বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:০৫ অপরাহ্ন

১,৯০০ পিএইচডি-ধারী কেন বিদেশে ড্রাইভার ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর চাকরিতে যেতে চান

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০২৪
এসব পিএইচডিধারীদের বাইরে, ৫০ হাজার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীও একইভাবে অভিবাসনের প্রচলিত গন্তব্যগুলোয় গিয়ে স্বল্প-দক্ষতার কর্মসংস্থানে নিযুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

ইলাস্ট্রেশন: টিবিএস

হতবাক হওয়ার মতো এক ঘটনা সামনে এসেছে এবার কর্মসংস্থান বাজার সম্পর্কে। বিদেশে চাকরির জন্য আগ্রহী বাংলাদেশী নাগরিকদের সেবা প্রদানের জন্য সরকারের চালু করা আমি প্রবাসী অ্যাপে নিবন্ধন করেছেন ২ হাজার ৪৭৭ জন বিদেশ গমনেচ্ছু পিএইচডিধারী। যাদের চার ভাগের তিন ভাগই বিদেশে যাওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টায় কায়িক শ্রমের কাজ বেছে নিয়েছেন। এই ঘটনা স্থানীয় কর্মসংস্থান বাজারে তাদের জন্য উপযুক্ত চাকরির অভাবকেও তুলে ধরছে।

অতি উচ্চশিক্ষিত এসব ব্যক্তির মধ্যে কিছুসংখ্যক বিদেশে পেশা হিসেবে প্রকৌশলী, হিসাবরক্ষক, আইটি পেশাজীবী ও চিকিৎসকের মতো উচ্চ দক্ষতার চাকরিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও তাদের মধ্যে সিংহভাগ বা ১ হাজার ৮৭৯ জন অ্যাপটিতে থাকা বিভিন্ন পেশার মধ্যে ‘শ্রমিক’ হিসেবে কাজের আগ্রহও প্রকাশ করেন।

এসব পিএইচডিধারীদের বাইরে, ৫০ হাজার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীও একইভাবে অভিবাসনের প্রচলিত গন্তব্যগুলোয় গিয়ে স্বল্প-দক্ষতার কর্মসংস্থানে নিযুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

অন্যান্য সাধারণভাবে নির্বাচিত কাজের মধ্যে আছে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতা কর্মী, গাড়িচালক, সাধারণ শ্রমিক, হোটেল বয়, সেলস ম্যান, অফিস সহকারী, নির্মাণ শ্রমিক, ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েটার এবং কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি।

যোগ্যতার সাথে চাকরির অসামঞ্জস্য 

উচ্চ শিক্ষিত চাকুরি সন্ধানীদের মধ্যে স্বল্প-দক্ষতার কাজের আগ্রহ বাড়ার এই প্রবণতার জন্য– দেশে পেশাজীবী কর্মসংস্থানের অভাব থাকা, এবং সেই প্রেক্ষাপটে বিদেশে চাকরি নিশ্চিত করার জন্য এই চেষ্টা করাকেও দায়ী করেছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের কর্মসংস্থান বাজারে চাকরি না পাওয়ার হতাশা থেকে অনেক উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিই বিদেশে স্বল্প-দক্ষতার কাজ নিতেও আগ্রহী হয়ে থাকতে পারে। তাঁদের অনেকেই হয়তো মনে করছেন, অ্যাপে নিবন্ধনের সময় কম দক্ষতার পেশা নির্বাচনের অপশন রাখলে তারা বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি সহায়তাও পাবেন। বাংলাদেশের শিক্ষিত জনশক্তির মধ্যে কর্মসংস্থানের প্রত্যাশার একটি বড় ও উদ্বেগজনক পরিবর্তন ঘটারও বার্তা দিচ্ছে এই প্রবণতা।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা রোজানা রশীদ টিবিএসকে বলেন,  “ধারণা করা যায় যে দেশে কর্মসংস্থানের অভাব আছে। সে কারণে মানুষ তাদের নিজের যোগ্যতার চাইতে নিচের জবের জন্য আবেদন করছে। যেটা তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দ্বিতীয়ত, হতে পারে যে তারা ভাবছেন এটা বিদেশ গিয়ে স্থায়ী হওয়ার একটা সুযোগ, এবং একবার যেতে পারলে অনেকেই আর ফেরত আসে না; উন্নত জীবনের সন্ধানে অন্যান্য পেশার দিকে চলে যায়। এটা মনে করেও তারা আবেদন করতে পারে।”

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত আমি প্রবাসী অ্যাপ ও ওয়েব পোর্টাল চালু করা হয় বিদেশে কর্মসংস্থানে আগ্রহী বাংলাদেশীদের সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে। এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রবাসে কর্মসন্ধানীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী পাঁচটি কাজ ও গন্তব্য নির্বাচন করতে পারেন।

অ্যাপে বিশ্বের ১৮০টি দেশে ৫১৫ ধরনের কাজের মধ্যে থেকে পছন্দের কাজ ও গন্তব্য বেঁছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের।

গন্তব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, কুয়েত, ইতালি, সিঙ্গাপুর, বাহরাইন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্য।

কর্মসংস্থান হিসেবে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে শ্রমিক পেশা নির্বাচনের যে তথ্য সামনে এসেছে, সেটি সঠিকভাবে বোঝার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন অধ্যাপক রোজানা রশীদ। তিনি বলেন, “তাঁরা কোথায় পিএইচডি করেছেন এটা জানাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেক্ষেত্রে মানের তারতম্য থেকে যায়। পিএইচডি করলেই যে সবার কোয়ালিটি একরকম হবে সেটা কিন্তু নয়।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন, এপর্যন্ত যে আড়াই হাজার পিএইচডিধারী আবেদন করেছেন, তাঁদের কেউই নিজেদের পিএইচডি বা ডক্টরেট ডিগ্রির কোনো প্রমাণ আপলোড করেননি। আবার অনেকে হয়তো তাঁদের একাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি কম দক্ষতার অপশন বাছাই করে নিজেদের বিদেশে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে চেয়েছেন।”

আবেদনকারী এক নারী নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, তাঁর স্বামী জাপানে থাকেন, তাই তিনিও জাপানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এই অ্যাপের মাধ্যমে আবেদন করেছেন।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি বা সমমানের ডিগ্রি নিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি। তবে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা বা ক্যারিয়ারের লক্ষ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করেন।

সাধারণভাবে পিএইচডিধারীরা স্বল্প দক্ষতার চাকরিগুলোয় আগ্রহ বেশি দেখিয়েছেন; তবে আমি প্রবাসী অ্যাপের তথ্যমতে, অন্তত ৮২ ধরনের দক্ষ ও পেশাজীবী কাজের অপশন-ও তারা বেঁছে নিয়েছেন।

উচ্চ দক্ষতার এসব চাকরির মধ্যে রয়েছে ব্যবস্থাপক, বিপণন বিশেষজ্ঞ, ফার্মেসিস্ট, ব্যাংকার, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, কেমিস্ট, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ও পুষ্টিবিশারদসহ ইত্যাদি নানান ধরনের কাজ |

স্নাতকোত্তর শিক্ষাগত যোগ্যতার একজন কর্পোরেট চাকুরিজীবী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, শুধু বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেতে তিনি ড্রাইভারের চাকরির অপশনটি রেখেছেন। স্বল্প-দক্ষতার চাকরি নির্বাচন করায় বিদেশ যাওয়া সহজ হবে বলে মনে করেছিলেন তিনি।

২০২২ থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত আমি প্রবাসীর ডেটাবেজে ২২ লাখের বেশি নতুন আবেদন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৭২ শতাংশই উচ্চ মাধ্যমিক পাশও করেননি।

