মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১৪ অপরাহ্ন
Uncategorized

অভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষায় তরুণীদের সর্বনাশ

  • আপডেট সময় শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০২১

চীনা ভিডিও শেয়ারিং সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং পরিষেবা টিকটকের ফাঁদে ফেলে দেশ থেকে প্রতি বছর পাচার হচ্ছেন শত শত নারী। ছয় ধাপে তাদের পাচার করা হয় ভারত, দুবাই মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি দেশে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিংবা অল্পবয়সি তরুণীরা এদের মূল টার্গেট। তবে ক্ষেত্রভেদে বিবাহিত নারীরাও তাদের টার্গেটে পরিণত হন।

টিকটক সেলিব্রেটি বানিয়ে খ্যাতি অর্জন ও অর্থ উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ভারতে নেয় আন্তর্জাতিক চক্র। সেখানে তাদের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নির্যাতিতদের অনেকে আবার এক সময় সব মেনে নিয়ে নিজেই গড়ে তোলে পাচার সিন্ডিকেট। এভাবে বছরের পর বছর পাচার কাজ চালিয়ে আসা এ চক্রের বড় একটি অংশকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। নজরদারিতে রয়েছেন আরও অনেকে।

সম্প্রতি ভারতে তরুণী নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর দেশে ও ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন চক্রের ৩২ জন। এদের মধ্যে বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়া ২০ জনের মধ্যে ১৩ জনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে নারী পাচারের কৌশল ও নেপথ্য কাহিনি।

গ্রেফতারকৃতদের দেওয়া তথ্য ও পুলিশের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, মোট ছয় ধাপে ভারতে নারী পাচার করত আন্তর্জাতিক চক্রটি। প্রথম ধাপে দেশে নারীদের টার্গেট করে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সীমান্তে নিয়ে ভারতীয় দালালদের হাতে হস্তান্তর করা হয়। সীমান্ত পার হওয়ার ক্ষেত্রে যোগাযোগে ব্যবহার হয় ভারতীয় সিমকার্ড।

দ্বিতীয় ধাপে সেখান থেকে তাদের নেওয়া হয় ভারতীয় পাচারকারী চক্রের ‘সেফ হোম’-এ। পরের ধাপে তৈরি হয় পাচারকৃত নারীর পরিচয়পত্র (আধার কার্ড)। এরপর ধাপে ধাপে সেখান থেকে বিমানে বেঙ্গালুরু ও চেন্নাই পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেখানকার সেফ হোমে।

ভারতের সেফ হোমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে পাচার হওয়া নারীরা বুঝতেই পারেন না তাদের ওপর কি ধরনের নির্যাতন অপেক্ষা করছে। কারণ এই জায়গা থেকেই পাচারকৃতদের পাঠানো হয় বিভিন্ন আবাসিক হোটেল ও ম্যাসাজ পার্লারে।

ভারতে পাচার হয়ে ৭৭ দিন নির্মম নির্যাতন সয়ে দেশে ফেরা এক তরুণীর সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। ওই তরুণী এবং গ্রেফতারকৃতদের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

তরুণীরা জানান, দেশে যশোর ও সাতক্ষীরা সীমান্তে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় চক্রটি। আর ভারতে চক্রটির মূল আস্তানা বেঙ্গালুরুর আনন্দপুরা এলাকায়। তবে চক্রটি হায়দরাবাদ, চেন্নাইসহ আরও কয়েকটি এলাকার আবাসিক হোটেল ও ম্যাসাজ পার্লারে নিয়মিত নারী সরবরাহ করে থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের অপরাধীদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এ চক্র। যাদের সঙ্গে ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু হোটেলের চুক্তি রয়েছে। যে হোটেলগুলোতে পতিতাবৃত্তির জন্য চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের পাঠায় চক্রটি।

সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া চক্রের সদস্য মেহেদী হাসান বাবু (৩৫) একাই এক হাজারের বেশি নারী পাচার করেছে। সে ৭-৮ বছর পাচার কাজে জড়িত ছিল। একই এলাকা থেকে গ্রেফতার অপর দুই পাচারকারী মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের পাঁচ শতাধিক নারীকে ভারতীয় দালালদের হাতে তুলে দিয়েছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। নারী পাচারের এ কাজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের একটি অংশ জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ভারতে নারী নির্যাতন ও নারী পাচারের পুরো সিন্ডিকেটটিকে শনাক্ত করতে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে এদের বড় একটি অংশকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিন্ডিকেটের অন্যান্য হোতাদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনতে কাজ চলছে। নির্যাতনের শিকার তরুণী ও এ ঘটনায় জড়িতদের দেশে ফিরিয়ে আনতে পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখার মাধ্যমে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পাশাপাশি কয়েকটি টিকটক গ্রুপ, পেজ ও অ্যাডমিনদের ওপরেও চলছে নজরদারি।

পুলিশ বলছে, পাচারকৃত নারীদের নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। ভারতে প্রবেশের পর নির্ধারিত সেফ হোমে পাচার করা নারীকে নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনে বাধ্য করে চক্রটি। এরপর জোরপূর্বক বিবস্ত্র করে স্থিরচিত্র ও ভিডিও ধারণ করা হয়। কখনো কখনো ধর্ষণ ও গণধর্ষণেরও ভিডিও করে তারা। পাচার করা নারীরা চক্রের অবাধ্য হলে বা পালানোর চেষ্টা করলে সেগুলো সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করা বা পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের কাছে পাঠানোর হুমকি দেয়।

অবাধ্য হলে পাচার করা নারীকে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। অনেক সময় তাদের আটকে রাখা হয় বদ্ধ অন্ধকার ঘরে। দেওয়া হয় না খাবার, পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।

পুলিশ ও ভারত থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা তরুণীরা জানায়, অ্যাপটিতে ৩-১৫ সেকেন্ডের শর্ট মিউজিক, লিপ-সিঙ্ক, নাচ, কৌতুক এবং ৩-৬০ সেকেন্ডের শর্ট লুপিং ভিডিও তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। টিকটক আইডিধারী ব্যক্তি উপার্জনের জন্য ‘স্পন্সর’ বা ‘ব্র্যান্ড ডিল’ করে। যার ফলোয়ার যত বেশি, সে স্পন্সরশিপের জন্য তত বেশি টাকা পায়।

উদাহরণস্বরূপ কারও এক লাখ ফলোয়ার থাকলে সে মাসে ১০-৩০ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারে। এভাবে ফলোয়ার বাড়ানোর প্রলোভন দেখিয়ে চক্রটি আয়োজন করে ‘হ্যাংগআউট’ ও ‘পুল পার্টি’। যেখানে শত শত তরুণী যায়। ওইসব পার্টি থেকেই টার্গেট করা হয় মেয়েদের। পার্টিগুলো থেকে টিকটক সেলিব্রেটি বানিয়ে খ্যাতি ও অর্থ উপার্জনের কথা বলা হয়।

এছাড়া ভিডিওর ভিউ বাড়াতে মনোমুগ্ধকর স্থানে শুটিংয়ের জন্য সীমান্তবর্তী লোকেশনে শুটিং স্পট নির্বাচনের ফাঁদে ফেলা হয়। বলা হয়, বিদেশে সুপারশপ ও বিউটি পার্লারে উচ্চ বেতনে চাকরির কথা। এরপর তাদের পাচার করা হয়।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হাফিজ আল ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ভারতে এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর নারী পাচারের ঘটনায় মোট ছয়টি মামলা হয়েছে। মানব পাচারে জড়িত ২০ জন এখন পর্যন্ত দেশে গ্রেফতার হয়েছে। চক্রটির মূলোৎপাটনে অন্যদের গ্রেফতারে দফায় দফায় অভিযান চলছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com