অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ে উত্তপ্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর রাজনীতি৷ বিভিন্ন স্থানে অভিবাসনবিরোধী সহিংসতার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি অভিবাসনবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয় পাচ্ছে অতি-ডানপন্থি দলগুলো৷
জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে অনিয়মিত অভিবাসন ইস্যু প্রাধান্য বিস্তার করেছে৷ জার্মানিতে সাম্প্রতিক একাধিক রাজ্য নির্বাচনেও অভিবাসন ইস্যু কেন্দ্রে উঠে এসেছে, যাকে সঙ্গী করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রথমবারের মতো সাফল্য পেয়েছে একটি অতি-ডানপন্থি দল৷ উগ্রবাদীদের হামলার পর সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার৷
পরিসংখ্যান কী বলে?
অভিবাসনবিরোধী বিতর্কে যখন দেশগুলোর পার্লামেন্ট উত্তপ্ত তখন ভিন্নচিত্র দেখা যাচ্ছে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম-এর পরিসংখ্যানে৷ জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বছরের আট মাসে ইইউ’র দক্ষিণ সীমান্তে অনিয়মিত অভিবাসন ৩৫ শতাংশ কমেছে৷
এই সময়ে এক লাখ ১৫ হাজার অভিবাসী অনিয়মিত ভাবে ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইইউ দেশগুলোতে প্রবেশ করেছে৷ গত বছর একই সময়ে সংখ্যাটি ছিল এক লাখ ৭৬ হাজার ২৫২ জন৷ শুধু ২০১৫ সালেই যেখানে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ এসেছিলেন ইইউতে৷
বাস্তবতা ও বিতর্কের ফারাক
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহিঃসীমান্তরক্ষী বাহিনী ফ্রন্টেক্সের পরিসংখ্যানেও একই চিত্র পাওয়া যাচ্ছে৷ তাদের হিসাবে দক্ষিণ সীমান্তে অনুমতিবিহীন পারাপার চলতি বছর ৩৯ শতাংশ বেড়েছে৷
আইওএম এর একজন মুখপাত্র ফ্লাভিও দি গিয়াকোমো বার্তা সংস্থা এপিকে বলেছেন, ‘‘চলতি বছর সংখ্যার হিসাবে পরিস্থিতি নেই, এমনকি গত বছরও ছিল না৷’’
মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউট নামের একটি অলাভজনক সংস্থার সহযোগী পরিচালক ক্যামিলে লে কজও মনে করেন পরিসংখ্যানের সাথে ইইউর রাজনৈতিক বিতর্কের মিল নেই৷ তিনি বলেন,
পরিস্থিতির বিবেচনায় ইউরোপে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসহ আরো যেসব ইস্যু আছে তার তুলনায় অনিয়মিত অভিবাসনের উপর অনেক বেশি মনোযোগ আরোপ করা হচ্ছে৷
৬৪ শতাংশ কমেছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি
উত্তর আফ্রিকা থেকে যাত্রা করে সেন্ট্রাল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইটালিতে পৌঁছানোর রুটটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত৷ আইওএম ও ফ্রন্টেক্সের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় চলতি বছর আগস্ট পর্যন্ত এই রুটে তার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৪ শতাংশ কম মানুষ ইইউতে প্রবেশ করেছেন৷
ইইউ-র সহায়তায় টিউনিশিয়া ও লিবিয়াতে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নেয়া কঠোর ব্যবস্থা এর কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷ সাম্প্রতিক সময়ে অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশী এই দেশগুলোর মরুভূমি অঞ্চলে অমানবিক পরিস্থিতিতে আটকা পড়েছেন৷
বেড়েছে পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক পাড়ি
পূর্ব ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের রুটটি অভিবাসী পাড়ি দেয়ার সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয়৷ তুর্কি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ এড়াতে মানবপাচারকারী নেটওয়ার্কগুলো এই পথে তুরস্কের উপকূল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে গ্রিক কর্তৃপক্ষ৷
জাতিসংঘের হিসাবে বছরের প্রথম আট মাসে সমুদ্র ও স্থলপথে গ্রিসে আগত অভিবাসীদের সংখ্যা ৫৭ শতাশ বেড়েছে৷
পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের রুটটি অভিবাসীদের আগমনের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে৷ এই পথে আগমন দ্বিগুণ বেড়েছে৷ ৩১ আগস্ট পর্যন্ত মালি, সেনেগাল ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে সাড়ে ২৫ হাজারের বেশি অভিবাসী ক্যানারির দ্বীপগুলোতে পৌঁছেছেন৷
আটলান্টিকে নিখোঁজ অসংখ্য
আটলান্টিকে তীব্র বাতাস ও শক্তিশালী ঢেউ পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য অভিবাসী নিখোঁজ হন৷ চলতি বছর ক্যারিবীয় দ্বীপ ও ব্রাজিলের উপকূলে পর্যন্ত মালি, মৌরিতানিয়া ও সেনেগালের অভিবাসীদের মরদেহ বহনকারী নৌকার খোঁজ মিলেছে৷
কত সংখ্যক মানুষ এই পথে নিখোঁজ হয়েছেন তার প্রকৃত সংখ্যা জানা কঠিন৷ তবে স্প্যানিশ অভিবাসী অধিকার সংস্থার ওয়াকিং বর্ডার্স চার হাজার জনের বেশি মৃত্যু বা নিখোঁজের একটি সংখ্যা জানিয়েছে৷
ক্যানারিতে পৌঁছানোর পর অভিবাসীরা চাকরি ও নিরাপত্তার জন্য স্পেনের মূল ভূখণ্ড এবং আরো উত্তরের দেশগুলোতে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ কিন্তু অভিভাবকবিহীন অপ্রাপ্তবয়স্কদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না৷ স্প্যানিশ আইন অনুযায়ী তাদেরকে স্থানীয় সরকারের এই বিষয়ক সংস্থার অধীনে থাকতে হয়৷
তবে এই অভিবাসন থামানোর জন্য সম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকার তিনটি দেশে গিয়েছেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ৷
সেনেগালের মানুষদের জন্য স্পেনে সাময়িক কাজের সুযোগ ও নিজ দেশে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার জন্য দেশটির প্রেসিডেন্টের সাথে একটি চুক্তিও করেছেন তিনি৷ সেই সঙ্গে দুই দেশের পুলিশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সমঝোতা হয়েছে৷
‘জাদুকরী কোনো সমাধান নেই’
অভিবাসনবিরোধী প্রচার সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য অভিবাসী কর্মীদের গুরুত্বের কথা বলে আসছেন৷ বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জন্মহার হ্রাস এবং কর্মী সংকটের মধ্যে সামনের দিনে অবসরকালীন সুবিধা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে বিভিন্ন দেশে অভিবাসী কর্মী প্রয়োজন৷
অন্যদিকে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীলতা ও সংঘাত বেড়ে চলার কারণে অনিয়মিত অভিবাসনের প্রবণতাও থামছে না৷ লে কজের মতে, ‘‘এর কোন জাদুকরী সমাধান নেই৷’’ তিনি মনে করেন অননুমোদিত প্রবেশ ঠেকানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ নেয়া হলেও অভিবাসীদের সাময়িক কাজের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উদ্যোগের ঘাটতি আছে৷ এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে আরো সম্পৃক্ত করার পরামর্শ তার৷