শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৩ অপরাহ্ন

বাংলার চিরন্তন ঐতিহ্য ‘মণিপুরী শাড়ি’

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

গ্রামের মেঠোপথ প্রখর রোদের তীব্রতা নিয়ে যেন ঝিম ধরে রয়েছে। লোকজনের উপস্থিতি খুবই কম। এ নির্জনতাটুকুর ভেতর দূর থেকে ভেসে আসা একটি বিশেষ শব্দ। মনোসংযোগ শুধুই সেদিকে! কী সেই শব্দ! বেশ কৌতুহল জাগে মনে। ধীরে ধীরে কাছে যেতেই সব কৌতুহলের অবসান। তাঁতযন্ত্রে কাপড় বোনার যান্ত্রিক প্রতিধ্বনি। গৃহকোণ থেকে সড়ককোণে তার মৃদু যন্ত্রধ্বনি ভরিয়ে রেখেছে কোনো কোনো পথিক মন।

শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে যে গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছানো হলো, তার নাম ‘ভানুবিল মাঝের গাঁও’। কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম। এই গ্রামের মণিপুরী সম্প্রদায়ের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের এক স্বনামধন্য সংগঠক নিরঞ্জন সিংহ রাজু।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি জানালেন মণিপুরী শাড়ি তৈরির বিভিন্ন তথ্য।

মণিপুরী সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কে শুরুতেই নিরঞ্জন বলেন, আমরা মণিপুরী সম্প্রদায় একসময় খুবই স্বাবলম্বী এক সোসাইটি ছিলাম। কেরোসিন তেল আর লবণ আমরা শুধু বাইরে থেকে কিনে আনতাম। জীবনধারণের আর বাকি সবগুলোই আমরা নিজেরাই তৈরি করতাম। যেমন ধরেন, কাপড়ের কথা। কাপড় তৈরি করতে যেতে প্রথমেই সূতার প্রয়োজন পড়ে। আমরা মণিপুরী সম্প্রদায় তখন সূতা নিজেরা তৈরি করতাম। এখন তো সূতা আমরা বাজার থেকে কিনে আনি।

আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের বাবা-দাদারা তুলা চাষ করতেন। ওই সূতা দিয়েই আমাদের জীবনধারণের পরিধেয় বস্ত্র তৈরি হতো। সেই সময়ে আমাদের সম্প্রদায় তখন বাজারমুখী ছিল না বলে জানান তিনি।

মণিপুরী শাড়ির বিপণন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৮০ ইংরেজির দিকে আমাদের মণিপুরী কমিউনিটির কেউ কেউ ভাবতে শুরু করলেন যে, আমাদের নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে আমরা যদি আমরা হাতে তৈরি পণ্যগুলোকে বাজারে বিক্রি করি তাহলে বাড়তি টাকা আসবে। তারপর গুণগতমান বৃদ্ধির দিকে জোর দেওয়া হলো। যাতে মণিপুরী শাড়ি তার ঐতিহ্য নিয়ে বাজারের ক্রেতাদের মাঝে টিকে থাকতে পারে। এই থেকেই মূলত মণিপুরী শাড়ির বিপণন ভাবনাটা শুরু। মণিপুরী শাড়ির হাত ধরেই কিন্তু মণিপুরী তাঁতশিল্পের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল। সেসময়ই প্রচুর সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে গায়ের চাদর, বিছানার চাদর, গামছাসহ নানান পণ্য এর সাথে যুক্ত হয়ে হয়েছে। এখন তো পৃথিবীজুড়েই বাংলাদেশের মণিপুরী শাড়ির একচেটিয়া কদর রয়েছে।

শাড়ি তৈরির যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মণিপুরী তাঁতশিল্পের মাঝে মণিপুরী শাড়ি অন্যতম আকর্ষণ। মণিপুরী কাপড় বুনতে সর্বপ্রথম যে মেশিনে সূতাকে নেওয়া হয় সেই কাঠের মেশিনের নাম ‘ড্রাম’। এই ড্রামের একেকটি চুঙ্গাতে সূতাগুলোকে ভরা হয়। এরপর এই মেশিনেই বোঝা যায় যে এই সূতা দিয়ে শাড়ি তৈরি ভালো হবে, নাকি গায়ের চাদর, বিছানার চাদর প্রভৃতি কাপড় তৈরি ভালো হবে। দ্বিতীয় মেশিনটির নাম ‘জংগাম’। এই নামগুলো মণিপুরী ভাষায় উল্লেখিত বলে এর বাংলা নাম নেই। জংগাম থেকে নানান মণিপুরী শাড়ি, বিছানার চাদর ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এই জংগাম মেশিনটির আকৃতি ছোট-বড় হয়ে থাকে।

মণিপুরী শাড়ি তৈরি কারিগর অঞ্জলি দেবী। তার হাতেই প্রতিটি শাড়ি সুক্ষ্মতার সাথে সৌন্দর্যবর্ধিত হয়ে থাকে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, ‘আমরা এই জংগামের মাধ্যমেই মণিপুরী শাড়ি তৈরি করি। একেকটি শাড়ি তৈরিতে প্রায় পাঁচ দিন সময় লাগে। উন্নতমানে সূতা দিয়ে তৈরি আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী শাড়ির সুনাম রয়েছে দেশ-বিদেশে’।

মণিপুরী শাড়ির ডিজাইন সম্পর্কে এই কমিউনিটির সংগঠক বলেন, অনেকের ধারণা যে, মণিপুরী শাড়ির পৃথক পৃথক নামীয় ডিজাইন বা নকশা নেই। আসলে এই কথাটি ভুল। মণিপুরী শাড়ি প্রধানত তিনটি নকশা বা ডিজাইনে প্রিন্ট হয়ে থাকে। এগুলো- তাজমহল মৈরাং, কেওয়া মৈরাং এবং ফুরা মৈরাং। আমাদের মণিপুরী ঐতিহ্যের শাড়ি হলো কেওয়া মৈরাং এবং ফুরা মৈরাং। ‘মৈরাং’ শব্দটা হলো আমাদের আদিনিবাস ভারতের মণিপুর রাজ্যের একটা এরিয়ার (এলাকা) নাম। ওই এরিয়া থেকে এই প্রোডাকশনটা প্রথম শুরু হয়। তখন মণিপুর রাজাকে এই প্রোডাকশনটা (শাড়ি ও অন্যান্য তাঁতশিল্প) উপহার দেওয়া হতো ওই এলাকা থেকে বানিয়ে। পরে এলাকার নামানুসারে মণিপুী শাড়ির এ নামকরণটি হয়ে যায়।

রঙের বৈচিত্র্যতায় ভরপুর একেকটি মণিপুরি শাড়ির দাম ১৩শ  টাকা থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত। ১৩শ টাকার একটি শাড়ি তৈরিতে খরচ পড়ে প্রায় ৬শ টাকার মতো। শাড়ির সূতা ক্রয় এবং কারিগরের গড় মজুরির হিসেবে এর সাথে যুক্ত রয়েছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com