মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৪ অপরাহ্ন

তালেবানের কাছ থেকে পালানো আফগান তরুণীরা কেমন আছেন

  • আপডেট সময় রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

যুক্তরাজ্যের বেশির ভাগ স্কুল এ সপ্তাহে খুলেছে, শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠদান। কিন্তু আফগানিস্তানে কিশোরী-তরুণীরা এখনো তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। মাধ্যমিক স্কুল তাদের জন্য নিষিদ্ধ।

শুধু শিক্ষার অধিকারই নয়, বরং পুনরায় দেশটির ক্ষমতা দখলের পর নারীদের ওপর একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করে গেছে তালেবান সরকার। নারীদের জীবন তারা একরকম গৃহবন্দী করে ফেলেছে।

২০২১ সালের আগস্টে তালেবান যোদ্ধারা যখন কাবুলে প্রবেশ করেন, সে সময় ২২ বছর বয়সী মাহ দেশছেড়ে পালিয়ে যান। তিনি এখন যুক্তরাজ্যে রয়েছেন এবং এ সপ্তাহ থেকে সেখানে একটি মাধ্যমিক স্কুলে যাওয়া শুরু করেছেন।

বিবিসি নিউজবিটকে তিনি বলেন, ‘নিজেকে নিয়ে আমি খুশি, আমি নিরাপদ, আমার স্বাধীনতা আছে এবং আমি স্বাধীন। কিন্তু একই সময়ে আফগানিস্তানে আমার বন্ধুরা কিছুই করতে পারছে না।’

‘আমি আমার মাকে ডেকে তুলি এবং বলি, মা, আমি যাচ্ছি।’ তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ।’ আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আমি জানি না।’

আফগান তরুণী 

তিন বছর আগে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানে ১২ বছরের বেশি বয়সের মেয়ে এবং নারীদের স্কুলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণই করতে দেওয়া হয় না। নারীদের বাইরে কাজের ওপর অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বিউটি সেলুন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নারীদের পার্কে, ব্যায়ামাগারে যেতে দেওয়া হয় না। ক্লাবে খেলাধুলাও নিষেধ।

মাহ বলেন, ‘আমি আমার খুশি থাকার ছবি, যখন আমি বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাই বা কলেজে থাকি, সেই ছবি (হোয়াটসঅ্যাপ বা ইনস্টাগ্রামে) পোস্ট করি না। কারণ, আমি চাই না আফগানিস্তানে থাকা আমার বন্ধুরা ভাবুক আমি যুক্তরাজ্যে আছি বলেই স্বাধীন।

মাহ এখন কার্ডিফে থাকেন, তিনি সেখানে ইংরেজি ভাষায় জেনারেল সার্টিফিকেট অব সেকেন্ডারি এডুকেশনে (জিসিএসই) লেখাপড়া শুরু করেছেন। লেখাপড়া শেষ করে তিনি  মিডওয়াইফ হিসেবে কাজ করবেন।

‘অনেকে মনে করেন, আফগানিস্তানের একমাত্র সমস্যা মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যের মতো অনেক বিষয় নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। আফগান মেয়েরা প্রতিদিন হতাশা ও বিষণ্নতায় ডুবে যাচ্ছে। সেখানে তাদের সাহায্য করার কেউ নেই।’

শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পড়তে যাওয়া আফগান তরুণী আকদাস।

মাহ বলেন তাঁর যুক্তরাজ্যে আসাটা কঠিন ছিল। কিন্তু তাঁর আসার পেছনে কারণ ছিল। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে কলেজে যেতে পারব, কাজেও যেতে পারব। কিন্তু একই সময়ে বাড়িতে, আমার সমবয়সী বন্ধুরা বাড়ির বাইরে যেতেই পারছে না।’

তালেবান ১২ বছরের বেশি বয়সের নারীদের জন্য স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করার সময়  ধর্মীয় কারণ দেখিয়েছিল। তখন বারবার এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যেসব বিষয় নিয়ে আপত্তি আছে, সেগুলোর সমাধান পাওয়ার পর নারীরা পুনরায় স্কুল-কলেজে যাওয়ার সুযোগ পাবে। তালেবান পাঠ্যক্রম ‘ইসলামভিত্তিক’ হওয়াও নিশ্চিত করতে চায়।

কিন্তু দীর্ঘদিন পরেও আফগানিস্তানে নারীদের শিক্ষার সুযোগের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। পৃথিবীতে আফগানিস্তানই একমাত্র দেশে, যেখানে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আছে।

যাত্রা ছিল কঠিন

তালেবান যোদ্ধারা যখন আফগানিস্তানে একের পর এক অঞ্চলের দখল নিচ্ছিল, তখন হেলমান্দ প্রদেশ থেকে কান্দাহার যান মাহ। সেখান থেকে কাবুল। কাবুলে পৌঁছানোর তিন দিন পর মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে মাহর মনে হয়েছে, যদি তিনি আফগানিস্তানে থেকে যান, হয়তো তালেবান তাঁকে মেরে ফেলবে, হয়তো তারা তাঁকে বিয়ে করবে।

