যুক্তরাষ্ট্র তখন সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। স্বাধীনতা অর্জনের দেড় দশকও পেরোয়নি। প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ঘোষণা দিলেন, ফেডারেল সরকার নতুন একটি শহর গড়বে। সেটা হবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী। ১৭৯০ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইনও পাস করালেন জর্জ ওয়াশিংটন। বলা হলো, নতুন রাজধানী হবে পটোম্যাক নদীর তীরে।
শহরটি গড়ে তোলার দায়িত্ব পড়ে ফরাসি–আমেরিকান শিল্পী ও নগর পরিকল্পনাবিদ পিয়েরে চার্লস এনফ্যান্টের ওপর। গড়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি। নতুন রাজধানী হবে, আর সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য বড়সড় কোনো ভবন থাকবে না, তা কী করে হয়!
প্রয়োজনে আর প্রেসিডেন্টদের রুচি–পছন্দ অনুযায়ী সময়ে সময়ে সরকারি এই ভবনে নানা সংস্কার হয়েছে। বদলেছে এর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা। যুক্ত হয়েছে বহু অংশ। তবে বাহ্যিকভাবে সেই শ্বেতশুভ্র রূপ নিয়ে ২০০ বছরেরও বেশি সময়ের ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই বাড়ি।
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। প্রেসিডেন্টের সরকারি আবাসস্থল বানানোর জন্য জায়গা খুঁজতে শুরু করলেন ওয়াশিংটন আর পিয়েরে। তখন ১৭৯১ সাল, এখন যেটা ১৬০০ পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউ, সেখানে জায়গা পছন্দ হলো বটে। এখন দরকার ভবনের নকশা। আর এটা এমন একটি ভবন হতে হবে, যার মাধ্যমে আমেরিকার গর্বের প্রকাশ ঘটাবে। সেই সঙ্গে হয়ে উঠবে গণতন্ত্রের প্রতীক।
প্রেসিডেন্ট ভবনের জন্য স্থপতিদের কাছ থেকে নকশা আহ্বান করা হয়। শুরু করা হয় একটি প্রতিযোগিতা। জমা পড়ে মোট নয়টি নকশা। নানা যাচাই–বাছাই পেরিয়ে শেষ হাসি হাসেন আইরিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকান স্থপতি জেমস হোবান। ভবনটি নির্মাণের জন্য চূড়ান্ত হয় তাঁর নকশা। ‘বাস্তবসম্মত আর স্মার্ট’ নিও–ক্লাসিক্যাল নকশার জন্য তিনি গোল্ড মেডেল পান।
১৭৯২ সালের ১৩ অক্টোবর, আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সরকারি আবাসস্থলের নির্মাণকাজ। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের হাত ধরে এই কাজের শুরু। যদিও তিনি কখনোই হোয়াইট হাউসে থাকতে পারেননি।
জর্জ ওয়াশিংটন এমন জায়গায় প্রেসিডেন্টের আবাসস্থলের জায়গা বেছে নেন, সেখান থেকে পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউ দিয়ে মার্কিন পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে সরাসরি যাওয়া যাবে। বছর আটেক নির্মাণকাজ চলে। অবশেষে ১৮০০ সালের ১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শেষ হয়। যদিও টুকটাক কিছু কাজ তখনো বাকি ছিল।
এর বছরখানেক আগে ১৭৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর ৬৭ বছর বয়সে মারা যান জর্জ ওয়াশিংটন। নির্মাণকাজ শেষ হলে এই ভবনের প্রথম বাসিন্দা হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস ও তাঁর স্ত্রী। এর পর থেকে যতজন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, প্রায় সবার আবাসস্থল হয়েছে এটা।
হোয়াইট হাউস শুধু মার্কিন প্রেসিডেন্টের সরকারি আবাস নয়, এখানে আছে প্রেসিডেন্টের দপ্তর বা ওভাল অফিস। ছয়তলা আবাসিক ভবনটিতে আছে ১৩২টি কক্ষ, ৩৫টি বাথরুম, ৪১২টি দরজা, ১৪৭টি জানালা। ৮টি সিঁড়ি, ৩টি লিফট আর ২৮টি ফায়ারপ্লেস আছে এই ভবনে।
প্রয়োজনে আর প্রেসিডেন্টদের রুচি–পছন্দ অনুযায়ী সময়ে সময়ে সরকারি এই ভবনে নানা সংস্কার হয়েছে। বদলেছে এর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা। যুক্ত হয়েছে বহু অংশ। তবে বাহ্যিকভাবে সেই শ্বেতশুভ্র রূপ নিয়ে ২০০ বছরেরও বেশি সময়ের ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই বাড়ি।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের আবাসস্থল দুবার ভয়াবহ আগুনে পুড়েছে। প্রথমবার, ১৮১৪ সালে। যুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের হাতে। পরেরবার, ১৯২৯ সালে। তখন হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইংয়ে আগুন লাগে। দুবারই ভবনটির বড় ধরনের সংস্কার করতে হয়। প্রথমবার জেমস হোবান নিজে সংস্কার করেন।
