহিনি উঠে এসেছে। যেমন হার্ভার্ডে পড়ার সময় যেসব কোর্সের জন্য নিবন্ধন করেছিলেন, তার একটিতেও হাজিরা দেননি। এর পরিবর্তে তাঁর ভালো লাগত যেসব ক্লাস, সেখানে বসে যেতেন। তবে তাঁর মুখস্থবিদ্যা ছিল দুর্দান্ত। ফলে চূড়ান্ত পরীক্ষায় তাঁকে আটকানো যেত না। সব সময় এ গ্রেড পাওয়া ছাত্র ছিলেন বিল গেটস।
গাড়ি চালানো নিয়েও বিল গেটসের জীবনে মজার ঘটনা রয়েছে। জোরে গাড়ি চালিয়ে একবার নয়-তিনবার জরিমানা দেওয়ার নজির আছে তাঁর। আলবুকার্ক মরুভূমিতে সাধারণত খুব জোরে গাড়ি চালাতেন গেটস। একবার এক বন্ধুর কাছ থেকে পোরশে ৯২৮ মডেলের সুপারকার ধার করে এত জোরে চালিয়েছিলেন যে তা ভেঙে যায়। এক বছর লেগেছিল তা মেরামত করতে।
ক্রোসফটের রীতি ছিল, সব কর্মীকে ইকোনমি ক্লাসে যেতে হবে। বিল গেটসও তা মেনে চলতেন। বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়েও কর্মীকে নিয়ে ইকোনমি ক্লাসে যেতে গেটসের মধ্যে কোনো অস্বস্তি দেখা যেত না। পরে অবশ্য তিনি নিজস্ব জেট বিমান কেনেন।
আরেকবার এক সাক্ষাৎকারের সময় হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে বসেন বিল গেটস। কমডেক্স নামের এক সম্মেলনের সময় কয়েকজন সাংবাদিক মিলে তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। ওই সময়কার বিখ্যাত সাংবাদিক জন ডজ খেপিয়ে দেন বিলকে। তখন তিনি উঠে বাথরুমে যান, আর সেখানে নিজেকে আটকে রাখেন। বলেন, জন ক্ষমা না চাইলে আর বেরোবেন না। জন তখন বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে বলেন, ‘আই অ্যাম সরি।’
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের নর্দান অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটির একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন বিল গেটস। সেখানে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ‘সাফল্য’ সম্পর্কে কথা বলেছিলেন তিনি। বিলের ভাষায়, ‘আমি কি বিশ্বকে কিছু দিতে পারছি’—এই প্রশ্নের জবাবেই পাওয়া যাবে সাফল্যের সংজ্ঞা।
বিল গেটস বলেন, ‘আমার বয়স যখন ২০ বছরের মতো, তখন আমি (সাফল্যের জন্য) কোনো সাপ্তাহিক ছুটি বা অবকাশযাপনে বিশ্বাস করতাম না। একপ্রকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখন আমি সাফল্যকে অন্যভাবে দেখি। আমার কাছে সাফল্য হলো, আমি কী ভুল করেছি, আর কী ঠিক করেছি, তা মানুষকে জানানো। এর মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়ন করা। সাফল্য হলো, ম্যালেরিয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জিনিসগুলোয় পরিবর্তন আনতে আমার সম্পদ বিলিয়ে দেওয়া।’
তথ্যসূত্র: গেটস নোটস, ফোর্বস, সিএনবিসি, বিজনেস ইনসাইডার, প্রথম আলো