পরিকল্পনা করলাম উত্তর গোলার্ধে সুমেরুর ভেতরের দিকে যাব। কোনো স্থল নেই পৃথিবীতে উত্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে। শীতে সাগর জমে হয় বরফের দেশ। গ্রীষ্মে গলতে থাকে কিছুটা, চক্র চলে এভাবেই। আমাদের গ্রিনল্যান্ড ভ্রমণের সময় ঠিক হলো জুলাই মাসে। এই সময়টাতে সুমেরুবৃত্তে সূর্যাস্ত হয় না। চব্বিশ ঘণ্টা, দিনের পর দিন আকাশে সূর্য। লিখেছেন রেজাউল বাহার
পৃথিবীটা আসলেই কি বেশ বড়, নাকি খুব ছোট? এর উত্তর মূলত আপেক্ষিক। মহাকাল মহাজাগতিক দিক থেকে পৃথিবী এক ধূলিকণাও নয়। অনেকটা অলৌকিক হলেও সত্য, প্রতিটা প্রাণের জন্ম এই ধূলিকণায়। লক্ষ বছর ধরে আধুনিক মানবের আবির্ভাব ও বিচরণ এ ধরায়। শখানেক বছর আগেও পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষ জীবন কাটিয়ে দিয়েছে জন্মস্থানের ৫০ মাইল সীমানার ভেতর। হাতে গোনা খুব অল্প কজন পা বাড়িয়েছে অচেনা জগতে, সাগরের ওপাশে কী আছে না জেনেই পাল তুলে দিয়েছে উত্তাল সাগরে। শখানেক বছর আগে আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্য থেকে প্রথম কমার্শিয়াল এয়ারলাইন ১৯১৪ সালের পহেলা জানুয়ারি অতিক্রম করে মাত্র ১৭ মাইল। এখন এয়ারবাস ৩৫০ এয়ারক্রাফট কোথাও না থেমে চলে যেতে পারে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। শখানেক বছর আগেও মানুষ ভাবেনি পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যাওয়ার কথা, উত্তর বা দক্ষিণ মেরু তো কল্পনার অতীত। আর এখন বিলাসবহুল জাহাজ নিরাপদ ভ্রমণে যায় পৃথিবীর সর্বশেষ প্রান্তে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আইল্যান্ড
ঠিক বছর দেড়েক আগে, শারমিন আর আমি ঘুরে এলাম দক্ষিণে এন্টার্কটিকা মহাদেশ থেকে। এরপর বাকি আছে আমাদের উত্তরে যাওয়া। পরিকল্পনা সেখান থেকেই শুরু। আমাদের যেতে হবে উত্তর গোলার্ধে সুমেরুর ভেতরে। দক্ষিণে আছে গোটা মহাদেশ, এন্টার্কটিকা। উত্তর শুধুই জলপথ, কোনো স্থল নেই পৃথিবীতে উত্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে। শীতে সাগর জমে হয় বরফের দেশ। গ্রীষ্মে গলতে থাকে কিছুটাÑ চক্র চলে এভাবেই। পৃথিবীর আটটি দেশের কিছু অংশ পড়েছে সুমেরু বৃত্তে। রাশিয়ার সাইবেরিয়া, আমেরিকার উত্তরাঞ্চল, নরওয়ে-সুইডেন-ফিনল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল। সবচেয়ে বড় যে দেশটি সুমেরু বৃত্তে পড়ে আছে তা হলো গ্রীনল্যান্ড। নাম শুনে সবুজ মনে হলেও গ্রিনল্যান্ড প্রায় সম্পূর্ণ ঢাকা সাদা বরফে। গ্রিনল্যান্ড পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আইল্যান্ড । ভৌগোলিকভাবে উত্তর আমেরিকার অংশ হলেও রাজনৈতিকভাবে দেশটি ইউরোপের অংশ। স্বায়ত্তশাসিত এই দেশটি ডেনিশ রাজ্যের অংশ। বহু আগে নির্বাসিত ভাইকিংস চালাকি করে এর নাম রাখেন গ্রিনল্যান্ড। যেখানে মানুষের থাকা প্রায় অসম্ভব, তার নাম গ্রিনল্যান্ড করার উদ্দেশ্য ছিল অন্য নাবিকদের আকৃষ্ট করা; কিছু মানুষকে আকৃষ্ট করে জনবসতি তৈরি করা।
