সাগরপাড়ের সৌন্দর্য ও জীবনধারা দুইই ভিন্ন আবহে ধরা দেয় আমাদের কাছে। আর এই সৌন্দর্যের আস্বাদন এবং জীবনধারার অভিজ্ঞতা পেতে সাগর ও নদীর মোহনার দ্বীপের চেয়ে ভালো স্থান আর কোথায় হতে পারে?
ঘুরে আসলাম মেঘনার মোহনায় বঙ্গোপসাগরের পাড়ে অবস্থিত দ্বীপ জেলা ভোলার চরফ্যাশন, মনপুরা ও নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ। প্রথম পর্বে ছিল চরফ্যাশন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, আজকের পর্বে থাকছে অনন্য সুন্দর দ্বীপ মনপুরা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।
সমুদ্রের হাওয়া কার না ভালো লাগে? আর সেই হাওয়া যদি উপভোগ করা যায় বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে বসে, কেমন হয়? নিশ্চয়ই রোমাঞ্চকর হবে। ঠিক তাই ঘুরে আসলাম অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি, অনন্য জীবন সংস্কৃতির দ্বীপ মনপুরায়।
মনপুরার তিন দিকে মেঘনা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। মনপুরা নামে সিনেমাটি মুক্তির পর মোহনার এই দ্বীপটিতে পর্যটনের আনাগোনা আরও বেড়ে গেছে।
চরফ্যাশনে ঘোরাঘুরি শেষে স্পিডবোটে রওনা দিলাম মনপুরার উদ্দেশে। ছোট ছোট ঢেউ আর একটু দূরেই দেখা মেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যানগ্রোভ বনের সবুজ বৃক্ষ। হাওয়ার তোড়ে দোল খাচ্ছে গাছগুলো, মনে হচ্ছে যেন আমাদের স্বাগতম জানাতেই তাদের এই আয়োজন।
কাছে দূরে ছোট বড় বেশ কিছু নৌকা মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত। কেউ জাল ফেলছে, কেউ আবার জাল তুলছে। নৌকায় লাগানো হরেক রকমের পতাকা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। আর আমরা এগিয়ে চলেছি মনপুরার দিকে। একপাশে পানিতে মাথা ভাসিয়ে থাকা ধানের ক্ষেত দেখে বুঝতে পারলাম মনপুরার খুব কাছে চলে এসেছি।
স্পিডবোটে দীর্ঘ সফর শেষে যখন হাজিরহাট ঘাটে নামলাম, সৌন্দর্য যেন ধরা দিল রোমাঞ্চের সাথে। ঘাট থেকে নদীর অনেকটা দূর পর্যন্ত কংক্রিটের ল্যান্ডিং স্পট। ভাটা থাকায় বোট থেকে নেমে খানিকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম কংক্রিটের ওই ছোট সড়কে। জোয়ারের সময় এখানে দাঁড়ালে মনে হয় যেন মাঝ নদীতে দাঁড়িয়ে আছি আর ঢেউগুলো আঁছড়ে পড়ছে গায়।
ঠিক ঘাটেই হাজিরহাট মাছের ঘাট। মাছের নৌকা এখানে খুব একটা ভিড়ে না, আবার কমও না। গিয়েই দেখি মাছের নিলাম চলছে। ছোট-বড় ইলিশ মাছ হালি হিসেবে বিভিন্ন দামে নিলামে ক্রয়-বিক্রয় চলছে। কিছুক্ষণ ঘাটের সৌন্দর্য উপভোগ করে, এক দোকানে চা খেয়ে ২০ টাকায় রিকশা ভাড়া করে রওনা দিলাম হাজিরহাট বাজারের দিকে, সেখানকার হানিফ হোটেলে আমাদের রুম বুকিং করা আছে।
