তুষারের চাদরে জড়ানো পর্বত, উপত্যকা, খরস্রোতা পাহাড়ি নদী, বাহারি ফুলের বাগান, সবুজ মাঠ আর উইলো বনের সৌন্দর্যে মিলে মিশে একাকার ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর। এখানকার বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির নানান রূপসজ্জায় তাই কাশ্মীরকে বলা হয় প্যারাডাইস অফ আর্থ। পৃথিবীর এই স্বর্গে ভ্রমণ করাটা তাই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো। তবে কাশ্মীর কার্যত তিন ভাগে বিভক্ত। কাশ্মীরের উত্তর কারাকোরাম ভূমিভাগ রয়েছে চীনের দখলে। আর পাকিস্তানের দখলে রয়েছে আজাদ কাশ্মীর অংশ। তাই বাংলাদেশীদের ভ্রমণের জন্য ভারতের অংশ, জম্মু-কাশ্মীরই সবচেয়ে নিরাপদ ও সহজ গন্তব্য।
বাংলাদেশ থেকে খুব সহজেই ভারতের ভ্রমণ ভিসা পাওয়া যায়। এছাড়া ভারতের অন্য যেকোন ভিসা থাকলেও যাওয়া যাবে কাশ্মীর। ঢাকা থেকে জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের দূরত্ব ১৯০০ কিলোমিটার। এই দূরত্ব পাড়ি দেয়ার জন্য চেপে বসতে পারেন বিমান অথবা ট্রেনের যে কোন একটিতে। বিমানে গেলে খরচ নি:সন্দেহে যথেষ্ট বেশি হবে। আর ট্রেনে ভ্রমণ করলে অনেক কমেই ভ্রমণ শেষ করা সম্ভব তবে তাতে সময় লাগবে অনেক বেশি। তাই কম খরচে লাক্সারি ট্যুর করতে চাইলে কিছুটা হিসেবি হওয়া চাই। দরকার সঠিক পরিকল্পনা। তাহলেই খুব সহজে বাড়তি খরচ বাঁচিয়ে প্রিমিয়াম ট্রাভেল সম্ভব।
আমি যেহেতু মাইনাস টেম্পারেচারের কাশ্মীর দেখতে চেয়েছি তাই বিমান এবং রেলপথের সমন্বিত যাত্রা বেছে নিয়েছি। এছাড়া সময় এবং খরচ বিবেচনা করে ঢাকা থেকে দিল্লি পর্যন্ত গিয়েছি বিমানে। মাস খানেক আগেই পরিকল্পনা শুরু, বিভিন্ন বুকিং ওয়েবসাইট দেখে সবচেয়ে কম খরচে বিমান বাংলাদেশের টিকিট নিয়েছিলাম। আমাদের দুইজনের জন্য ঢাকা–দিল্লি–ঢাকা রাউন্ড ট্রিপের খরচ পড়েছিলো ৩২ হাজার ৫০০ টাকা।
এরপর দিল্লি থেকে জম্মু পৌঁছেছি ট্রেনে। ভারতীয় রেলের (আইআরসিটিসি) অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে এসি থ্রি টায়ার স্লিপার টিকিট কেটেছি জন প্রতি ১৫০০ রুপিতে। তারপর জম্মু থেকে শেয়ার গাড়িতে করে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছি রাজধানী শ্রীনগরে।
দিল্লি থেকে শ্রীনগর বিমানে গেলে কম সময়েই যাওয়া সম্ভব তবে ভাড়া কিছুটা বেশি। এছাড়া দুই ফ্লাইটের মাঝে দিল্লিতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টার ট্রানজিট থাকায়, এই সময়টা আমি কাজে লাগাতে চেয়েছি। সে জন্যই এই অংশটা আমি বিমানের পরিবর্তে কম খরচে রেলপথ ও সড়কপথ বেছে নিয়েছি।
