পথে নামতেই ওয়াডিগালার কাছেই একটা বৌদ্ধবিহার। আজ শ্রীলঙ্কার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সাদা জামা পরে হাতে ফুলের ডালি নিয়ে সবাই ছুটছে বিহারের দিকে। আশপাশের সব টগরগাছ ফুলশূন্য হয়ে গেছে। পদ্মপাতার ওপরের টলমলে পানির একটা পুকুর পেরোলাম। রাস্তায় ছোট ছোট চড়াই-উতরাই। অবশ্য বিনা ক্লেশেই পার হওয়া যায়। রাস্তার একপাশে প্রকাণ্ড সব শিরীষগাছের চাঁদোয়া। বেশ ছায়া মিলল কিছুক্ষণ। কিছু দূর এগিয়ে পদ্মপাতার ওপর দণ্ডায়মান ভগবান তথাগতের মূর্তি পাওয়া গেল। বুদ্ধদেবের মতোই শান্ত, মৌনী এই দ্বীপরাষ্ট্রের অধিবাসীরা। ভেবেই পাই না, তারা কীভাবে ২৬ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ করেছে! অস্ত্র ধরেছে দেশের একই জল-মাটি-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আরেকজনের বিরুদ্ধে! যুদ্ধ মানেই সহিংসতা, যুদ্ধ মানেই নিয়মের ব্যত্যয়। এ যুদ্ধ কত বৃদ্ধ পিতার কাঁধে জোয়ান ছেলের লাশ উঠিয়েছে।
পরের জনপদ নেটলপিটিয়া। গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছি আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য পয়েন্ট ডন্ড্রার দিকে। শ্রীলঙ্কার সর্বদক্ষিণের বিন্দু আর দূরের কোনো অধরা গন্তব্য নয়। রাস্তার কালো পিচে আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপের সঙ্গে কমছে গন্তব্যের দূরত্ব। অবশ্য লক্ষ্যে পৌঁছানোর আনন্দের সঙ্গে খানিকটা মন খারাপের অনুভূতিও আছে। গতকাল থেকে অপরিচিত কোনো গন্তব্য নেই। নতুন জায়গায় সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত দেখার আনন্দ থেকেও হতে হবে বঞ্চিত। হাঁটতে হাঁটতে অসম্ভব সুন্দর এই দ্বীপরাষ্ট্রের ধুলা-কাদা মাখার গল্পও কাল থেকে অপেক্ষা করে থাকবে না।
শ্রীলঙ্কার উত্তর উপকূলের পর আবার দক্ষিণ উপকূলে এসে মেক্সিকান ক্রিপারের প্যাঁচানো লতার দেখা পেলাম। কিছু দূর এগিয়ে মারাকোল্লিয়া। এখান থেকে খানিক এগিয়ে নাশতার বিরতি। ইডিয়াপ্পাম দিয়ে নাশতা সারতে সারতেই ঝুম বৃষ্টি। খাবার অনেক ক্ষেত্রেই নয়নসুখের ব্যাপার। এর অনেক পরে আসে স্বাদ আস্বাদন। সেদিক থেকে এই ইডিয়াপ্পাম একেবারে উতরে গেছে। নাশতা শেষ হতে হতে আকাশ থেকে শেষ বৃষ্টির ফোঁটাটিও অন্তর্হিত। টানগাল্লেতে রাস্তার ধারেই কার্তিক আর বুদ্ধ একই সঙ্গে পূজিত হচ্ছেন। টানগাল্লে বেশ বড় শহর। শহরের নানা গাছের ডালে মুখপোড়া হনুমানদের দেখা পাওয়া যায় সহজেই। শহরের শেষ মাথায় দীর্ঘ ১৭ দিন পর সমুদ্র দেখলাম। ভারত মহাসাগরের শুভ্র জলরাশি মাথায় ফেনা নিয়ে তীরের প্রবালে লুটোপুটি খাচ্ছে। এখানে সৈকতটা ‘ইউ’ আকৃতির। আজকের বাকি পথটুকু সাগরের তটরেখা ধরেই।
গোয়ামবোক্কা থেকে ছোট ছোট চড়াই সমুদ্রের ধার ঘেঁষেই। উনাকুরুয়ায় চোখে পড়ল ডাইভিং সেন্টার। জুমন ভাই আর আমি দুজনেই সার্টিফায়েড ডাইভার। একজন পিএডিআই, অন্যজন ডিআইডব্লিউএ সার্টিফায়েড ডাইভার। ডাইভিং সেন্টারের পর শুরু হলো সার্ফিং সেন্টারের রাজত্ব। কক্সবাজারে থাকাকালীন সার্ফিং নামের খেলাটা শিখেছিলাম। পুরোপুরি বাগে আনা হয়নি সপ্তাহান্তের ছুটিগুলোতে অন্য অ্যাক্টিভিটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায়। নাকুলুগামুওয়া ছাড়িয়ে মোরাকেতিওয়ারা। এর পরের পথ মাওয়াল্লা লেগুনের পাশ দিয়ে। গজিয়ে ওঠা রিসোর্ট আর রেস্তোরাঁর জন্য লেগুনের দেখা মেলে দুই গলির মাঝের ফাঁকা অংশে। একটু এগিয়েই ঢুকলাম মাতারা জেলায়।
ছোটবেলায় ‘মাতারা’ নামটা শুনেছি সনাৎ জয়াসুরিয়ার কল্যাণে। ওয়ানডে ক্রিকেটের খোলনলচে বদলে দেওয়ার কারিগরদের সামনের সারির মানুষ জয়াসুরিয়া। বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ের কারণে লোকে ডাকত ‘মাতারা হারিকেন’ নামে। এদিকের রাস্তার প্রতিটা দেয়ালে খুব সুন্দর গ্রাফিতি করা। দেখেই বোঝা যায়, জাত শিল্পীদের হাত পড়েছে দেয়ালে। শ্রীলঙ্কার প্রতিটি বাড়িতেই এখনো লাল রঙের লেটার বক্স দেখা যায়। এ দেশে তবে হলুদ খামের চিঠির চল একেবারে উঠে যায়নি। আমাদের দেশ থেকে সেই কবে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে!
মহাওয়েলা থেকে শহুরে ভাবটা আর নেই। রাস্তার ধারে বনতুলসীর ঝোপ দেখতে দেখতে পথচলা। আজ পথ চলছি এ-২ মহাসড়ক ধরে। চলতে চলতে জুমন ভাইকে বললাম, ‘আপনি উদ্ভিদবিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে আমাকে পুরো ভ্রমণে একটা নতুন গাছও চেনাতে পারলেন না। এই দুঃখ আমি কই রাখি!’
একটুও না দমে জুমন ভাইয়ের উত্তর, ‘মাহগনি আর অকালনন্দা কি আর তুই চিনতি?’ ভালো কথা, জুমন ভাইকে এই দুটি গাছ আমিই চিনিয়েছি। তবে তারপর জুমন ভাইয়ের ভ্রষ্ট উচ্চারণে মেহগনি হয়ে গেছে ‘মাহগনি’ আর অলকানন্দা হয়ে গেছে ‘অকালনন্দা’!
