বেসরকারি খাতে পরিচালিত ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ১৮ হাজার কোটি টাকা এস আলম গ্রুপ একাই নিয়েছে; যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৬৪ শতাংশ। এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে কাল্পনিক লেনদেনের মাধ্যমে, যার জামানতও নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। আবার ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪২ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়ছে বলে ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তারা জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ ৪ শতাংশের কম।
নানা অনিয়মের কারণে আর্থিক বিপর্যয়ে পড়া এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এক মাস আগে পুনর্গঠন করে এস আলমমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পাঁচজন স্বতন্ত্র পরিচালক। এরপরও ব্যাংকটিতে এস আলমের প্রভাব কমেনি। ফলে পরিচালকেরা প্রকৃত চিত্র জানতে পারছেন না। ব্যাংকটি স্বয়ংক্রিয় তথ্যভান্ডার থেকে এস আলমসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের ঋণ ও লেনদেনের তথ্য সরিয়ে ফেলেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। ফলে প্রকৃত তথ্য বের করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এস আলমের ঋণ ও আমানতের বিষয়ে তথ্য চেয়ে ঠিকমতো পাচ্ছেন না। ফলে ব্যাংকটির প্রকৃত চিত্র বের করতে পারছেন না। এস আলমের পক্ষে ব্যাংকটিতে ভূমিকা রাখছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোকাম্মেল হক চৌধুরী। ২০২০ সাল থেকে তিনি ব্যাংকটির এমডি। এর আগে তিনি এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম নিজেই।
ব্যাংক দখল, অর্থ লুটপাট ও অর্থ পাচারে সাইফুল আলমের সহযোগী হিসেবে পরিচিত মোকাম্মেল হক চৌধুরী বিদায়ী সরকারেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এই তালিকায় আরও আছেন এস আলমের ছেলে আহসানুল আলম ও জামাতা বেলাল আহমেদ। তাঁরা দুজনই ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান-পরিচালক ছিলেন। পরে আহসানুল আলম ইসলামী ব্যাংক ও বেলাল আহমেদ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন। এসব ব্যাংকও এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এই ব্যাংক ডুবছিল, তা আগে থেকেই সবাই জেনেছিল। এখন পর্ষদ পরিবর্তন হলেই উন্নতি হবে, তা বলা যাবে না। পরবর্তী ধাপ হিসেবে কী করা যায়, তা এখনই ঠিক করতে হবে। ব্যাংক একীভূত করা, মূলধন জোগান দেওয়া বা অন্য কোনো ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ব্যাংকটি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের বিদেশযাত্রা আটকে দেওয়া যায়। তাহলে তাঁদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাবে, জড়িত হলে বিচারের আওতায় নিতে সুবিধা হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে ২০১২ সালে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন হয়। এর সব কটিই রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক একটি। ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের পেছনে শুরু থেকে এস আলম গ্রুপ থাকলেও সামনে রাখা হয় জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুকে। তখন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি এক জোট হয়ে সরকারে ছিল। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার শুরুতেই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হন এস আলমের ভাই শহীদুল আলম। এতে ব্যাংকের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় এস আলম গ্রুপের কাছে। ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর। বিভিন্ন সময় চেয়ারম্যান ও পরিচালক ছিলেন সাইফুল আলমের ভাই রাশেদুল আলম, ওসমান গনি, সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম ও জামাতা বেলাল আহমেদ। এ ছাড়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জিয়াউদ্দিন বাবলু ও তাঁর স্ত্রী মেহেজুবেন্নেসা রহমানও পর্ষদে ছিলেন। পর্ষদ বিলুপ্তির আগে এস আলম গ্রুপের পক্ষে ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন মো. সেলিম উদ্দিন, তিনি আগে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন।
গত ২৭ আগস্ট আগে পর্ষদ বিলুপ্ত করে নতুন পর্ষদে চেয়ারম্যান করা হয় এক্সিম ব্যাংকের সাবেক এমডি মু. ফরীদ উদ্দিন আহমদকে। তাঁর সঙ্গে থাকা অপর চার স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম জাহীদ ও হিসাববিদ শেখ জাহিদুল ইসলাম।
