সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৭ অপরাহ্ন

“আমাদের পালাতেই হতো”: ইসরায়েলি বোমা বর্ষণে লেবাননে তীব্র আতঙ্ক

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ইসরায়েলের তীব্র আক্রমণের জেরে দক্ষিণ লেবাননের বহু পরিবারই ঘর ছেড়েছেন। কোনওমতে তাদের জিনিসপত্র একত্র করে গাড়ি, ট্রাক বা মোটরসাইকেলে চেপে উত্তরের দিকে রওয়ানা দিয়েছেন তারা।

ইসরায়েলের তরফে জানানো হয়েছে তাদের লক্ষ্যবস্তুগুলো লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহের সঙ্গে সম্পর্কিত।

ঘরছাড়া বাসিন্দাদের মধ্যে কিছু মানুষ অবশ্য জানিয়েছেন, ওই গোষ্ঠী যে অঞ্চল অবস্থান করছে তার নিকটবর্তী এলাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য বার্তা পাঠিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। টেক্সট বার্তা এবং ভয়েস রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে তাদের।

দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নাবাতিয়েহের এক পড়ুয়া জাহরা সাওলি বিবিসির নিউজআওয়ার প্রোগ্রামকে জানিয়েছেন, তীব্র মাত্রায় বোমাবর্ষণ হয়েছে তার এলাকায়।

ওই শিক্ষার্থী বলেছিলেন, “সকাল ছ’টায় বোমা বর্ষণের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দুপুরের দিকে এর মাত্রা আরও তীব্র হতে শুরু করে। আমি আমার এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বোমা বর্ষণ হতে দেখেছি। অনেক কাচ ভাঙার শব্দও শুনতে পেয়েছি।”

জাহরা সাওলি এবং তার সঙ্গে যারা ছিলেন তারা ঘর থেকে বের হননি। সাহস পাননি তারা। এদের মতোই আরও অনেক মানুষ রয়েছেন যারা ঘর ছাড়েননি।

জাহরা সাওলির কথায়, “কোথায় যাব আমরা? এখনও রাস্তায় বহু মানুষ আটকে রয়েছেন। আমার বহু বন্ধু এখনও যানজটে আটকা পড়ে আছে। তার কারণ মানুষ পালানোর চেষ্টা করছে।”

ছয় লেনের উপকূলীয় মহাসড়কের দুই পাশ দিয়ে রাজধানীর দিকে সারিসারি যানবাহন চলেছে যে কারণে দিনের মাঝামাঝি সময়ে বৈরুতের উত্তরের রাস্তাগুলো যানজটে ভরে গিয়েছে।

অন্যান্য ছবিতে দেখা গিয়েছে বিমান হামলায় বিধ্বস্ত গ্রাম থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে, কীভাবে মানুষ দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর টায়ারের সমুদ্র সৈকত ধরে হেঁটে চলেছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।

একই মোটর বাইকে চেপে বৈরুতে আসা পাঁচ সদস্যের এক পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।

নিরাপদ আস্তানার খোঁজে এক পরিবার।

ছবির উৎস,Hassan Harfoush

ছবির ক্যাপশান,নিরাপদ আস্তানার খোঁজে এক পরিবার।

দক্ষিণের একটা গ্রাম থেকে উত্তরের ত্রিপোলির দিকে যাচ্ছিল ওই পরিবার। অভিভাবক এবং সঙ্গে তিনজন বালক। ভীষণভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন সকলে।

“আমাদের কী বলতে বলছেন? আমাদের পালাতেই হতো,” তিন সন্তানের ওই পিতা বলেছিলেন বিবিসিকে।

লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে জানানো হয়েছে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বোমা হামলায় ৪৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ১৬০০ জনেরও বেশি মানুষ। নিহতদের মধ্যে অন্তত পক্ষে ৩৫ শিশু রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে, ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সেস বা আইডিএফ (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় তাদের পক্ষ থেকে ১ হাজার ১০০ বার হামলা চালানো হয়েছে।

এই তালিকায় দক্ষিণ বৈরুতে একটা বিমান হামলাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আইডিএফ জানিয়েছে একজন সিনিয়র হেজবুল্লাহর কমান্ডারকে লক্ষ্য করে ওই হামলা চালানো হয়েছিল।

উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় মোড়া রয়েছে বৈরুতও।

একদিকে যেমন নিজেদের বাসস্থান ছেড়ে গাড়ির মাথায় সুটকেস বেঁধে দক্ষিণ থেকে রাজধানী বৈরুতে আসছেন মানুষ, অন্যদিকে শহর ছেড়েও চলে যেতে দেখা গিয়েছে বেশ কিছু বাসিন্দাদের।


সোমবার বোমা হামলার পর লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর টায়ার থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে চলেছেন মানুষ।

ছবির উৎস,Reuters

ছবির ক্যাপশান,সোমবার বোমা হামলার পর লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর টায়ার থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে চলেছে মানুষ।

প্রসঙ্গত, কিছু এলাকায় হেজবুল্লাহ অস্ত্র মজুদ করে রেখেছে এমন দাবি জানিয়ে সেই সমস্ত জায়গা খালি করার জন্য বেসামরিক নাগরিকদের উদ্দেশে সতর্কবার্তা জারি করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।