হোটেলে কিছুক্ষণ আরাম করে দুপুরে কাছেই সীমা হোটেলে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাম নেওয়াজ ঘাটের উদ্দেশে। ঘাটে ছোটবড় মাছ ধরার অগণিত নৌকা ভেড়ানো। তার কোনটা থেকে মাছ নামানো হচ্ছে, কোনোটাতে জেলেরা বসে জাল মেরামতের কাজে ব্যস্ত, কোনোটাতে আবার নিতান্তই অলস সময় কাটাচ্ছে জেলেরা। হয়তো মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আড়তগুলোর দিকে হাঁটলাম, সেখানেও বেশ শোরগোল, মাছের নিলাম হচ্ছে। ইলিশ, পোয়া, বাটা, পাঙ্গাসসহ বিভিন্ন মাছ। কথা হলো ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন দ্বীপকের সঙ্গে। উনি নিজেও একজন আড়তদার। জানালেন, এবার মাছ ধরা পড়ছে তুলনামূলক কম। জেলে আড়তদার সবারই একটু খারাপ সময় যাচ্ছে। যাবে না? এটাই যে এদের একমাত্র অবলম্বন।
কথা বলতে বলতে পাশের আড়তে নামানো হলো এক পাঙ্গাসের চালান। জেলে আড়তদার সবাই খুশি, এক ঝাঁক পাঙ্গাস ধরা পড়েছে যে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যেটি, ওজন হবে ১২ কেজির ওপরে। জেলে ভাইকে হাতে নিয়ে দাঁড়াতে বললাম, ছবিও তুলে ফেললাম কিছু। জেলে ভাইদের খুশি আমাদেরও পেয়ে বসলে যেন।
পরদিন গেলাম জনতা ঘাটে। মোটরসাইকেলে হাজিরহাট থেকে ২০০ টাকা ভাড়া। রাস্তার দুই ধারে ম্যানগ্রোভ, নানান পাখি ডাকছে গাছে গাছে। হরিণও নাকি দেখা যায় এদিকে, যদিও আমাদের চোখে পড়েনি। ভোরে কিংবা সন্ধ্যায় গেলে নাকি দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। জনতা ঘাটও বেশ বড়। অনেক নৌকা এখানেও। কিছু নৌকায় দেখলাম ঢাকায় মাছ পাঠানোর জন্য বরফযোগে প্যাকেজিংয়ের কাজ চলছে। সেই সময়ে সদ্য সাগর থেকে মাছ ধরে ঘাটে ফেরা ট্রলারে উঠতে গিয়ে অসতর্কতাবশত সাইলেন্সারে ধরে ফেলে তো হাতই পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
জনতা ঘাট ঘুরে, গেলাম আরও ছোটবড় কিছু ঘাটে। সন্ধ্যায় রিকশায় চলে গেলাম জংলার খালে। কী মনোরম পরিবেশ, শীতল হাওয়া।
পরদিন সূর্যোদয় দেখে, সকালের নাস্তা করে রওনা দিলাম নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশে। যাওয়ার পথেই ঢু মারলাম মনপুরা সমুদ্র সৈকতে। ঢেউ আচঁড়ে পড়ছে কূলে, বালকরা ডুব সাঁতার খেলছে। কেওড়া বন থেকে কেওড়া ফল পেড়ে রাস্তার পাশে বসে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আশেপাশের বাড়ির কয়েকজন মহিলা। আমরা খেতে চাইলে নিরাশ করেনি। টক এই কেওড়া ফলের স্বাদ আপনারাও নিতে পারেন।
মনে হচ্ছিল আরও কয়েকটা দিন থেকে যেতে পারলে মন্দ হতো না, কিন্তু কী আর করার, সময় যে বাঁধা মানে না। সময় হলে আপনারাও ঘুরে আসুন মন জুড়ানো এই মনপুরায়।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে চরফ্যাশনের কথা তো প্রথম পর্বেই বলেছি। চরফ্যাশন থেকে সি ট্রাকে কিংবা স্পিডবোটে মনপুরা যেতে পারেন, নামতে পারেন হাজিরহাট কিংবা জনতা ঘাটে। হাজিরহাট ঘাট থেকে হোটেল কাছে হওয়ায় আমরা সেখানেই নেমেছি। নয়জনে রিজার্ভ করা স্পিড বোটে আমাদের খরচ হয়েছিল চার হাজার টাকা।
যেখানে থাকবেন
খুব বেশি ভালো হোটেল এখানে নেই। তবে হানিফ হোটেল, ফাহিম হোটেলসহ বেশ কয়েকটি হোটেল আছে কাজ চলে যাওয়ার মতো, খরচও তুলনামূলক কম।
যা খাবেন
এখানে বিভিন্ন রকমের সামুদ্রিক মাছ খেতে পারেন, তাছাড়া এখানকার হাঁসের মাংস ও মহিষের দুধের কাঁচা দইও বিখ্যাত।