২০১৩ সালে যাত্রার পর বেসরকারি এই ব্যাংক সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের দিকে নজর দেয়। এরপর নামসর্বস্ব ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণের নামে টাকা তুলে নেওয়া হয়। জনবল নিয়োগে এককভাবে চট্টগ্রামের পটিয়ার ব্যক্তিরা গুরুত্ব পান। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় ২০২০ সালে ব্যাংকটির এমডি হিসেবে মোকাম্মেল হক চৌধুরী যোগ দেওয়ার পর। তিনিও চট্টগ্রামের বাসিন্দা ও এস আলম পরিবারের আত্মীয়।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখার ভল্ট পরিদর্শনে গিয়ে ঘোষণার চেয়ে কম টাকা থাকার বিষয়টি দেখতে পান। কাগজপত্রে ওই শাখার ভল্টে যে পরিমাণ টাকা থাকার তথ্য রয়েছে, বাস্তবে তার চেয়ে প্রায় ১৯ কোটি টাকা কম পান। নিয়ম অনুযায়ী, ভল্টের টাকার গরমিল থাকলে তা আইনি ব্যবস্থা নিতে হয়। অথচ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি তখনকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরও কোনো ব্যবস্থা নেননি। তখন পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের সঙ্গেও ব্যাংকটির এমডি মোকাম্মেল হক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালভিত্তিক ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে ইউনিয়ন ব্যাংককে চিঠি দিয়ে জানায়, ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে যত ঋণ বিতরণ করেছে, তার সিংহভাগই খেলাপি বা অনিয়মযোগ্য। তখন পরিদর্শনে উঠে আসে শুধু ট্রেড লাইসেন্সের ভিত্তিতে কোম্পানি গঠন করে ঋণের বড় অংশই বের করে নিয়েছে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান। আবার অনেক ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্সও ছিল না। কাগুজে এসব কোম্পানিকে দেওয়া ঋণের বেশির ভাগেরই খোঁজ মিলছে না এখন। ফলে এসব ঋণ আদায়ও হচ্ছে না। রাজধানীর পান্থপথ, গুলশান, বনানী, দিলকুশা, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, খাতুনগঞ্জসহ আরও কয়েকটি শাখার মাধ্যমে এই অর্থ বের করে নেওয়া হয়। এসব ঋণের যথাযথ নথিপত্রও ব্যাংকের কাছে নেই। অনেক ক্ষেত্রে ঋণ অনুমোদন ছাড়া বিতরণ করা হয়েছে।
আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বের করতে অসংখ্য কাগুজে কোম্পানি গঠন করেছিলেন। তবে সেসব কোম্পানি যৌথ মূলধন ও কোম্পানিসমূহের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) নিবন্ধিত ছিল। কিন্তু ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে যেসব কোম্পানির নামে ঋণ বের করে নেওয়া হয়েছে, সেসব কোম্পানির অস্তিত্ব বলতে শুধু ট্রেড লাইসেন্স। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগেরই কোনো অস্তিত্ব নেই। এভাবে ব্যাংকটি থেকে নানা উপায়ে অর্থ বের করে নেওয়া হয়।
ব্যাংকটির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে অনেক প্রার্থীকে নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। তারকা থেকে খেলোয়াড়—অনেকেই টাকা নেওয়ার তালিকায় ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের নামে ঋণ তৈরি করে টাকা দেওয়া হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর এসব নথি সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
গত ২৭ আগস্ট পর্ষদ পুনর্গঠনের পর এস আলম নামে ও বেনামে কত টাকা ঋণ নিয়েছে, তা জানতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি এস আলমের নামে ও বেনামে কোনো আমানত থাকলে তা উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এ ছাড়া জব্দ করা হয় ব্যাংকটিতে থাকা এস আলমের নামে ও বেনামি সব শেয়ার।
ব্যাংকটির গত ৩১ আগস্টভিত্তিক অভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তখন ঋণ ছিল ২৭ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা বা ৪২ শতাংশ। এর মধ্যে ৯ হাজার ২৬২ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে ক্ষতিজনক মানে, যা আদায় করা বেশ কঠিন। যদিও ব্যাংকটি গত জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ মাত্র ১ হাজার ৪৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ শতাংশের কম।
২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল ব্যাংকটির এমডির কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জানায়, ‘ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের ঋণ প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। যার বেশির ভাগই কাল্পনিক লেনদেন ও এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেই।’ ফলে ২৭ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৬৫ শতাংশই এস আলম গ্রুপের।
এভাবে যারা এস আলম–সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে, তাদেরই কোণঠাসা করে ফেলছেন এমডি। মোকাম্মেল হক চৌধুরীর বক্তব্য জানতে গত এক মাসে তিন দিন ব্যাংকটিতে গেলেও তিনি দেখা দেননি। তাঁকে মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও সাড়া দেননি।
ব্যাংকটি এখন তারল্য সংকটে ভুগছে। অনেক শাখার নগদ লেনদেন বন্ধ রয়েছে। নতুন পর্ষদও কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মু. ফরীদ উদ্দিন আহমদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সহায়তা না দিলে ব্যাংক চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক সবকিছু দেখছে। তারাই বের করবে কে কত টাকা নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।’