একইসঙ্গে বৈরুতের যে সব জেলাকে হেজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি হিসাবে বিবেচনা করা হয় না, তেমন এলাকার বাসিন্দাদেরও রেকর্ড করা সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে।

তার মধ্যে হামরাও আছে যা সরকারি মন্ত্রণালয়, ব্যাংক এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসস্থল। হামরার বাসিন্দারাও কিন্তু একইরকম সতর্কবার্তা পেয়েছেন।

ওই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য একের পর এক সতর্কবার্তা পাওয়ার পর অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য ছুটে যান।

তাদেরই মধ্যে একজন ইসা যিনি তার ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করে এসেছিলেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ওই পিতা বলেছেন, “ফোন কলগুলোর কারণে আমরা এখানে এসেছি।”

“ওরা সবাইকে ফোন করে হুমকি দিচ্ছে। তাই ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে এসেছি। পরিস্থিতি একেবারেই স্বস্তিদায়ক নয়।”

গাড়ির জ্বালানির জন্য লম্বা লাইন।

ছবির উৎস,EPA

ছবির ক্যাপশান,গাড়ির জ্বালানির জন্য লম্বা লাইন।

ফিলিস্তিনি নাগরিক মুহাম্মদ সস্ত্রীক বৈরুত ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। পথে বিবিসির সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

রাজধানীতে থাকবেন কি না সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “লেবাননের কোনও জায়গাই এখন নিরাপদ নয়। ইসরায়েল জানিয়েছে তারা সর্বত্র বোমা হামলা চালাবে। এখন এই এলাকাতেও হুমকি দিচ্ছে। তাহলে আমরা কোথায় যাব?”

তার অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে বলেছেন, “এ এক আতঙ্কের পরিবেশ। আমি কী করব জানি না – কী কাজ করব, কোথায় যাব কিছুই জানি না।”

এদিকে রাস্তার একপাশে বিবিসি টিমের সদস্যরা দাঁড়িয়েছিলেন। একজন ট্যাক্সি চালক তাদের জিজ্ঞাসা করেন জ্বালানি সঙ্কট সম্পর্কে কিছু জানা আছে কি না। ওই ট্যাক্সি চালক বলেছিলেন, “বৈরুতে কিন্তু অনেক মানুষ চলে আসছে।”

সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে স্কুলগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে লেবাননের দক্ষিণ অঞ্চল ছেড়ে চলে আসা মানুষের জন্য। সরকারি আদেশে বৈরুত, ত্রিপোলি এবং পূর্ব লেবাননের স্কুলগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

ইসরায়েলি বোমা হামলার পর লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন মানুষ।

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,ইসরায়েলি বোমা হামলার পর লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন মানুষ।

সোমবার পশ্চিম বৈরুতের বির হাসানের একটা পাবলিক স্কুলের একটা ক্লাসরুমে গিয়েছিল বিবিসি। উত্তর-পূর্ব লেবাননে হেজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি বেকা উপত্যকা ছেড়ে চলে আসা মানুষকে আশ্রয় দিতে প্রস্তুত করা হচ্ছিল ওই ক্লাসরুম। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল বেকা উপত্যকাও তাদের লক্ষ্যের মধ্যে একটা।

ফাঁকা ক্লাসরুমে সেই সময়ে সারি সারি তোশক জড়ো করা থাকলেও দিনের শেষে ওই কক্ষ পুরোপুরি ভরে যাবে যাবে বলে জানিয়েছিলেন সেখানকার কর্মীরা।

এদিকে, লেবাননের হাসপাতাল ভরে গিয়েছে আহত মানুষে। পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার ছাড়া অন্যান্য সমস্ত ধরনের অস্ত্রোপচার আপাতত বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সোমবারই এই নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে।

বৈরুতে আতঙ্ক এবং অনিশ্চিত পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন।

সেই প্রতিবাদীদের মধ্যে এক ব্যক্তি বিবিসিকে বলেছেন, “যদি পুরোপুরিভাবে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে আমাদের দলমত নির্বিশেষে দাঁড়ানো দরকার লেবাননের জনগণ হিসেবে। কারণ দিন শেষে আমাদের দেশেই বোমা ফেলা হচ্ছে।”

কেউ কেউ আবার সহিংসতার কাছেই ‘আত্মসমর্পণ’ করেছেন।

“ওরা যদি যুদ্ধ চায়, তাহলে আমরা কী-ই বা করতে পারি? এটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না,” বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলছিলেন মোহাম্মদ সিবাই নামে এক ব্যক্তি। পেশায় ব্যবসায়ী তিনি, একটা দোকান চালান।

বছর ৫৭’র মুহাম্মদ রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরতলী দাহিয়েহের বাসিন্দা। হেজবুল্লাহর প্রধান ঘাঁটি নামে পরিচিত ওই অঞ্চল। বিবিসিকে মুহাম্মদ বলেছেন, “১৯৭৫ সাল থেকে এই যুদ্ধের মধ্যেই বেঁচে আছি।”

“কোথাও যাব না, আমি আমার বাড়িতেই থাকব।”

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com