‘প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ’, ‘প্রেসিডেন্ট হাউস’, ‘এক্সিকিউটিভ ম্যানসন’—এক শতক ধরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছে এই ভবন। সরকারি নথিপত্র ও গণমাধ্যমে বহুল ব্যবহৃত এসব নাম ব্যবহার করা হতো। অবশেষে ১৯০১ সালে প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট ভবনটির নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ‘হোয়াইট হাউস’ রাখেন। সেই থেকে ঐতিহাসিক ভবনটি এ নামেই পরিচিত হয়ে আসছে।
প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের আমল থেকে সর্বসাধারণের জন্য হোয়াইট হাউস উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেই থেকে আজও দেশ–বিদেশের হাজারো মানুষ হোয়াইট হাউসের নির্দিষ্ট অংশ ঘুরে দেখতে পারেন।
হোয়াইট হাউস শুধু মার্কিন প্রেসিডেন্টের সরকারি আবাস নয়, এখানে আছে প্রেসিডেন্টের দপ্তর বা ওভাল অফিস। ছয়তলা আবাসিক ভবনটিতে আছে ১৩২টি কক্ষ, ৩৫টি বাথরুম, ৪১২টি দরজা, ১৪৭টি জানালা। ৮টি সিঁড়ি, ৩টি লিফট আর ২৮টি ফায়ারপ্লেস আছে এই ভবনে।
হোয়াইট হাউসের রান্নাঘর একসঙ্গে ১৪০ জন অতিথির জন্য খাবার পরিবেশন করতে সক্ষম। বলা হয়ে থাকে, হোয়াইট হাউসের শুধু বাইরের অংশ রাঙিয়ে তুলতে ৫৭০ গ্যালন রং প্রয়োজন হয়েছে। হোয়াইট হাউসে দুটি সুইমিং পুল আছে। প্রথমটি চালু হয় ১৯৩৩ সালের ২ জুন।
গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি হোয়াইট হাউসে থাকা অবস্থায় বিয়ে করেছিলেন। কনে ছিলেন ফ্রান্সিস ফলসম। ১৮৮৬ সালের ২ জুন হোয়াইট হাউসের ব্লু রুমে বসেছিল এই বিয়ের আসর।
সময়টা ১৮৪১ সালের ৪ এপ্রিল, প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন হোয়াইট হাউসে থাকা অবস্থায় মারা যান। তিনি হোয়াইট হাউসে মারা যাওয়া প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অভিষেকের মাত্র মাসখানেকের মাথায় মৃত্যু হয় তাঁর। দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহাসিকেরা বিশ্বাস করতেন, নিউমোনিয়ায় ভুগে মারা গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট হ্যারিসন। পরে জানা যায়, তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়তো টাইফয়েড।
প্রেসিডেন্ট টেইলর ১৮৫০ সালের ৯ জুলাই হোয়াইট হাউসে মারা যান। কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। এ দুজন ছাড়া হোয়াইট হাউসে এখন পর্যন্ত আর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হয়নি।
হোয়াইট হাউসে থাকা অবস্থায় এখন অবধি তিনজন ফার্স্টলেডির মৃত্যু হয়েছে। ১৮৪২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মারা যান ফার্স্টলেডি লেটিসিয়া টেইলর। স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ফার্স্টলেডি ক্যারোলিন হ্যারিসন মারা যান ১৮৯২ সালের ২৫ অক্টোবর। আর দীর্ঘদিন কিডনির জটিলতায় ভুগে ১৯১৪ সালের ৬ আগস্ট মৃত্যু হয় ফার্স্টলেডি অ্যালেন উইলসনের।
বর্তমানে হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আসছে নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে জিতে হোয়াইট হাউসে যাওয়ার জোর লড়াইয়ে নেমেছেন কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। কমলা বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর ট্রাম্প সাবেক প্রেসিডেন্ট। এর আগে ২০১৭–২০২১ সাল পর্যন্ত ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা ছিলেন।
তথ্যসূত্র: হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইট ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভ