বোর্ডের পরীক্ষা চলছে রাজ্য জুড়ে। কারও খুব ভাল পরীক্ষা হচ্ছে, তো কেউ আবার পরীক্ষা হল থেকে বেরিয়েই কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরছে। আর সবচেয়ে ভয়ানক অবস্থা হবে ফলাফল প্রকাশের দিন। কারও বাড়ি মিষ্টির প্যাকেটে ভরে যাবে, আর কেউ খারাপ ফলাফলের জন্য হয়তো হতাশায় ডুবে যাবেন।
কিন্তু একটা পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া মানেই জীবনে ব্যর্থ হওয়া নয়। আমাদের চারপাশেই এমন অনেকে রয়েছেন, যাঁরা স্কুলের পরীক্ষায় একেবারেই ভাল ফল করে উঠতে পারেননি, কিন্তু আজ তাঁরাই জীবনে প্রকৃত সাফল্য অর্জন করেছেন। ক্লাসে প্রথম হওয়া সেই সহপাঠীকেও অনেক পিছনে ফেলে এসেছেন।
আজ এমন একজন ভারতীয়ের সঙ্গে পরিচয় করানো যাক, যিনি ভীষণ সাধারণ মানের পড়ুয়া ছিলেন স্কুলে। নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরে এবং আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে আজ তাঁকে সারা দেশ চেনে।
তিনি পিসি মুস্তাফা। কেরলের ওয়ানাডের এক প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁর জন্ম। পরিবারের কেউই পড়াশোনা করেননি। মুস্তাফাই পরিবারের প্রথম সন্তান যিনি স্কুলে ভর্তি হন। তবে দারিদ্র এবং সঠিক পরিবেশের অভাব তাঁর পড়াশোনায় প্রথম থেকেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ষষ্ঠ শ্রেণিতেই ফেল করে বসেন। তাঁর পরিবারের যা অবস্থা ছিল, তাতে ফেল করা মানেই ভবিতব্য ছিল বাবা কোনও না কোনও কাজে তাঁকে লাগিয়ে দেবেন। তেমনটাই হয়েছিল। একটা ছোট কারখানায় দিনমজুরের কাজে লাগিয়ে দেন বাবা। সেই ছোট বয়সেই নিজের ভবিষ্যত্টা দেখে নিয়েছিলেন মুস্তাফা।
পড়াশোনা ছাড়া যে একটা ভাল জীবন পাওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়, তা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। কিছু দিন কাজ করার পরই তিনি নিজেকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়ার মনোস্থির করেন। না, এ বার আর থেমে থাকেননি। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করেন।
স্কুল পাশ করে কালিকটের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ফেলেন। প্রথমে বেঙ্গালুরুর মোটোরোলা কোম্পানিতে কাজ পান তিনি। তারপর সেখান থেকে প্রমোশন পেয়ে ব্রিটেনে চলে যান কয়েক বছরের জন্য।
জীবনটা গুছিয়ে ফেলেছিলেন মুস্তাফা। বর্তমানও ঝকঝকে করে ফেলেছিলেন কঠোর পরিশ্রমে। কিন্তু তাতেও মন মানছিল না তাঁর। কোনও ভাবে এটাকেই জীবনের সাফল্য ভেবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারছিলেন না। তার উপর দেশের প্রতি টানটাও ভুলতে পারছিলেন না। আর বিদেশি খাবারও মুখে সই ছিল না।
কয়েক বছর পর বিদেশের পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরে আসেন মুস্তাফা। বেঙ্গালুরু থেকে এমবিএ করেন। তখনই নিজের ব্যবসা শুরু করার কথা মাথায় আসে তাঁর। বেঙ্গালুরুর থিপাসানদ্রাতে তাঁর আত্মীয়দের একটি দোকান ছিল। মাঝে মধ্যেই সেখানে বসে গল্পগুজবে কাটিয়ে দিতেন।
খুব অবাক হয়ে দেখতেন, প্রতিদিনই ইডলি এবং দোসার ব্যাটার মহিলারা দোকান থেকে কিনে নিয়ে যান। ইডলি-দোসার এই ব্যাটারের চাহিদাও প্রচুর। সে যত খারাপ মানেরই হোক না কেন, দোকানে রোজ শেষ হয়ে যেত সেগুলো। তা থেকেই প্যাকেজড ফুড ব্যবসার কথা মাথায় আসে তাঁর।
প্রথমে মাত্র ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। খুড়তুতো ভাইদের সঙ্গে মিলে ইডলি-দোসা বানানোর ব্যাটার তৈরির ব্যবসা শুরু করে দেন। একটা ছোট দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন প্রথমে। কিছু ব্যাটার বানিয়ে আশেপাশের মহিলাদের মধ্যে প্যাকেট করে বিতরণ করেন।
প্রথমে চালের গুঁড়ো কিনে ব্যাটার বানাতে শুরু করেন। রাতারাতি হিট হয়ে যায় পরিকল্পনা। প্রথমে ব্যাটার খুব একটা ভাল না বানাতে পারলেও, যত দিন যায় আদর্শ ব্যাটার বানাতে শুরু করেন তাঁরা।
২০০৮ সালে তাঁরা ৫০ বর্গ ফুটের একটা ছোট রান্নাঘর ভাড়া নেন তিনি। সঙ্গে কেনেন একটা গ্রাইন্ডার। স্কুটারে করে ব্যাটারগুলো বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে শুরু করেন তাঁরা। একটু জনপ্রিয় হলে কোম্পানির নাম দেন বেস্ট ফুড প্রাইভেট লিমিটেড। পরে নাম বদলে রাখেন আইডি স্পেশাল ফুডস প্রাইভেট লিমিটেড।
২০১০ সাল নাগাদ তাঁদের ব্যবসা ৪ কোটি ছুঁয়ে ফেলে। ততদিনে ৪০ জন কর্মচারীও নিয়োগ করে ফেলেছেন মুস্তাফা। যদিও তখনও শুধুমাত্র বেঙ্গালুরুতেই এই ব্যাটার সরবরাহ করতেন তিনি।এখন ৫০ কেজি ব্যাটার সরবরাহ করে তাঁর কোম্পানি। সঙ্গে যোগ হয়েছে ৪০ হাজার চাপাটি, দু’লাখ পরোটা, দু’হাজার টমেটো এবং ধনেপাতার চাটনির প্যাকেট।
এই মুহূর্তে আটটি শহরে পৌঁছে গিয়েছে তাঁর কোম্পানি। দেশে বেঙ্গালুরু, মাইসুরু, ম্যাঙ্গালুরু, চেন্নাই, মুম্বই, হায়দরাবাদ, পুণে এবং বিদেশে শারজাতেও রয়েছে তাঁর সংস্থা। ডেলিভারির জন্য কোম্পানির নিজস্ব ২০০টা গাড়ি রয়েছে। কর্মচারীর সংখ্যা ৬৫০।
আর এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ফেল করা সেই ছেলেটার ব্যবসা কোথায় পৌঁছে গিয়েছে? ২০১৯-২০ সালে কোম্পানি ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা টার্নওভার আশা করছে।