পুরোটা পথ ট্রেনে যেতে চাইলে সে উপায়ও আছে তবে সময় লাগবে অনেক। সেক্ষেত্রে প্রথমে ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে হবে। কলকাতা যাবার জন্য আছে মৈত্রী এক্সপ্রেস। ট্রেনে কলকাতা নামতে হবে তারপর ওখান থেকে ৩৫-৩৬ ঘণ্টা সফর করে ‘জম্মু’ যেতে হবে। কলকাতা থেকে জম্মু যাওয়ার জন্য ‘হিমগিরি’ ও ‘জম্মু তাওয়াই’ নামের দুইটি ট্রেন আছে।
সপ্তাহে তিন দিন (মঙ্গল, শুক্র এবং শনিবার) রাত ১১টা ৫০ মিনিটে কলকাতার হাওড়া থেকে জম্মুর উদ্দ্যেশে রওনা দেয় হিমগিরি ট্রেন। আর তাওয়াই প্রতিদিনই যাতায়াত করে হাওরা টু জম্বু, তবে সময় বেশি লাগে। সে ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না থাকলে হিমগিরিতে যাওয়াই ভালো। তারপর জম্বু থেকে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার সফর শেষে শ্রীনগর যেতে হবে।
রূপে অন্যান্য কাশ্মীর যেকোনো সময়ই ভ্রমণ পিপাসুদের ভালো লাগার মতো একটি জায়গা। তবে কিছু বিশেষ সময়ে কাশ্মীরের সৌন্দর্য বিশেষভাবে ধরা পড়ে সবার চোখে। শীতকাল হিসেবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে কাশ্মীরে চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। সাথে ভাগ্য ভালো থাকলে পেতে পারেন স্নোফল। তাই এই সময় কাশ্মীরে গেলে চারপাশের এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়বে। তবে শীতকালে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাড়তি সাবধানতার প্রয়োজন আছে।
ফুলে ভরা উপতক্যায় দাঁড়িয়ে চোখ জুড়াতে চান তাহলে আপনার জন্য সেরা সময় এপ্রিল থেকে মে পর্যন্ত।
তবে জুলাই থেকে আগষ্ট পর্যন্ত কাশ্মীরে ঘুরতে না যাওয়াই ভালো। কারণ সে সময় প্যাহেলগামে, হিন্দু দেবতা ভগবান শিবের গুহা মন্দিরে ৬২ দিন ধরে অমরনাথ যাত্রা চলে। যার ফলে শহরজুড়ে বাড়তি ট্রাফিক লেগে থাকে এবং ভ্রমণের সময়সূচিতে ব্যাঘাত ঘটে।
আমি যেহেতু ভ্রমণের জন্য শীতকালটাকেই বেছে নিয়েছি তাই পুরো সময়টা আমাদের মোটামুটি ১ ডিগ্রী থেকে মাইনাস ৬ ডিগ্রী তাপমাত্রায় থাকতে হবে সেটা আগেই ওয়েদার আপডেট দেখে নিয়েছি। সে জন্য ঢাকা থেকেই দুইজনের জন্য মাইনাস টেম্পারেচারের জন্য ভারি জ্যাকেট, বুট জুতা, হাত মোজা সহ কিছু শীতের পোশাক কিনে নিয়েছি। কেউ কিনতে না চাইলেও শ্রীনগরে যেয়ে ভাড়া নিতে পারেন। তবে আমার কাছে সামান্য কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে, ঢাকার বঙ্গবাজার থেকে নিজের পছন্দমতো মাইনাস টেম্পারেচারের পোশাক কিনে নেয়াটাই লাভজনক মনে হয়েছে।
এছাড়া প্রয়োজনীয় হোটেল ও হাউসবোট বুকিং দিয়েছি আগোডা থেকে। আর ফেসবুক গ্রুপ কমিউনিটি “টিওবি হেল্পলাইন” থেকে সন্ধান পেয়েছি দারুণ একজন ড্রাইভার কাম গাইড সিরাজ ভাইয়ের। উনি এর আগেও অনেক বাংলাদেশিদের কাশ্মীর ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। লোকাল সাইটসিং করতে উনি একটি সেডান কারের ভাড়া নিয়েছেন দিন প্রতি দুই হাজার রুপি করে।
সাব্বির আহমেদ