ফাবিআইয়া হাসান। জন্ম ঢাকায়। বাবা কমোডর কাজী কামরুল হাসান। ছিলেন নৌ-বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বাবার পোস্টিংয়ের কারণে অনেক স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছে।
যেতে হয়েছে এক শহর থেকে আরেক শহরে। পড়াশোনা করেছেন ইংলিশ মিডিয়ামে। সেখান থেকে ও লেভেল, এ লেভেল শেষ করে আইন বিষয়ে ভর্তি হয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে।
বিশ্বের বিখ্যাত মানুষদের জীবনী পড়ে, মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করার ব্রত নিয়ে ব্যারিস্টারি পড়েন। ২০২০ সালে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। ব্যারিস্টারি শেষ করে তিনি নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশি নারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। সেখানে তিনি ছয় মাস লিগ্যাল ইন্টার্ন হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এখন কাজ করছেন মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রকল্পে। বাংলাদেশের আইন সংস্কারে কাজ ও নারীর অধিকার নিয়েও কাজ করতে আগ্রহী এ ব্যারিস্টার।
আন্তর্জাতিক আদালতে কাজের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিসহ বাংলাদেশে নারীদের সার্বিক অবস্থা, তাদের অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যারিস্টার ফাবিআইয়া হাসান। নিচে তা উপস্থাপিত হলো-
কেন আইন পড়লেন?
ব্যারিস্টার ফাবিআইয়া হাসান : কিশোর বয়সে যখন আমি সুসান অ্যান্টনি, রোজা পার্কস ও নেলসন মেন্ডেলার মতো বিপ্লবী ব্যক্তিদের সম্পর্কে পড়তে শুরু করি, তখন আমি বুঝতে শুরু করি যে মৌলিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো কতটা অপরিহার্য। আমি উপলব্ধি করতে শুরু করি কীভাবে আইন ও শৃঙ্খলা জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ওই সময় থেকে একজন মানবাধিকার আইনজীবী হওয়ার অঙ্গীকার করি। এ কারণে আইন পড়া শুরু করি। ২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে আইন বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করি। ইক্যুইটি অ্যান্ড ট্রাস্টস ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ আইনে ডিস্টিংকশনও পাই।
বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের জন্য কীভাবে ব্যক্তিদের বিচার করা হয় তা শুধু শিখেছি এমন নয়, আদালতের কার্যাবলীতেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। শিক্ষক ব্যারিস্টার তৌফিকুর রহমান ও ব্যারিস্টার সৈয়দ-উল দিনারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কারণ, তারা আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত ও সমর্থন দিয়েছেন।
পরিবার ও বেড়ে ওঠা নিয়ে যদি কিছু বলতেন…
ব্যারিস্টার ফাবিআইয়া হাসান : আমার বাবা কমোডর কাজী কামরুল হাসান নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। মূলত তিনি ছিলেন একজন প্রকৌশলী। মা ফেরদৌস আরা দর্শনে স্নাতক। তিনি একজন গৃহিণী। একমাত্র ভাই শাটলের ম্যানেজার। ঢাকায় জন্ম। বাবার পোস্টিংয়ের কারণে অনেক স্কুল চেঞ্জ করতে হয়েছে আমাকে। এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে হয়েছে। বিভিন্ন শহরে আমার শৈশব কেটেছে। অল্প সময়ের মধ্যে অ্যাঙ্করেজ, সিজিএসসহ অনেক স্কুলও পরিবর্তন করতে হয়েছে।
ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়ার দিনগুলো কীভাবে কেটেছে?
