অন্যান্য দ্বীপদেশগুলোর মত জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও, বাংলাদেশের উপকূলগুলো মোটেই বঞ্চিত হয়নি প্রাকৃতিক শোভা থেকে। পৃথিবীর এই বৃহত্তম ব-দ্বীপের আঙ্গিনা সযত্নে ধুয়ে দিয়ে যায় বঙ্গোপসাগরের ফেনিল জলরাশি। সামুদ্রিক হাওয়ার পরশে পলিমাটির অলঙ্করণে যেন নিয়ত সেজে থাকে কাঁচা জীবনধারার ঘনবসতিগুলো।
চলুন জেনে নেওয়া যাক মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণের আদ্যোপান্ত।
মনপুরা নামের পটভূমি
দ্বীপের নাম কীভাবে মনপুরা হলো সে নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। স্থানীয় বায়োজ্যেষ্ঠদের মতে, দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্য ও উপকূলবর্তী খাবার আগন্তুকদের মন জয় করত। এ কারণেই দ্বীপ ও ইউনিয়নের নাম মনপুরা হয়েছে।
মনপুরা দ্বীপের ভৌগলিক অবস্থান
বঙ্গোপসাগরের উত্তর দিকে মেঘনা নদীর মোহনায় ৩৭৩ বর্গ কিলোমিটার জায়গা নিয়ে জেগে আছে দ্বীপটি। বরিশালের ভোলা জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন স্থলভাগটির তিন দিকে মেঘনা আর একদিকে বঙ্গোপসাগর। ভোলা জেলার প্রাণকেন্দ্র থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত মোট চারটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এক উপজেলা এই মনপুরা।
এর উত্তরে উপজেলার নাম তজুমদ্দিন, দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া। পশ্চিমে রয়েছে তজুমদ্দিনের কিছু অংশ, লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলা।
মনপুরা দ্বীপের বিশেষত্ব
মনপুরার আকর্ষণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে প্রথমেই আছে মাইলের পর মাইল সবুজ ম্যানগ্রোভ বাগান। দক্ষিণের চির সতেজ বনের চারপাশ ঘিরে আছে নদীর ঢেউ।
উপজেলা ঘুরে দেখার সময় পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে উপজেলা পরিষদের ৫ দিঘী এবং চৌধুরী ফিসারিজ প্রজেক্ট। মেঘনা নদীর উপর দিয়ে ৫০০ মিটার দীর্ঘ মনপুরা ল্যান্ডিং স্টেশনটি এখানকার বেশ জনপ্রিয় একটি স্থান। বিকাল থেকে শুরু করে রাত অবধি এখানে ভিড় হয় দ্বীপবাসী ও ভ্রমণকারীদের।
আলমনগর কেওড়া বনে নদীর পার ধরে ভিড় করা হরিণে পাল আলাদাভাবে মনপুরার প্রতিনিধিত্ব করে। জোয়ারের সময় হরিণগুলো মুল সড়কের একদম কাছাকাছি চলে আসে। কখনও এমন অবস্থা হয়, এদের নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হওয়ার জন্য গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
এ ছাড়া, মনপুরার চরগুলো শীতের মৌসুমে বিচিত্র ধরনের অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থাকে। ছোট-বড় সব মিলিয়ে মোট ১০টি চর রয়েছে এই মনপুরায়। এগুলো হলো- চর মুজাম্মেল, চর পাতালিয়া, চর নিজাম, চর পিয়াল, লালচর, চর শামসুউদ্দিন, ডাল চর, কলাতলীর চর ও চর নজরুল।
কুয়াকাটার মত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য এই দ্বীপের খ্যাতি রয়েছে। জনবসতির মাঝে দেখা যায় বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত পুকুর, যাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে সারি সারি নারকেল গাছ।