গ্রিনল্যান্ডে আদিবাসীরা আসে মূলত রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে, সে বহু বছর আগের কথা। আদিবাসীরা পরিচিত ‘ইনউইট’ নামে। পরবর্তী সময়ে ডেনিশ ও ইউরোপিয়ানদের আগমনে ধীরে ধীরে মানুষের মিশ্রণ হতে থাকে। আকারে দেশটি অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ, বা পশ্চিম ইউরোপের সমান। মোট জনসংখ্যা ৫৬ হাজার। প্রতি এক হাজার বর্গকিলোমিটারে মানুষের সংখ্যা মাত্র তিন জন। এখানে মানুষের অবস্থান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, রাস্তাঘাটের সংযোগ নেই। জনবসতি মূলত বিচ্ছিন্ন। যোগাযোগের উপায় নৌকা বা ছোট জাহাজ। কিছু শহরে যাতায়াত করতে হয় প্লেনে। এখানে ফ্লাইটগুলো আসে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন থেকে। গ্রীষ্মের কয়েক মাস অল্প কিছু ফ্লাইট যাতায়াত করে প্রতিবেশী দেশ আইসল্যান্ড থেকে।
যখন চব্বিশ ঘণ্টাই দিন
আমাদের গ্রিনল্যান্ড ভ্রমণের সময় ঠিক হলো জুলাই মাসে। বছরের বেশিরভাগ সময় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে থাকলেও জুলাই-আগস্টে গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ অংশে তাপমাত্রা ঘোরাঘুরি করে হিমাঙ্কের আশপাশে। এই সময়টাতে সুমেরু বৃত্তে সূর্যাস্ত হয় না। চব্বিশ ঘণ্টা দিনের পর দিন আকাশে সূর্য। এই সময়টিতেই বেশিরভাগ পর্যটকের আগমন গ্রিনল্যান্ডে। সাত মাস আগে থেকেই আমাদের পরিকল্পনা শুরু। এয়ার টিকিট, থাকার ব্যবস্থা, ঘোরাঘুরির সব জায়গা ঠিক করে নেওয়াÑ সবই বেশ আগে থেকেই প্ল্যান করা। এর মূল কারণ সময়টা ট্যুরিজমের। সীমিত ফ্লাইট আর পছন্দের থাকার ব্যবস্থা আগ থেকে না করলে ভোগান্তি হবে। এমনিতেই সুমেরু বৃত্তে ভ্রমণ ব্যায়বহুল। আগে থেকে পরিকল্পনা না করলে তা চলে যেতে পারে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
উত্তর মেরু যাত্রা
আমাদের যাত্রা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহর থেকে। সেখান থেকে আইসল্যান্ড হয়ে গ্রীনল্যান্ডের নুক শহরে। নুক গ্রীনল্যান্ডের রাজধানী। শহর বললে হয়তো বেশ বড় কিছু মনে হতে পারে। রাজধানী কতটা বড় বা ছোট সেটা বোঝা যাবে এক কোথায়Ñ পুরো শহরে মোট ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট তিনটি। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে অবস্থিত নুক। এখানে কিছুদিন থেকে আমরা যাব ইলিউলিসাতে।
ইলিউলিসাত গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিমে মাঝামাঝিতে সুমেরু বৃত্তের ভেতরে এর অবস্থান। আর এটাই আমাদের উত্তর মেরু যাত্রা। এখানে থাকব কিছুদিন। ভ্রমণের অংশ হিসেবে কয়েকটা বোট ট্যুরে বের হব আমরা। কখনও তিমির আনাগোনা দেখা, কখনও সাগরের তীর ঘেঁষে খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে মাছ ধরা, সেই মাছ নিয়ে যাওয়া অন্য এক একাকী নির্বাসিত