ব্যারিস্টার ফাবিআইয়া হাসান : আমি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে ২০২০ সালে বার এট ল পাস করি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে আত্মতৃপ্তির বছর ছিল। তবে, কোর্সের শেষ কয়েক মাস কোভিড-১৯ এর কারণে চ্যালেঞ্জিং ছিল। ওই সময় অনেক আইনজীবী ও বিচারকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। এমনকি অবসর সময়ে ম্যাজিক সার্কেল সলিসিটারদের অধীনে কাজ করারও সুযোগ পেয়েছি।
নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) বিশ্বের একমাত্র স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত এবং সেখানে কাজ করা আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল।
লন্ডনে একজন বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজীবী এবং একজন ওবিই-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তারা আমার মানবাধিকার আইনের প্রতি আগ্রহ দেখে আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদনের পরামর্শ দেন। এক বছর পর আমি নেদারল্যান্ডের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আবেদন করি। কিন্তু তার আগে, বার পরীক্ষা পাস করে আমি ঢাকায় ফিরে আসি এবং কিছুদিন ব্যারিস্টার সাদাত সারওয়াত অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে লিগ্যাল অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করি। এছাড়া এক বছরেরও বেশি সময় অ্যাক্টিভিস্ট রেজাউর রহমানের সঙ্গে বেশ কয়েকটি মানবাধিকার প্রকল্পে কাজ করি।
নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক আদালতে কাজের অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন…
ব্যারিস্টার ফাবিআইয়া হাসান : নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) বিশ্বের একমাত্র স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত এবং সেখানে কাজ করা আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। আইসিসি প্রতি বছর কিছু আইনি ইন্টার্ন নেয় এবং সারা বিশ্বের হাজারও তরুণ আইন পেশাজীবী একই পদের জন্য আবেদন করেন। যে কারণে নির্বাচন প্রক্রিয়াও খুব প্রতিযোগিতামূলক হয়।
আমি সেখানে ছয় মাস কাজ করি। ওই ছয় মাস ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। ২০২১ সালের নভেম্বরে আমাকে আদালতের প্রসিকিউশন বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং একজন অসাধারণ অভিজ্ঞ ট্রায়াল আইনজীবী মেলিসা প্যাকের তত্ত্বাবধানে আমি আদালতের বিভিন্ন কাজ এবং আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে বিশদ ধারণা লাভ করি। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের জন্য কীভাবে ব্যক্তিদের বিচার করা হয় তা শুধু শিখেছি এমন নয়, আদালতের কার্যাবলীতেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি।
আমি আমার চোখের সামনে সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে দেখেছি। পুরো অভিজ্ঞতাটা আমাকে জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি গুরুতর অপরাধ প্রতিরোধের মাধ্যমে মানবতা নিয়ে কাজ করতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করেছে।
আপনি কি আইসিসিতে ইন্টার্নশিপ করা প্রথম বাংলাদেশি নারী?
ব্যারিস্টার ফাবিআইয়া হাসান : বাংলাদেশ ২০১০ সালে আইসিসিতে যোগ দেয়। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আইসিসিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব কম। আমি সেখানে একমাত্র বাংলাদেশি নারী ছিলাম। আশা করছি, আরও নারীরা সেখানে কাজ করতে অনুপ্রাণিত হবে। আমি অনারেবল সোসাইটি অব লিংকনস ইনের কাছে কৃতজ্ঞ যে তারা আমাকে পুরস্কৃত করেছে। কারণ, একজন বাংলাদেশি নারী সদস্য হিসেবে এবং মানবাধিকার আইনের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আইসিসিতে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে পেরেছি।
যারা আইন পড়তে চান, তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন…
ব্যারিস্টার ফাবিআইয়া হাসান : আমি মনে করি আইন পড়া একটি ক্রমাগত শেখার প্রক্রিয়া। যেখানে বিভিন্ন আইন সময়ের সাথে আপডেট হতে থাকবে। যারা আইন পড়তে চান তাদের প্রতি আমার পরামর্শ হল যে তারা আইনকে যতটা শ্রদ্ধা করবে ততটাই তারা আইনকে প্রশ্ন করবে যেখানে পরিবর্তন প্রয়োজন। এভাবেই তারা একটি সমাজে আইনের উদ্দেশ্য বুঝে উঠতে পারবে।
প্রতিটি নারীর মনে রাখা উচিত যে মাতৃত্বই তাদের একমাত্র অস্তিত্ব নয়, তাদের প্রতিটি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অংশগ্রহণ করা জরুরি।
আপনার স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ব্যারিস্টার ফাবিআইয়া হাসান : আমি একজন সফল মানবাধিকার আইনজীবী হতে চাই। প্রধানত যুদ্ধে যৌন সহিংসতা এবং অন্যান্য নারী অধিকার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাই। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ল রিফর্ম নিয়েও কাজ করতে চাই। আমরা জানি আমাদের দেশের সংবিধান মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়।
আমাদের সমাজের নারীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতেন…
ব্যারিস্টার ফাবিআইয়া হাসান : আমি বিশ্বাস করি যে একজন নারী একটি সমাজ গড়ে তোলে। তাদের মর্যাদা অতুলনীয়। প্রতিটি নারীর মনে রাখা উচিত যে মাতৃত্বই তাদের একমাত্র অস্তিত্ব নয়, তাদের প্রতিটি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অংশগ্রহণ করা জরুরি।
একজন নারী হওয়ার আগে, তারা মানুষ এবং প্রতিটি মানুষেরই যে কোনো জায়গায় অংশগ্রহণ করা উচিত।
দুর্ভাগ্যবশত আমরা একটি পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বে বাস করি, তাই আমি আন্তরিকভাবে নারীদের একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই, যেন বাধা অতিক্রম করা সহজ হয়।