ডিকভেলার কাছে এক জায়গায় জুস পানের বিরতি। এমন ভালো কমলার জুস বহুদিন খাইনি। দুটি দারুণ সুন্দর ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতির সৈকত এখানে পাশাপাশি। ইংরেজি ছাড়াও রুশ ভাষায় অনেক সাইনবোর্ড নজরে আসছে। প্রচুর সাদা চামড়ার পর্যটক
এখানে। স্কুটার ভাড়া নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমরা এখানে ভিনদেশি হলেও গাত্রবর্ণের কারণে লোকে ভাবে শ্রীলঙ্কান। সমুদ্রসৈকতও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে পথ চলছে। এখানকার সৈকতের পাশে নারকেলবীথিকা। এদের চওড়া মাথায় হাওয়ার দাপটের শব্দ। জুস পানের বিরতি শেষে এক কিলোমিটার এগোতে না এগোতেই বৃষ্টির দাপটে আবার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। গোদাউদা নামের এক বাড়ন্ত জনপদ ছাড়িয়ে কোট্টাগোড়া।
টালাল্লায় আবার সেই ‘ইউ’ আকৃতির বাঁকানো চোখধাঁধানো সৈকত। পাড়ে বিশাল সব প্রবাল পাথরের জন্য আরও মোহনীয়। পরশপিপুল গাছের ফাঁকে ফাঁকে কেয়াগাছের ঝোপ। এখানেই আবার বৃষ্টির বাধা। ঝেঁপে বৃষ্টি এল। একটা ছাউনির নিচে ঠাঁই নিলেও সহসা থামল না বৃষ্টি। এবার বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। একটা ছোট রাস্তা ধরলাম। খানিকটা উঁচু–নিচু ওই রাস্তায় চড়াইগুলোতে ওপর থেকে আসা হঠাৎ বৃষ্টির পানিতে নাজেহাল হতে হলো খানিকক্ষণ। মাথার ওপর গামলা-ঢালা বর্ষণ আর পেটের খিদেতে বেশ নাজুক অবস্থা। গান্দারা মোড়ে একটা হোটেল পেয়ে বিকেল সোয়া চারটা নাগাদ দুপুরের খাবার সারতে বসলাম। এখান থেকে পয়েন্ট ডন্ড্রা সাড়ে চার কিলোমিটার। বৃষ্টির তীব্রতা বেড়েছে আরও। এর মধ্যেই হেঁটে চলছি।
দেবীনুয়ারা ক্লক টাওয়ার থেকে মোড় নিলাম বাঁয়ে। সাইনবোর্ড জানাচ্ছে, আর এক কিলোমিটার দূরেই ডন্ড্রার বাতিঘরটি। ‘দেবীনুয়ারা’ শব্দটি সিংহলা ভাষায় ডন্ড্রার প্রতিশব্দ। অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘ঈশ্বরের শহর’। ঈশ্বরের শহরে ঢুকে জুমন ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজকের হোটেল যদি পয়েন্ট ডন্ড্রা থেকে দূরে হয়, তাইলে কী করবেন?’ জুমন ভাইয়ের চটপট উত্তর, ‘আমার জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে নিস!’
রাস্তায় জমা পানি ডিঙিয়ে ভারত মহাসাগরের তটে। বাতিঘরের ফটক বন্ধ হয়ে যাবে কিছু পরেই। পয়েন্ট পেড্রো থেকে হেঁটে এসেছি শুনে কেয়ারটেকার ভদ্রলোক নিজেই ছবি তুলে দিলেন বৃষ্টির ছাঁট উপেক্ষা করে। ডন্ড্রার বাতিঘরটি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে উঁচু বাতিঘর। ১৬০ ফুট উঁচু এই বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছে ১৮৯০ সালে। এর পাদদেশেই শ্রীলঙ্কার সর্বদক্ষিণের বিন্দুর সাইনবোর্ড ও লেটার বক্স। ঠিক পাশেই ভারত মহাসাগরের দুগ্ধফেনিল উত্তাল জলরাশি। জুমন ভাই আর আমি একে-অপরকে আলিঙ্গন করে অভিবাদন জানালাম। পায়ে পায়ে চলার ১৭ দিন পর জুতা তুলে রাখার পালা সমাগত। একটা ব্যাপার নিশ্চিত হলাম, আমি এই দ্বীপরাষ্ট্র ছেড়ে গেলেও দ্বীপরাষ্ট্রটি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না!