1. [email protected] : চলো যাই : cholojaai.net
দুই বিলিয়ন ডলার কালো টাকার যে মামলা সিঙ্গাপুরকে নাড়িয়ে দিয়েছে
রবিবার, ২২ জুন ২০২৫, ১১:২৬ অপরাহ্ন

দুই বিলিয়ন ডলার কালো টাকার যে মামলা সিঙ্গাপুরকে নাড়িয়ে দিয়েছে

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪

সিঙ্গাপুরের একটি আদালত স্পর্শকাতর একটি মামলার রায় দেয়া শুরু করেছে। যেখানে ১০ চীনা নাগরিককে বিদেশে অপরাধ কার্যক্রম করে দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার বা ২২০ কোটি ডলার আয়ের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত হয়ে পড়েছিল দেশটির কয়েকটি ব্যাংক, প্রপার্টি অ্যাজেন্ট, দামী লৌহ ব্যবসায়ী এবং শীর্ষস্থানীয় একটি গলফ ক্লাব।

এর জের ধরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ শত কোটি নগদ টাকা ও সম্পদ জব্দ করেছিল। যার রোমাঞ্চকর বিবরণ সিঙ্গাপুরের মানুষকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছে।

জব্দ তালিকায় আছে ১৫২টি প্রপার্টিজ (জমি বা ফ্লাটের মতো সম্পদ), ৬২টি গাড়ি, বিলাসবহুল ব্যাগ ও ঘড়ি, শত শত স্বর্ণালঙ্কার এবং কয়েক হাজার বোতল মদ।

চলতি মাসের শুরুতে সু ওয়েন জিয়াং এবং সু হাইজিন এ মামলায় প্রথম জেল বা কারাদণ্ড পান।

পুলিশ জানায়, সু হাইজিন গ্রেফতার এড়ানোর জন্য বাড়ির দ্বিতীয় তলার বেলকুনি থেকে লাফ দিয়েছিলেন।

তারা দুজনই এক বছরের সামান্য বেশি কারাগারে থাকবেন এবং এরপর তাদের সিঙ্গাপুর থেকে বের করে দেয়া হবে। তারা আর সিঙ্গাপুরে থাকতে পারবেন না। এছাড়া বাকি আটজনের বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত এখনো প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।

মামলাটি নিষ্পত্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে এবং এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরে এটাই সবচেয়ে বড় মামলা, যা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

মামলার প্রসিকিউটররা বলেন, সিঙ্গাপুরে বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তা এসেছে বিদেশের অবৈধ উৎস থেকে, যেমন- কেলেঙ্কারি ও অনলাইন জুয়া।

এদের কয়েকজনের একাধিক পাসপোর্ট ছিল কম্বোডিয়া, ভানুয়াতু, সাইপ্রাস ও ডমিনিকা। কিন্তু কোনো ধরনের যাচাই বাছাই ছাড়া কয়েক বছর ধরে তারা কিভাবে সিঙ্গাপুরে বসবাস করেছে ও ব্যাংক লেনদেন করেছে? এখন এ বিষয় পলিসি পর্যালোচনার বিষয়টি উঠে আসছে আলোচনায়। বিশেষ করে ব্যাংকের নিয়মকানুন শক্ত করার বিষয়ে, বিশেষ করে যারা একাধিক পাসপোর্ট ব্যবহার করেন।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই মামলায় যে বিষয়টির ওপর দৃষ্টি পড়েছে তা হলো অবৈধ আয়ের গন্তব্য দেশে পরিণত না হয়েও ব্যাপক ধনী ব্যক্তিদের স্বাগত জানানো নিয়ে দেশটির চেষ্টা।

‘আমাকে অর্থ দেখাও’
সিঙ্গাপুরকে প্রায়ই এশিয়ার সুইজারল্যান্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দেশটি নব্বইয়ের দশকে ব্যাংক ও সম্পদ ব্যবস্থাপকদের আকর্ষণ করতে শুরু করে। চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার এবং নতুন করে স্থিতিশীল হওয়া ইন্দোনেশিয়ায় সম্পদের প্রবৃদ্ধি দেখা যেতে শুরু করে।