প্রশ্নবিদ্ধ পিএইচডির মান

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একজন পরামর্শক এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর টিবিএসকে বলেন,  “যিনি যে সাবজেক্টে পিএইচডি করেছেন– সেটার ভিত্তিতে হয়ত তার চাকরি পাওয়া কঠিন হচ্ছে, সে কারণে অনেকে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। জব মার্কেটের একটা হতাশা কাজ করে থাকতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, ” যেহেতু একাধিক অপশন চয়েজের সুযোগ আছে– তাই অনেকে হয়ত ভেবেছে যে তার সুযোগ বেড়ে যাবে যদি বেশি চয়েজ দেয়। মধ্যপ্রাচ্যেও যদি আলটিমেটলি কোনো একটা কর্মদাতার সাথে এই সুযোগে কানেকশন হয়, তাহলে সে হয়ত নেগোশিয়েশন করতে পারবে, যে আমার কোয়ালিফিকেশন ভাল, কিন্তু জব পাচ্ছিলাম না বলে লেস-স্কিলড জবে আবেদন করেছি” –  যোগ করেন তিনি।

ইউরোপে বেশি প্রতিযোগিতা থাকায় উচ্চ শিক্ষিতদের জন্যও ভাল যোগ্যতা না থাকলে যাওয়া সহজ নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “সেক্ষেত্রে তারা হয়ত চিন্তা করে যদি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে মিড লেভেলের কাজও হয়, তাহলে তিনি যা আয় করবেন– সেটি দিয়ে পরিবারকে সাহায্য করতে পারবেন।”

বর্তমানে দেশের ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পিএইচডি করার সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনা- ২০২২ এর তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে পিএইচডি বা ডক্টরেট ডিগ্রিধারী রয়েছেন ৫১ হাজার ৭০৪ জন। আর ইউজিসির তথ্যমতে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী শিক্ষক্কের সংখ্যা ২০১৭ সালে ছিল ৪ হাজার ৭৬৬ জন, ২০২১ সালে যা বেড়ে ৫ হাজার ৬০৬ জন হয়েছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন ৪ হাজার ৪৩৩ জন শিক্ষার্থী। এছাড়া, ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয় এসময়ে ৪ হাজার ৪৩৩ জন ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করেছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রদত্ত ডক্টরেট ডিগ্রির মান নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষাপটে শিক্ষাবিদরা বলছেন, যেসব প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট মানদণ্ড পূরণ করতে পারবে, কেবল তাদেরই পিএইচডি প্রোগ্রামের অনুমোদন দেওয়া উচিত।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, আমলাসহ সরকারি চাকরিজীবীরা যথেষ্ট গবেষণা না করেই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার ঘটনা নিয়ে শিক্ষাবিদরা এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

সাম্প্রতিক সময়ে ইউনিভার্সিটি অব ব্রুনেই দারুসসালামের ফ্যাকাল্টি সদস্য ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ড. এ কে এম আহসান উল্লাহ একটি সংবাদপত্রের নিবন্ধে লিখেছেন, “বাংলাদেশে বর্তমান পিএইচডি ডিগ্রির দুরবস্থার একটি প্রধান কারণ হলো গবেষণার গুণগত মানের অবনতি। অনেক পিএইচডি প্রার্থী তাড়াহুড়ো করে থিসিস সম্পন্ন করেন, ফলে তাদের গবেষণার মূল যুক্তি এবং ভিত্তি অনেক সময় স্পষ্ট হয় না। গবেষণার গভীরতা এবং মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুতর ঘাটতি দেখা যায়।”

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্বজনপ্রীতি একটি বড় সমস্যা। অনেক সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁদের ক্ষমতা এবং প্রভাব ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনেও অনেকেই রাজনৈতিক মতাদর্শ বিবেচনা করেন।”

বিশিষ্ট গবেষক এবং ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. হাসিনা খান গত ৪ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “আমাদের উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। নিজেদের দেশে পিএইচডি করতে হবে। দেশে পিএইচডি করাটা জরুরি। অনেকেই দেশে পিএইচডির মান নিয়ে প্রশ্ন করেন। মান ঠিক করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়কে সেটি নির্ধারণ করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য দেশে গবেষণা হওয়া জরুরি।”

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com