দ্বীপে। এখানে আছে রেস্তোরাঁ। বছরের সাময়িকভাবে পর্যটকদের জন্যই করা হয়েছে এই রেস্তোরাঁ। তাজা মাছ প্রস্তুত করে রান্না করা, রাতে খাবার শেষে আবার বোটে করে ফিরে আসা নিজস্ব দ্বীপে। রাত বলাটা ভুল হলো। সময়ের দিক থেকে তখন অনেক রাত। কিন্তু সূর্য দিগন্তে ঘেঁষে বেড়াচ্ছে সারাবেলা। গ্রীনল্যান্ডের মূল ভূখণ্ডে শীতে সূর্যোদয় হয় না; গ্রীষ্মে সূর্য ডোবেও না। এর মূল কারণ পৃথিবীর ঘূর্ণনের অক্ষ। শীতে উত্তর মেরু সরে যায় সূর্যের বিপরীতে, গ্রীষ্মে ঠিক বিপরীত।
আইসবার্গের মাঝে এক অপার্থিব জগৎ
মিডিয়াতে কেউ যখন উত্তর মেরুর ছবি খোঁজে, বেশিরভাগ ছবিই চলে আসে ইলিউলিসাত বা তার আশপাশ থেকে। গ্রিনল্যান্ডের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা, যা বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট যে জায়গায় ভ্রমণ করেন তা হলো এই ইলিউলিসাত। এখানেই বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল গ্লেসিয়ার। শত সহস্র বছরের জমে থাকা বরফ চাপে নেমে আসতে থাকে সাগরের বুকে। তৈরি হয় আইসবার্গ।
ধীরে ধীরে চলতে থাকে মূল সাগরের দিকে। ইলিউলিসাতের এই গ্লেসিয়ার থেকে নেমে আসা আইসবার্গ তৈরি করে এক অপার্থিব জগৎ। খুব ছোট ছোট ট্যুরিস্ট বোট ঘুরে বেড়ায় আইসবার্গের কাছ ঘেঁষে। আমাদের ইচ্ছে ছিল একটা বোট প্রাইভেটভাবে ভাড়া নিয়ে নিজের মতো করে এই অপার্থিব সৌন্দর্য দেখা। ১৯৭০-এর দিকে ডেনমার্কে তৈরি কাঠের বোট। প্রথমে পুলিশ বোট হিসেবে ব্যবহার হতো, পরে ট্যুরিজমের কাজে। লাল রঙের কাঠের তৈরি বোট, ইন্টারনেটে ছবি দেখেছি এ ধরনের বোটের। ভেসে বেড়াচ্ছে বরফের রাজ্যে। আধুনিক লোহালক্কড়ের বোটের চেয়ে এই প্রাচীন বোটে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ভিন্নরকম। পরিকল্পনামতোই কাজ হলো।
আমরা প্রায় শখানেক দেশ ভ্রমণ করেছি গত ১৫ বছরে। আমাদের ভ্রমণের সবচেয়ে সুন্দর কিছু ফুটেজ তৈরি হলো এই কাঠের তৈরি পুরোনো লাল রঙের বোটকে ঘিরে। আমার সঙ্গে ছিল ড্রোন- কখনও দূরত্ব রেখে, কখনও ওপর থেকে, কখনও শান্ত সাগরের খুব কাছ ঘেঁসে ড্রোন ফুটেজগুলো নেওয়া হচ্ছে। ছোট একটা বোট হারিয়ে যাচ্ছে নিথর সাগরের বুকে ভেসে যাওয়া অগণিত বরফের দেশে। ভাসছে বরফ। ভেসে যাচ্ছে লাল ছোট এক বোট। খোলা বোটে আমি আর শারমিন।
মাঝে মাঝে মনে হয় অনেকটা পথ চলে এসেছি। কখনও মনে হয় পৃথিবীটা আর একটু বড় হলে ভালো হতো! আবার মনের গভীরে জেগে ওঠে সেই প্রশ্ন- কতটা সময় বাকি আছে? ভ্রমণ নিয়ে তৃষ্ণা আমার মেটেনি। এ তৃষ্ণা মেটার নয়। এ জগৎ দেখার এক নেশা চেপে বসেছে আমাকে। এক দেশ থেকে অন্য দেশ। এক দুই তিন করে প্রায় শখানেক। মানুষের তৈরি অদৃশ্য সীমানা পেরুলেই নতুন দেশ। আসলেই সীমানা বলে কি কিছু আছে? মানুষের তৈরি অর্থহীন এই সংখ্যা। তার পরও এ বছরটাতেই শারমিন আর আমি একসঙ্গে পেরিয়ে যাব ৭ মহাদেশের একশো দেশ। মানুষের তৈরি অর্থহীন সংখ্যার মাইলফলক ছুঁয়ে দেখার অনুভূতিও কম নয়।