ফলে শিগগিরই বিনিয়োগ বান্ধব আইন, কর মওকুফ সুবিধা ও অন্য সব প্রণোদনার জন্য সিঙ্গাপুর হয়ে ওঠে বিদেশী ব্যবসায়ীদের অন্যতম পছন্দ।

এখন অতি ধনী ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত বিমান নিয়ে সিঙ্গাপুরের প্রাইভেট জেট টার্মিনাল ব্যবহার করতে পারেন। সৈকত এলাকায় বিলাসবহুল বাড়িঘরে বাস করেন । বিমানবন্দরের বাইরেই সর্বোচ্চ নিরাপদ ভল্ট লি ফ্রিপোর্ট আছে তাদের জন্য। এগুলোতে শিল্পকর্ম, অলঙ্কার, ওয়াইন বা এ ধরনের মূল্যবান জিনিসপত্র বিনা শুল্কে রাখা যায়।

সিঙ্গাপুরের অ্যাসেট ম্যানেজাররা ২০২২ সালে বিদেশ থেকে এনেছেন প্রায় ৪৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৭ সালের দ্বিগুণ।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেপিএমজি ও ফ্যামিলি অফিস কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান আগরিয়াসের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবস্থাপনা করে এশিয়ার অর্ধেকেরও বেশি এমন পারিবারিক অফিস ও ফার্ম এখন সিঙ্গাপুরে।

এর মধ্যে আছেন গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন, ব্রিটিশ বিলিওনিয়র জেমস ডায়সন ও বিশ্বের বৃহৎ হটপট রেস্টুরেন্ট চেইন প্রতিষ্ঠান হাইদিলাও-এর মালিক চীনা-সিঙ্গাপুরিয়ান সু পিং।

কর্তৃপক্ষ বলছেন, অর্থ পাচার মামলায় কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তির ফ্যামিলি অফিসের সাথে যোগসূত্র থাকতে পারে। এ অফিস থেকেই কর প্রণোদনা দেয়া হয়।

কারনেজি চায়নার অনাবাসিক স্কলার চং জা-লান বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের মতো দেশের জন্য এটি একটি পরস্পরবিরোধিতা। যেখানে দেশটি স্বচ্ছতা ও সুশাসনের জন্য গর্ব করে। অথচ সেই দেশটিই আবার কম কর ও ব্যাংকিং গোপনীয়তার সুবিধা দেখিয়ে ব্যাপক সম্পদ এনে তা ব্যবস্থাপনাকে সুযোগ দিতে চায়। যারা অবৈধ পথে অর্থ আয় করে সেসব ব্যক্তিদের ব্যাংকার হওয়াটা ঝুঁকির কাজ।’

চীনের সাথে সাংস্কৃতিক নৈকট্যের পাশাপাশি দেশটির উঁচুমানের শাসন ও স্থিতিশীলতার জন্য ধনী চীনা নাগরিকদের জন্য সিঙ্গাপুর শীর্ষ পছন্দের জায়গা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে এসেছে অনেক চীনা অর্থ।

এ মামলায় যে ১০ জন অভিযুক্তর একজন অবৈধ জুয়ায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৭ সাল থেকে চীনে ফেরারি।

প্রসিকিউটররা বলছেন, ‘চীনা কর্তৃপক্ষ যাতে খুঁজে না পায় সেজন্য তিনি একটি নিরাপদ জায়গা চেয়েছিলেন।’

সরল দৃষ্টিতে লুকিয়ে থাকা
সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক কোন ব্যাংকের অর্থনৈতিক অপরাধে জড়ানোর ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ওয়ান এমডিবি কেলেঙ্কারিতে আন্তঃসীমান্ত অর্থ পাচারে তাদের ভূমিকা পাওয়া গেছে, যেখানে মালয়েশিয়ার স্টেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড থেকে বিলিয়ন ডলার অপব্যবহার করা হয়েছিল।

এক সময় ইন্টারপোল ডান তান কে বিশ্বের সবচেয়ে দুষ্ট ম্যাচ ফিক্সিং সিন্ডিকেট হিসেবে আখ্যায়িত করত। তারও শক্তিশালী ব্যবসা আছে সিঙ্গাপুরে। তিনি ২০১৩ সালে সেখানে আটক হয়েছেন।

অথচ অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কে অর্থায়ন ঠেকাতে গঠিত বৈশ্বিক সংস্থা দা ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স-এর সদস্য হিসেবে দেশটিতে শেয়ার জালিয়াতি, করপোরেট প্রতারণা কিংবা অর্থ পাচারের মতো হোয়াইট কালার ক্রাইম প্রতিরোধে শক্ত নিয়ম-নীতি আছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকগুলো কমপ্লায়েন্স, সম্ভাব্য গ্রাহক যাচাই এবং সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট করার জন্য অনেক বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু এর কিছুই নিশ্ছিদ্র নয়।

প্রথম নিয়ন্ত্রকদের জন্য অনেক বড় লেনদেনের মাঝে সন্দেহজনক লেনদেনগুলো চিহ্নিত করা কঠিন।

সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেকেন্ড মিনিস্টার জোসেফাইন টেও গত অক্টোবরে পার্লামেন্টে বলেছিলেন, ‘এটা শুধু খড়ের গাদায় একটি সুই নয়, বরং অনেকগুলো খড়ের গাদায় একটি সুই।’

কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সিঙ্গাপুরের জমজমাট প্রপার্টি মার্কেটের অর্থ হলো ‘ময়লা অর্থ’ পরিষ্কার করো। আর সেখানে আছে ক্যাসিনো, নাইটক্লাব ও বিলাসবহুল দোকানপাট।

সিঙ্গাপুর নানইয়াং টেকনলজিক্যিাল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর কেলভিন ল বলেন, ‘প্রতিদিন সিঙ্গাপুরের ব্যাংকিং সিস্টেমের ভেতর দিয়ে প্রচুর অর্থ আসা যাওয়া করছে। অপরাধীরা এই সিস্টেমের অপব্যবহার করতে পারে এবং বৈধ লেনদেনের ভেতর দিয়ে তারা অর্থ পাচার কার্যক্রমও চালাতে পারে।’

সিঙ্গাপুরে অর্থ বহন করার ক্ষেত্রে কোনো সীমা বেধে দেয়া নেই। তবে ২০ হাজার ডলারের ওপর হলে একটি ঘোষণাপত্র দিতে হয়।

এটাকেও একটি সুবিধা বলছেন সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক ইনভেস্টিগেটিভ রিসার্চ ও রিস্ক এডভাইজরি ফার্ম ব্ল্যাকপিক-এর প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস্টোফার লিয়াহি।

তিনি বলেন, ‘আপনি যদি অনেক অর্থ সরাতে চান, আপনি সরল দৃষ্টিতে লুকিয়ে রাখুন এবং সিঙ্গাপুর এ জন্য দারুণ জায়গা। এখানে কেম্যান আইল্যান্ড বা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে অর্থ রাখা বা ব্যয় করার বিষয় নেই।’

অর্থনৈতিক রাজধানী হিসেবে সিঙ্গাপুরের সুবিধাগুলো কালো টাকাকে আকর্ষণ করছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সেখানকার কর্তৃপক্ষ আইন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্থানীয় একটি পত্রিকাকে গত বছর দেয়া সাক্ষাতকার বিবিসিকে পাঠিয়েছে।

কে শানমুগ্যাম বলেন, ‘আমরা জানালা বন্ধ করে দিতে পারি না। কারণ সেটি করলে বৈধ অর্থ আসতে পারবে না। বৈধ ব্যবসাও তাহলে হতে পারবে না কিংবা করা কঠিন হবে। সে কারণে আমাদের যৌক্তিক হতে হয়।’

পরলোকগত চীনা নেতা দেং জিয়াওপিংয়ের একটি উদ্ধৃতিকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আপনি যখন সফল, আপনি যখন বড় অর্থনৈতিক কেন্দ্র, অনেক অর্থ আসছে, সাথে কিছু মাছিও চলে আসছে।’

কারনেজ চায়নার ডঃ চং বলেন, সিঙ্গাপুরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে ‘ধূসর ছায়া ঢাকা অর্থ’ গ্রহণে তারা কত দূর যাবে।

কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্য সিঙ্গাপুর হয়তো এই মূল্য দিচ্ছে।

লিয়াহি বলেন, ‘অর্থের বড় অংশই বৈধ। তবে বড় অর্থনৈতিক কেন্দ্র হওয়ার কিছু অনিবার্য মূল্য তো আছে।’

সূত্র : বিবিসি

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Developed By ThemesBazar.Com