যারা সাইক্লিং ভালোবাসেন তাদের জন্য এই মনপুরা সেরা জায়গা। এ ছাড়া সবুজের সমারোহে ক্যাম্পিং করা যেকোনো হোটেলে রাত্রিযাপনের দারুণ বিকল্প হতে পারে।
মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণের সেরা সময়
এখানে মন ভরে ঘুরতে হলে আসতে হবে শীতকালে। কিছুটা শুষ্ক থাকায় ঠান্ডা মৌসুমে সাইক্লিং ও তাঁবু খাটানোর আনন্দটা পুরোটাই পাওয়া যাবে। পাশাপাশি সুযোগ থাকে বিরল সব অতিথি পাখি দর্শনের। অন্যান্য মৌসুমগুলোতে বিশেষ করে বর্ষার সময় এখানে আসার সমুদ্র পথটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
ঢাকা থেকে মনপুরা দ্বীপ যাওয়ার উপায়
ভোলা শহরের স্থলভাগের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগসূত্র না থাকায় এই দ্বীপে পৌঁছানোর একমাত্র বাহন হচ্ছে লঞ্চ ও ট্রলার।
এজন্য প্রথমে ঢাকার সদরঘাট থেকে হাতিয়ার লঞ্চে উঠতে হবে। লঞ্চগুলো প্রতিদিনি বিকাল ৫টায় ছাড়ে এবং পরদিন সকাল সাড়ে ৭ টার মধ্যে মনপুরা পৌঁছায়।
১২ থেকে ১৩ ঘন্টার এই দীর্ঘ যাত্রায় লঞ্চের ডেক ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৩৫০ টাকা। নন-এসি সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া ১ হাজার ৮০০ টাকা এবং ডাবল কেবিন ভাড়া ২ হাজার টাকা। ডিলাক্স ডাবলের জন্য খরচ করতে হবে ৩ হাজার ৫০০ টাকা, যেখানে ভিআইপি কেবিনে পড়বে ৫ হাজার টাকা।
ফেরার সময় সরাসরি ঢাকার পথ ধরতে হলে মনপুরার রামনেওয়াজ লঞ্চঘাটে দুপুর ২টার আগেই উপস্থিত থাকতে হবে।
আরেকটি পথ হচ্ছে, ঢাকা থেকে বরিশালের ভোলা হয়ে যাওয়া। ঢাকা-টু-মনপুরা লঞ্চগুলো রাত ১২টার দিকে ভোলার জংশন ঘাটে থামে। এরপর থামে ইলিশা ফেরিঘাটে রাত সাড়ে ১২টায়, দৌলতখান ঘাটে রাত ২টায় এবং রাত সোয়া ৩টায় হাকিমুদ্দিন ঘাটে। শেষ রাতে পৌনে ৪টায় সরাজগঞ্জ ঘাটে ভেড়ে, আর সবশেষে ভোর পৌনে ৫টায় থামে তজুমুদ্দিন ঘাটে। এই ঘাটগুলোর যে কোনোটি থেকে মনপুরায় যাওয়া যায়।
তজুমদ্দিন ঘাট থেকে মনপুরা দ্বীপের উদ্দেশে সি-ট্রাক ছাড়ে প্রতিদিন বিকাল ৩টায়। পরদিন সকাল ১০টায় এটি মনপুরা থেকে ফেরার পথ ধরে।
ভোলার চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাট থেকে মনপুরার লঞ্চ আছে, যেটি জনতা বাজারে থামে। এই পথটি এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত আবহাওয়া প্রতিকূল থাকার কারণে বন্ধ থাকে।
দ্বীপে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার উপায় হলো অটোরিকশা, রিকশা, মোটর বাইক, বোরাক ও সাইকেল। এক মোটরসাইকেলে পুরো দ্বীপ ঘোরার জন্য খরচ পড়তে পারে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
মনপুরা দ্বীপে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
এখানে রাত্রিযাপনের জন্য রয়েছে উপজেলা সরকারি ডাকবাংলো, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভবন এবং কিছু বেসরকারি হোটেল।
সরকারি ডাকবাংলো ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভবনে থাকার জন্য যথারীতি আগে থেকেই অনুমতি নিতে হবে। এগুলোতে বেশ স্বল্প খরচে রাত কাটানো যাবে।
অন্যান্য হোটেলে রুম ভাড়া নিতে পারে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো।