প্রায় দেড় দশক আগে সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরীর বছরে আয় ছিল ১ লাখ ২২ হাজার এবং ব্যয় ছিল ৮০ হাজার টাকা। তখন তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকার। এখন তার সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৫৬ কোটি ৮ লাখ ৯৫ হাজার ৬০২ টাকা।
২০০৮ সাল থেকে গত প্রায় সাড়ে ১৫ বছরে জান্নাত আরা হেনরীর সম্পদ ৮৮৪ গুণ বেড়েছে। একই সময়ে তার স্বামী শামীম তালুকদার লাবুর সম্পদ বেড়েছে ১৩৬ গুণ।
তথ্য বলছে, হেনরীর সম্পদের বাজারমূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। তিনি অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে এসব সম্পদ অর্জন ও বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
কমিশন গতকাল মঙ্গলবার এসব অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংস্থাটির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় হেনরীর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে ফোন দেওয়া হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে বলা হয়েছে, জান্নাত আর হেনরী ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ওই সময় নির্বাচন কমিশনে তার দাখিল করা হলফনামায় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা। তিনি শিক্ষকতা ও কৃষি খাত থেকে বছরে আয় দেখিয়েছিলেন ১ লাখ ২২ হাজার টাকা, আর ব্যয় ছিল ৮০ হাজার টাকা।
জানা গেছে, নির্বাচনে পরাজয়ের পর ২০০৯ সালে হেনরীকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার দায়িত্ব পালনকালে হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। ঋণ জালিয়াতির মূল হোতা হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও কয়েকজন সদস্য ঘুষ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। দুদক তানভীর ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগপত্র দাখিল করলেও পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। তাদের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। হেনরীকেও দায়মুক্তি দেয় দুদক। জানা গেছে, দুদক থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন হেনরী। তিনি বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লাগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এখন তিনি বছরে আয় করেন ৮ কোটি ৫০ লাখ এবং ব্যয় করেন ৩ কোটি টাকা।
আয়কর নথির তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তার মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ৮ লাখ ৯৫ হাজার ৬০২ টাকা। তার ঢাকা এবং সিরাজগঞ্জে ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে পাঁচটি। যার মূল্য দেখানো হয় ৫ কোটি ২২ লাখ ১৪ হাজার টাকা। এ ছাড়া তার ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে ১ হাজার ৩৪৫ শতাংশ কৃষি এবং ১৯০ দশমিক ৭৫ শতাংশ অকৃষি জমি আছে। যার মূল্য দেখানো হয় ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৫ হাজার টাকা। আর ব্যাংকে এফডিআর আছে ৩৩ কোটি ৪৯ লাখ ২৯ হাজার ৭৬৭ টাকা।
হেনরীর স্থাবর ও অস্থাবর যত সম্পদ : সিরাজগঞ্জে হেনরী ও তার স্বামীর ১৬টি বাড়ি, ২টি রিসোর্ট, একটি গরুর খামারসহ কয়েক হাজার শতাংশ কৃষি ও অকৃষি জমি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ স্টেশন রোডে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। এ ভবনটি তার বোনের নামে। ভবনটির নিচতলায় দোকান ও বাকি ফ্লোরগুলো আবাসিক হোটেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সিরাজগঞ্জ মুজিব সড়কে রাস মেডিকেয়ার নামে একটি ভবন রয়েছে। সয়দাবাদ সদানন্দপুর বাস টার্মিনাল এলাকায় দুটি বাণিজ্যিক ভবন, গজারিয়া এলাকায় হেনরী ভুবন নামে বৃদ্ধাশ্রম, মোতাহার হোসেন তালুকদার হোমিও মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল রয়েছে। ফজল খান রোডে হেনরী স্কলাস্টিকা স্কুল ও কলেজ। সিরাজগঞ্জ মুজিব সড়কে বিলাসবহুল তিনতলা বাড়ি, যেখানে হেনরী বাস করেন। এই ভবনের পাশেই রয়েছে একটি বেসরকারি ক্লিনিক কাম বাণিজ্যিক ভবন। এ ছাড়া মুজিব সড়কে নবনির্মিত বহুতল আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবন। নলিছাপাড়ায় রয়েছে হেনরী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ এবং হেনরী ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সয়দাবাদ সদানন্দপুরে বহুতল আবাসিক ভবন, গ্রামের বাড়িতে রয়েছে একতলা ভবন ও সিরাজগঞ্জ ডাকঘরের বিপরীতে একটি ভবন রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার মিরপুরে ফ্ল্যাট ও জমি আছে। আছে ১০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার।
৯ বিলাসবহুল গাড়ি তার দখলে : সিরাজগঞ্জের সবুজকানন উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন হেনরী। ওই সময়ে তিনি হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতেন। বর্তমানে তার দখলে রয়েছে ৯টি বিলাসবহুল গাড়ি। এর মধ্যে একটি প্রাডো জিপ ঢাকা মেট্রো ঘ-২১-৭৩৪৪, যার ক্রয়মূল্য ৯৫ লাখ টাকা, দুটি প্রাইভেট কারের মধ্যে ঢাকা মেট্রো-গ-৩৯-১৫০৩ নম্বরের গাড়িটির দাম ১৮ লাখ। ঢাকা মেট্রো-গ-৩২-২২৭৭ নম্বরের অন্যটির দাম ২৬ লাখ টাকা। একটি পিকআপ ১২ লাখ টাকা ও পাঁচটি মাইক্রোবাস যথাক্রমে ১৮ লাখ ৫০ হাজার, ১৬ লাখ ৬৫ হাজার, ১০ লাখ ৫০ হাজার, ৩২ লাখ ও ১৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তার ৯টি গাড়ির মূল্য দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে হেনরীর প্রায় ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।
স্বামীর সম্পদ বেড়েছে ১৩৬ গুণ : হেনীরর স্বামীর নাম শামীম তালুকদার লাবু। ২০০৮ সালে লাবুর ৭ লাখ টাকার সম্পদ ছিল। আর ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ কোটি ৫১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭০ টাকা। ১৪ বছরে তার নামে বাড়ি, ফ্ল্যাট, কৃষি ও অকৃষি জমি কেনা হয়েছে। কেনা হয়েছে জার্মানিতে বাড়ি-গাড়ি। সূত্র: দেশ রূপান্তর