রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৭ পূর্বাহ্ন

বর্ষার প্রকৃতি

  • আপডেট সময় শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৪

ভাটিবঙ্গের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য বিল। এসব বিল প্রকৃতির খেয়ালে প্রস্ফুটিত অপরূপ সৌন্দর্যের দৃশ্যপট। যা প্রখ্যাত সব শিল্পীর শিল্পকেও হার মানায়। চোখ জুড়ানো এসব দৃশ্য যেন টুকরা টুকরা সোনার বাংলা। আবহমান বাংলার রূপরস ও সৌন্দর্য প্রকৃতি তার আপন মহিমায় সাজিয়ে রেখেছে অনাগত প্রজন্মের জন্য উপভোগ্য করে। শুধু অনাগত প্রজন্মই নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এর রূপ-লাবণ্য উপভোগ করে মনের পিপাসা মিটিয়ে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও যাবে।

ভাটিবঙ্গের যেসব অঞ্চলের বিলের সৌন্দর্য বর্ণনা করা হচ্ছে সেসব অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে মাদারীপুর সদরে পিতম্বর বিল, রাজৈরে লখন্ডার বিল, কদমবাড়ি পদ্মবিল, সদর ও শিবচর উপজেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত বিল পদ্মা, শিবচরের ময়নাকাটা বিল, রাজৈর উপজেলার কোটালীপাড়া নিয়ে বিল বাঘিয়া, টুঙ্গিপাড়া লাল শাপলা বিল, রামশীল বিল, রাধাগঞ্জ বিল, কাফুলাবাড়ি বিল, গোপালগঞ্জ সদরে বলাকইড় পদ্মবিল, গোপালগঞ্জ সদর ও মুকসুদপুর অঞ্চলজুড়ে চান্দা বিল। এই চান্দা বিল এ অঞ্চলের মধ্যে সর্ববৃহৎ।

গোপালগঞ্জ জেলার পার্শ্ববর্তী বরিশাল জেলার উজিরপুর লাল শাপলার বিল (সাতলা)। এইসব বিলের মধ্যে বিল বাঘিয়াসহ দুই-একটি বিল নানা কারণে অস্তিত্ব সংকটে। একই অবস্থা গোপালগঞ্জ-মুকসুদপুর এলাকার বৃহৎ জলাধার চান্দার বিলের। তবে চান্দার বিলে জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এই বিলেও রয়েছে নানা গুল্ম ও জলজ উদ্ভিদ ও বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির মাছ। আছে নানাপ্রকার জলজ প্রাণী। এই বিলকে ঘিরে বিলের চারপাশে বসবাসরত প্রায় ৫০ হাজার মানুষ খেয়েপরে বেঁচে আছেন। এদের অধিকাংশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়। এদের জীবন- জীবিকার একমাত্র উৎস চান্দার বিলের মাছ ও নানাপ্রকার জলজ প্রাণী।

প্রায় ৮শ বছর আগে সৃষ্ট এই চান্দার বিলের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৭০ বর্গকিলোমিটার। ধীরে ধীরে মানুষের প্রয়োজনে বিলের চারপাশে জনবসতি গড়ে ওঠে, যা এখনো চলমান রয়েছে। যে কারণে এই চান্দার বিলের দৈর্ঘ্য হ্রাস পেয়ে বর্তমানে প্রায় ৫০ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে।

তখন এলাকার লোকজন দেশীয় নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ শিকারে নেমে পড়েন। বিলে শত শত ভেসাল পেতে, খেপলা জাল, চায়না দুয়ারী, জুতি, কোচ, দুয়াড়ি, চাঁই, পলোসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। প্রচুর পরিমাণে নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করেন মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন আড়ত ও হাট-বাজারে।

এদিকে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া ৫/৭টি বিলে এখন লালের সমারোহ। বিলের লাল শাপলা দেখে মনে হয় প্রকৃতি যেন বিলজুড়ে লালগালিচা বিছিয়ে রেখেছে। বিলের কালো জলে লাল শাপলার অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে সবাইকে আকৃষ্ট করছে। বিলের প্রাকৃতিক এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থী আসেন। তারা নয়নাভিরাম প্রকৃতির এ অপার সৌন্দর্য উপভোগ করেন। দিন দিন এসব বিলে লাল শাপলার উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাল শাপলা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বাড়িয়ে দিচ্ছে বাড়তি আকর্ষণ। টুঙ্গিপাড়া উপজেলার এসব বিলে মে মাসের দিকে জমিতে জোয়ার ও বর্ষার পানি এসে যায়। এ পানিতেই প্রতিবছর প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয় লাল শাপলা।

গোপালগঞ্জ সদরে রয়েছে বলাকইড় পদ্মবিল। এই পদ্মফোটা বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সৌন্দর্যপ্রেমীরা ছুটে আসেন বলাকইড় পদ্ম বিলে। তারা অনাবিল আনন্দ করতে মনের প্রশান্তিতে বিলে নেমে পদ্মফুল জড়িয়ে কেউ কেউ ছবি তোলেন মধুময় স্মৃতি ধরে রাখতে। এমন দৃশ্য দেখে কে শূন্যহাতে ফিরে যেতে চায়? ভাটিবঙ্গের মধ্যে শুধু একটা নয়; আরও একটি পদ্মবিল রয়েছে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি হয়ে কোটালীপাড়া পর্যন্ত। এই দুটি পদ্ম বিলের সৌন্দর্য পর্যটকদের মন কেড়ে নেবে অনায়াসে। অনেক শৌখিন দর্শক নিজেকে হারিয়ে ফেলেন বাংলার প্রকৃতির মাঝে।

বিল বাঘিয়ার অবস্থান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়নে। এই বিলে প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই চলে আসছে নৌকাবাইচ। দুর্গাপূজার পরে পূর্ণিমায় এই নৌকা বাইচে বৃহত্তর ফরিদপুর ও বৃহত্তর বরিশালের অসংখ্য বাচারী নৌকা অংশ নেয়। নৌকাবাইচকে ঘিরে নৌকায় বসে ভাসমান মেলা। বিলের পাশের ছোট্ট খালে এখনো নৌকাবাইচ হয়। বিল শুকিয়ে যাওয়ায় সেই মেলা এখন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

বিলের উত্তর কোণের গ্রাম রামনগরের অধিবাসী প্রকৌশলী গোপালকৃষ্ণ বাগচী ঢাকায় থাকেন। সুযোগ পেলেই বাড়ি আসেন। বিলের এই দুর্যোগ মোকাবিলার কর্মপন্থা নিয়ে তিনি ভাবছেন। তিনি বলেন, ‘বর্ষার শুরু থেকেই কিছু লোক শামুকের সন্ধানে সারা বিল চষে বেড়ায় ফলে শামুক এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। আবার বর্ষার শুরুতেই পোনা মাছ শিকার ও শীতে পাখি শিকার চলে নির্বিচারে। হয়তো দুই পয়সা রোজগার করছে তারা।

কিন্তু পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি তারা বুঝতে পারছেন না বা আমলেই নিচ্ছেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু এ কাজ করে আয়-উপার্জন হচ্ছে তাই নিষেধ করে এ কাজ থেকে তাদের বিরত রাখা কঠিন। বরং এদের জন্য বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করাই উত্তম।’
রামনগর গ্রামের বাসিন্দা, সরকারি হাসপাতালের ডা. হরষিত হালদার বলেন, ‘এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকার কারণে লোকজন স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। লোকজনের মধ্যে সচেতনতার অভাবে এখানে বাল্যবিয়ে এবং যৌতুক প্রথাও চালু রয়েছে। এদের সচেতন করার কর্মসূচি জোরদার করা দরকার।’

কলাবাড়ী গ্রামের কবি ও সাংবাদিক রবীন্দ্রনাথ অধিকারী বলেন, ‘বিল বাঘিয়ার আয়তন প্রায় ৪ হাজার হেক্টর। বছরের জ্যৈষ্ঠ থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ ৯ মাস এ বিলে পানি থাকে। বাঘিয়াকে ঘিরে প্রায় ২০ হাজার লোকের জীবন- জীবিকা নির্বাহ হয়। রামনগর, কলাবাড়ী, কাফুলাবাড়ী, হাজড়াবাড়ী, কদমবাড়ী, লখণ্ডা, গোবিন্দপুর, বৈকুণ্ঠপুরসহ ছোট ছোট গ্রামের ভূমিহীন কৃষক আর দিনমজুরদের একমাত্র আয়ের উৎস এই বিল। কিন্তু এখন আর সেই আগের অবস্থা নেই।

বিলের পশ্চিমপাশ দিয়ে গেছে রাজৈর-কোটালীপাড়া পাকা সড়ক। বাকি তিনদিকে বিল, সরু খাল ও নিচু জমি। বিলে একসময় সাপ, গুঁইসাপ, কাঁকড়া, ব্যাঙ, আরজিনা, কাঙলাস (গিরগিটি প্রজাতির), কেঁচো, জোঁক, বিছা, জারাইল, ঘুঘরা ও অন্যান্য পোকা-মাকড়, শামুক, ঝিনুক, ফড়িং, কচ্ছপসহ নানা ক্ষুদ্র প্রাণীর বসবাস ছিল যাতে প্রকৃতিগতভাবেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হতো। এখানে মাটির উর্বরতার কারণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই ধান, শাক-সবজি, মসল্লা ও মাছ চাষ হয়ে থাকে বলে এর স্বাদও অন্যরকম।

বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন কাজ বিবেচনায় আনা যেতে পারে। তা হলো, বর্ষাকালে কচুরিপানা দিয়ে ২৫-৩০ হাত লম্বা ও ৮-১০ হাত চওড়া আইল বা ধাপ (স্থানীয় ভাষায় বাইড়া) তৈরি করে তাতে মসলা ও সবজি চাষ করা। ভাসমান এ ধাপে উচ্ছে, ঢেঁড়স, শসা, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, তরই, ডাঁটা, বরবটি, শিম, পুঁইশাক, চুপরিশাক, কচু, বাঙ্গি, হলুদ চাষ করা যায়। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়েও লোকজন স্থানীয় বাজারে সবজি বিক্রি করে লাভবান হতে পারে। সবজির দাম ভালো থাকায় এর থেকে যা আয় হবে তা শামুক বিক্রি থেকে বেশিই হবে। বস্তুত এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ আগের থেকে প্রচলিত থাকলেও ব্যাপকভাবে তা হচ্ছে না। প্রকৌশলী গোপালকৃষ্ণ বাগচী জানান, ‘খাঁচায় মাছচাষ, ঘরে বসে জালবোনা, মহিলাদের জন্য সূচিশিল্প ও গবাদিপশু পালনসহ নানা প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করে দিলে এলাকাবাসী সচেতন হবে ও পরিবেশ ধ্বংসকারী কাজ করা  থেকে বিরত থাকবে।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com