সেই রাতের ঘটনার বর্ণনায় তিনি আরও বলেন, ‘আমি আমার মাকে ডেকে তুলি এবং বলি, মা, আমি যাচ্ছি।’ তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ।’ আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আমি জানি না।’

অন্য শরণার্থীদের সঙ্গে মাহ অবশেষে যুক্তরাজ্য গিয়ে পৌঁছান। তিনি বলেন, ‘আমরা একেবারে খালি হাতে আসি। আমি মাকে ঠিকমতো বিদায়ও বলতে পারিনি। এমনকি মাকে জড়িয়ে ধরতেও পারিনি। আমি কখনো এসব ভুলব না। এখন সব নিরাপদ, কিন্তু আফগানিস্তানে আমি বড় হয়েছি, স্কুলে গিয়েছি। আমি আমার দেশকে ভুলতে পারব না এবং আমি দেশের সবকিছুর অভাব বোধ করি।’

মাহকে সহায়তা করছে তরুণদের সংগঠন উর্ড। সংগঠনের প্রধান নির্বাহী সিয়ান লিউইস বলেন, ‘যেসব লোক ওয়েলসে পালিয়ে এসেছেন এবং শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তাঁরা এখন ওয়েলস ভাষাতেও কথা বলতে পারেন। তাঁরা এখানে উর্ডে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। বেশ কয়েকজন এখন ওয়েলসের অন্যান্য অংশে নতুন করে জীবন শুরু করেছেন।’

মাহ যখন যুক্তরাজ্যে আসেন, তখন তিনি ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারতেন না। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা খুবই কঠিন ছিল। আমি কাউকে চিনতাম না। সবকিছু নতুন ছিল।’

তিন বছর পর মাহ বিবিসি নিউজবিটকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। ২০ মিনিটের বেশি সময় ধরে যে সাক্ষাৎকার চলেছে এবং তিনি ওয়েলস ভাষাও শিখছেন।

মাহ মনে করেন, ‘এখানকার মানুষের প্রতিদিন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। নারীদের অধিকার আছে। এখানে লোকজন যা চায় তাই করতে পারে এবং তারা নিরাপদ। তাদের সুখী হওয়া উচিত। তাদের ভাগ্য খুব ভালো।’

মাহর মতো ১৭ বছরের আকদাসও শিক্ষার সুযোগ পেতে আফগানিস্তান ছেড়েছে। পূর্ণ শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে সে এখন নিউ মেক্সিকোর একটি কলেজে লেখাপড়া করছে।

কাবুলের দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সে বলে, ‘আমার মনে আছে, সে সময় কী করব সেটাই জানতাম না। তাঁরা কি আমার সব অধিকার কেড়ে নেবে? আমার মা ২০ বছর আগে যে নৃশংসতার মধ্য দিয়ে গেছেন, আমাকেও কি সেই অভিজ্ঞতা পেতে হবে। আমি দেখি মা কাঁদছেন এবং আমার কাঁধে হাত রেখে বলছেন, তিনি তালেবানের কারণে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি।’ মা আকদাসকে সাহসও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তাঁর জীবন কেমন হবে তা তালেবান ঠিক করে দেবে না। নিজের সীমাবদ্ধতার ছাপ যেন জীবনের ওপর না পড়ে।

মায়ের ওই কথার পর আকদাস গোপনে অনলাইনে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে শুরু করে। হেরাত অনলাইন স্কুল তাকে সহায়তা করে। আকদাস বলে, ‘আমি কখনো লেখাপড়া ছাড়িনি। যখন পেরেছি, অনলাইনে করেছি বা অন্য যেকোনো উপায়ে চালিয়ে গেছি।’ যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাবৃত্তি পেলেও ভিসার জন্য তাঁকে জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বন্ধ ছিল। এ জন্য চিকিৎসা ভিসা নিয়ে আকদাস বাবার সঙ্গে পাকিস্তান যায়। তার একা দেশ ছাড়ার অনুমতি ছিল না। সে বলে, শিক্ষার সুযোগ ছাড়াও আফগানিস্তানে আরও অনেক সংকট আছে। যেগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

আকদাস বলে, ‘অনেকে মনে করেন, আফগানিস্তানের একমাত্র সমস্যা মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যের মতো অনেক বিষয় নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। আফগান মেয়েরা প্রতিদিন হতাশা ও বিষণ্নতায় ডুবে যাচ্ছে। সেখানে তাদের সাহায্য করার কেউ নেই।’

বিবিসি নিউজবিটকে যুক্তরাজ্য সরকার নারীদের শ্রেণিকক্ষে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে তীব্র নিন্দা জানায়। তারা তালেবান প্রশাসনের কাছে ‘তাদের সিদ্ধান্ত বাতিল করার এবং আফগান মেয়েদের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে’ জরুরি আহ্বান জানিয়েছে।

বিবিসি নিউজবিট থেকে নারী ও মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে উদ্বেগ নিয়ে তালেবানের মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।

বিবিসি

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com