আমরা যথা সময়ে কেলগেরি পৌঁছে গেলাম। আমাদের বন্ধুরা আমাদের এয়ার পোর্ট এসে আমাদের নিয়ে গেলো , আমরা দু পরিবার এক সাথে হয়ে আমাদের আনন্দের শেষ নেই। আড্ডা , খাওয়া দাওয়া ঘুরে বেড়ানো এভাবে দুতিন কেটে যাবার পরে আমরা বেড়াতে বের হলাম কেলগেরির দর্শনীয় জায়গা গুলো দেখতে। যেখানে কিনা অনেক লোক বেড়াতে আসে। আবেদিন ভাই আমরা যাবার আগেই ঠিক করেছিলো আমাদের কোথায় কোথায় নিয়ে যাবেন । তার মধ্যে যে জায়গাগুলো ভ্রমন কারীদের সব চাইতে আকর্ষণীও ছিলো এবং সে সব জায়গাগুলোতে দূর দূর থেকেও ভ্রমন কারীরা আসতো সে গুলো দেখার সুভাগ্য হয়েছিলো সে জায়গাগুলো ছিলো Bnaff, Japer, Lake Louise. মন প্রান ভরে গেলো এ জায়গা গুলোতে দেখে। দুদিনের জন্য আমরা এডমনটনও ঘুরে আসলাম আমার কাজিনদের সাথে দেখা করে।
ফিরে এলাম কেলগেরিতে। কেলগেরিতে দুদিন থেকে আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল ভেনকুভারের বর্ডার এর কাছাকাছি পেন্টিংটন এর দিকে। সব কিছু আবেদিন ভাই আর মুন্নি ঠিক করে রেখেছিলো । মুন্নি হলো রান্নার কারিগর। রান্না করা মুন্নির সখ। মুন্নি সাথে নিয়ে নিলো নানা ধরনের খাবার রাস্তায় এবং সেখানে পৌঁছে খাবার জন্য। ড্রাইভ করছেন আবেদিন ভাই । গাড়ি ছুটে চলেছে পাহাড় কাটা রাস্তা ধরে। সাথে চলছে গান গল্প এবং টুকটাক খাওয়া দাওয়া। গাড়ী ম্যাপ দেখে দেখে চলছে আমার স্বামী ম্যাপ গাইড । পিচ ঢালা পথে চলতে চলতে গাড়ীটা ঢুকে গেলো কাঁকর বিছানো কাঁচা রাস্তায়। একটু যেতে না যেতেই দু পাশে ঘন জঙ্গল শুরু হলো । আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম , আমরা ঠিক পথে যাচ্ছি তো ? সাথে সাথে চলছে মুন্নির আবেদিন ভাইকে গঞ্জনার বর্ষণ – “ এই লোকটা কোথায় নিয়ে চলেছে আমাদের ? ওর উপরে ভরসা করাটাই ভুল হয়েছে। এই বন জঙ্গলে ঢুকে আজকে আমাদের কপালে কি আছে শুধু আল্লাহ্ ই জানেন“। আবেদিন ভাই মুন্নির কথার কোনো আমন না দিয়ে খুব আস্তার সাথে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছেন । ভয় আমিও পাচ্ছিলাম। এখানে রাস্তা হারিয়ে ফেললে বাঘ ভালুকরা এসে পুলিসকে খবর দেবে।
আমি আর মুন্নি দোয়া দুরুদ পড়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলছিলাম। এটা কি হলো ? হঠাৎ করে এটা কি দেখলাম ? দুপাশে জঙ্গলময় কাঁচা রাস্তাটা পেরুতেই চোখের সামনে দেখতে পেলাম অসাধারন সুন্দর সাগর। সাগরের পানিতে নীল আভা ছড়িয়ে আছে । আমাদের চোখ মুগ্ধতায় ভরে গেলো । মুন্নির ব্রোকেন রেকর্ড ও থেমে গেলো সাথে সাথে। আবেদিন ভাই সাগরের পাশ দিয়ে গাড়ী চালিয়ে একটু উঁচু পাহাড়ের মতো জায়গাতে গাড়ী থামালো । আমরা এদিক সেদিক তাকিয়ে স্তব্ধ বাকরুদ্ধ । এ কোথায় এলাম আমরা? এযেনো মর্তে স্বর্গ নেমে এসেছে। আবেদিন ভাই গাড়ী থেকে নেমে হাত টান টান করে গর্বিত চোখে আমাদের দিকে তাকালেন। বিশাল এক বাড়ি সমুদ্রের পাশে। চারপাশটা ফুলে ফুলে ভরা সাথে অপূর্ব সুন্দর পাতা বাহার ধরনের বড় বড় গাছ। পাখিরা কিচির মিচির করে এগাছ থেকে সে গাছ আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে । বসন্তের হাওয়া বইছে। আহা কি অসাধারন। আমি আবেদিন ভাইকে জিগ্যেস করলাম “ ভাই কোথায় পেলাম এমন সুন্দর জায়গাটি “ ?
আমাদের সামনে আরেকটু চমক অপেক্ষা করছিলো । আমরা বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই মাঝ বয়েসের চাইতে একটু বেশী হবে একজন মহিলা দরজা খুলে দাঁড়ালো ,
হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো , তোমাদেরই তো আসার কথা আজকে তাই না? আমাদের আই ডি এবং বুকিং এর কাগজ পত্র দেখতে চাইলো । আমরা কাগজে সাইন করে ভেতরে ঢুকলাম । মহিলা বাড়ির মালিক উপর তালায় স্বামী সহ থাকে আর নিচ তালা ভারা দেয় আমাদের মতো অথিতীদের জন্য । আমি মহিলাটিকে মজা করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি স্বর্গেই থাকো মর্তে যাও না? মহিলা আমার কথার প্রথম মানে বুঝতে পারলো না। আমি আমার চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ টা দেখালাম। তখন মহিলা বুঝতে পেরে হো হো করে প্রান খুলে হেসে উঠলো । হাসতে হাসতে জবাব দিলো মর্তে না গেলে চলবে কি করে?
কাজে যেতে হয় বাজার করতে হয় আরো কতো কিছু। কথায় কথায় মহিলা আমাদের জিজ্ঞেস তোমরা কোন দেশের ? আমরা জানালাম আমরা বাংলাদেশের । আমাদের ধারনা ছিলো এই ভদ্র মহিলা পৃথিবীর আরেক প্রান্তে বসে হয়তো বাংলাদেশের নামই জানে না। কিন্তু আমাদের ধারনা ভুল হলো । ক্যানেডিয়ান মহিলা বাংলাদেশের নাম শুনে উল্লাসে লাফিয়ে উঠলো , তোমরা বাংলাদেশের মানুষ ? তোমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি একটা দলের সাথে তিন মাস ছিলাম বাংলাদেশে। ভিক্টিম নারী শিশুদের সাহায্য করার জন্য । শেখ মুজিব তোমাদের নেতা। আমাদের সাথে তাঁর কথা হয়েছে, অত্যান্ত ভালো মানুষ । ভদ্র মহিলার নাম মারিয়া। তার কথায় আমাদের বুক গর্বে ভরে উঠলো । কিন্তু আমাদের গর্ব টা আমরা বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারলাম না, যখন মারিয়া বললো , তোমাদের দেশের লোকজন ভালো না, তোমরা নিজেদের জাতির পিতাকে মেরে ফেললে ?