আগস্ট জুড়ে ইউরোপে তাপমাত্রা ছিল বাড়তি৷ টানা দ্বিতীয় বছরের মতো এবার উচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে বিশ্বজুড়ে৷ জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই উত্তাপ ২০২৪ সালকে উষ্ণতম বছর করে তুলতে পারে৷
ইউরোপীয় ট্রেড ইউনিয়ন কনফারেন্স (ইটিইউসি) বছরের শুরুর দিকে জানিয়েছে, প্রচণ্ড গরমের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নে কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি অসুস্থতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে৷ আর মৃত্যুর সংখ্যাও অন্য যেকোনো স্থানের তুলনায় ইউরোপে দ্রুত বাড়ছে৷
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকে (আইএলও) উদ্ধৃত করে ইটিইউসি জানিয়েছে যে, ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে ৮০ হাজার আটশ জন তাপজনিত কারণে অসুস্থ হয়েছিলেন এবং প্রচণ্ড গরমের মধ্যে কাজ করার কারণে অন্তত ৬৭ জন মারা গেছেন৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নে ২০০০ সাল থেকে তাপজনিত মৃত্যুর পরিমাণ ৪২ শতাংশ বেড়েছে৷ তবে যারা খোলা জায়গায় বা বাইরে কাজ করেন, তারাই তাপমাত্রা জনিত কারণে বেশি অসুস্থ হয়েছেন৷
সেন্ট্রাল ইটালির লাতিনায় ৫৪ বছর বয়সি দালভীর সিং ফুল তোলার কাজ করতেন৷ এ বছরের ১৬ আগস্ট কর্মক্ষেত্রে মারা গেছেন তিনি৷ ধারণা করা হয়, প্রচণ্ড তাপ আর বাড়তি কাজের বোঝায় তার মৃত্যু হয়েছিল৷ ভারতের পাঞ্জাব থেকে আসা এই শ্রমিক কয়েক বছরের মধ্যে অবসর নেয়ার কথা ভেবে রেখেছিলেন৷ কারণ, কর্মপরিবেশ তার স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল৷
ইউরোপীয় ফেডারেশন অব ফুড, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেড ইউনিয়ন (ইএফএফএটি)-এর কৃষি বিষয়ক রাজনৈতিক সচিব ইভান ইভানভ ইনফোমাগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘অতিরিক্ত গরমে কাজ করা অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে৷ কিছু শ্রমিককে জীবন দিয়ে এর মূল্য দিতে হয়৷’’
অভিবাসী শ্রমিকদের গরম অনুভূত হওয়ার শঙ্কা বেশি
বিভিন্ন খাতের শ্রমিকেরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিরিক্ত গরমের শিকার হলেও সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন অভিবাসী কৃষি শ্রমিকেরা৷
ইভানভ বলেন, ‘‘অভিবাসী শ্রমিকেরা যথাযথ বিরতি বা রিহাইড্রেশন ছাড়াই গরমের দিনে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হন৷ কারণ নিয়োগকর্তারা পেশাগত স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা বিধি মেনে চলেন না এবং শ্রমিকদের মজুরি কত কেজি ফল কিংবা সবজি তুলতে পারলেন তার উপর নির্ভর করে৷’’
শ্রম শোষণ, পাচার এবং ওয়ার্ক পারমিট বা ভিসা সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সঙ্গে আবহাওয়া পরিস্থিতি অভিবাসীদের জীবনকে আরো জটিলতর করে তুলছে৷ আর ভাষার প্রতিবন্ধকতা কাজের জায়গার নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা বা সাহায্য চাওয়ার অসুবিধাকে আরো বাড়িয়ে তোলে৷
ইভানভ বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে, আপনি আশা করতে পারেন না যে শ্রমিকেরা তাদের অধিকার দাবি করবে বা তাদের নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে৷ কারণ তাদের হাতে কোনো বিকল্প নেই৷’’
যেখানে শ্রমিকদের সাব-কন্ট্রাক্টিং বা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়, সেখানে জবাবদিহিতা কিছুটা কমে আসে বলে মনে করেন তিনি৷
স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব
পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ (পিআইকে)-এর পোস্টডক্টরাল গবেষক আসিয়া দিমিত্রোভা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিদিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি তীব্র এবং ঘন ঘন তাপপ্রবাহও দেখা যাচ্ছে৷ ফলে কৃষি বা নির্মাণ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকেরা এই তাপপ্রবাহ অসমভাবে অনুভব করেন৷ কারণ, কাজের সময় তাদের খোলা আকাশের নিচে থাকতে হয়৷
তিনি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘এসব শ্রমিকদের গরম-আর্দ্র আবহাওয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে খাটতে হয়, অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রতিরক্ষামূলক পোশাকও পরতে হয়, যা ঘামকে বাষ্প করার ক্ষেত্রে বাধা দেয় এবং গরমের অনুভূতিকে আরো বাড়িয়ে তোলে৷’’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) বলছে, বয়স, স্বাস্থ্যগত অবস্থা এবং পেশাগত চাপের উপর তাপ-সম্পর্কিত আঘাত বা মৃত্যুর ঝুঁকি নির্ভর করে৷
দিমিত্রোভা বলেন, ‘‘তাপের কারণে বাইরে কাজ করা শ্রমিকদের শরীরে দ্রুত প্রভাব পড়ে৷ ফলে, তাপজনিত ক্লান্তি, হিটস্ট্রোক এবং গুরুতর ক্ষেত্রে মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটতে পারে৷’’
তাপ সৃষ্ট চাপ: অদৃশ্য ঘাতক
ইএফএফএটি-এর মতো ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের সুরক্ষায় কর্মক্ষেত্রে আরো ভাল ব্যবস্থা এবং কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে৷ ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন (আইটিইউসি) এর মতো সংস্থাগুলো তাপজনিত প্রদাহের ঝুঁকিকেও চুক্তিপত্রে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছে৷ যাতে শ্রমিকেরা শোষণের শিকার না হন৷
জুলাইয়ে প্রকাশিত ‘হিট অ্যাট ওয়ার্ক’ বা ‘কর্মক্ষেত্রে তাপ’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা তাপ সৃষ্ট চাপকে ‘অদৃশ্য ঘাতক’ হিসাবে উল্লেখ করেছে৷ প্রতিরোধের কৌশলগুলোকে শক্তিশালী করা, পেশাগত নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছে তারা৷ প্রচণ্ড তাপে কাজ করা কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিষয়টি জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করারও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি৷