রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৮ পূর্বাহ্ন

বিশ্বের সেরা ১০ মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাত

  • আপডেট সময় বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০২৩

অ্যাঞ্জেল জলপ্রপাত
প্রকৃতির মহিমা হৃদয়ে ধারণ করে অবলীলায় ঝরে চলেছে মনোরম জলপ্রপাত ও প্রাকৃতিক ঝর্ণাগুলো। কালের গহ্বরে শত শত সভ্যতা হারিয়ে গেলেও এগুলো এখনও বেঁচে আছে অকৃত্রিম কারুকাজে। বিশ্ব সংসারের এই প্রাণবন্ত জল-শিল্পগুলো যেন নিবেদিত হয়ে শিখিয়ে দেয় সৌন্দর্য্যের বুনন। পাশাপাশি দুর্গম পাহাড়ের সঙ্গে নমনীয়তার মায়াবী মেলবন্ধনে রচনা করে অস্তিত্বের জয়গান। সেই সঙ্গীতের সুরের সুধা পেতেই হাজারও পরিব্রাজক হন্যে হয়ে ঘর ছাড়ে। এই টান কোনও বিলাসিতার খোরাক নয়; বরং সৌন্দর্য্য, বিশালতা ও বিস্ময়কে নগণ্য দু’চোখ ভরে ধারণ করার এক অদম্য নেশার হাতছানি। তেমনি ১০টি নয়নাভিরাম ঝর্ণার বিস্তারিত নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের নিবন্ধ। চলুন, ডুব দেয়া যাক সেই জলজ মুগ্ধতার রাজ্যে।

এর অবস্থান ভেনেজুয়েলার কানাইমা ন্যাশনাল পার্কের লীলাভূমিতে। অয়ান-টেপুই পর্বতের কোলে সগৌরবে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে ৯৭৯ মিটার (৩ হাজার ২১২ ফুট)-এর এই দীর্ঘ পানির ধারা। স্থানীয় নাম কেরেপাকুপাই মেরু, যার অর্থ গভীরতম স্থানের জলপ্রপাত।

অ্যাঞ্জেল নামটি এসেছে বিমানচালক জিমি অ্যাঞ্জেলের নাম থেকে, যিনি ১৯৩৩ সালে গ্র্যান সাবানার উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় সর্বপ্রথম এই নির্ঝরকে আবিষ্কার করেন। ১৯৬০ সালের ২ জুলাই তার শেষকৃত্যের ভস্ম ফেলা হয় এই ঝর্ণায়।এটি বর্ষাকালে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ হাজার ৭৫০ গ্যালন বেগে প্রবাহিত হয়। বর্তমানে এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত।

তুগেলা জলপ্রপাত
দক্ষিণ আফ্রিকার রয়্যাল ন্যাটাল ন্যাশনাল পার্কের কেন্দ্রস্থলে মুখোমুখি হওয়া যাবে এই জলপ্রপাতটির সঙ্গে। প্রাকৃতিক শৈল্পিকতার এই অনন্য নির্মাণের দৈর্ঘ্য ৯৪৮ মিটার (৩ হাজার ১১০ ফুট)। ড্রাকেন্সবার্গ পর্বতমালার কঠিন দেহ বেয়ে নেমে গেছে এই অপরূপ ধারার মন্ত্রমুগ্ধতা। পাঁচটি স্বতন্ত্র স্তরে বিভক্ত এই নির্ঝরের গন্তব্য তুগেলা নদী। এই নদীর উৎপত্তি মন্ট-অক্স-সোর্সেস পাহাড়ে। এই পাহাড়ের উপর এবং সেই রয়্যাল ন্যাটাল ন্যাশনাল পার্ক; এই দুইটি পথে রয়েছে তুগেলার দুটি ঝিরি পথ।

এই ঝর্ণার আবিষ্কার হয় ২০ শতকে ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের মাধ্যমে। ভেজা মৌসুমে প্রতি সেকেন্ডে ৫০ ঘনফুট (১ দশমিক ৪১ কিউবিক মিটার) পর্যন্ত উঠে যায় এর প্রবাহ।

ট্রেস হারমানাস জলপ্রপাত
প্রকৃতির উচ্চতার অনুসন্ধানে এবারের জায়গাটি পেরুর ওটিশি জাতীয় উদ্যান। এখানেই দেখা যাবে ট্রেস হারমানাসের ত্রয়ী নির্গমণ, যা ৯১৪ মিটার (২ হাজার ৯৯৯ ফুট) উপর থেকে নেমে এসেছে। উদ্যানের পাশেই রয়েছে জুনিনের পেরুভিয়ান অঞ্চলের কাটিভিরেনি নদী।

রহস্যময় এই প্রপাতের আবিষ্কার নিয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। বর্ষাকালে এর প্রবাহের হার কল্পনার সীমাতিক্রম করে। তিনটি স্তরে বিভক্ত জলপ্রপাতটির নামের অর্থ তিন বোন, যেগুলোকে পরম মায়ায় আগলে রেখেছে সবুজ মনটেন বন।

পায়ে হেঁটে এর কাছাকাছি আসার কোন উপায় না থাকলেও এর চারপাশের আবহাওয়া বেশ অনুকূল। ২৫ ডিগ্রী তাপমাত্রার পরিবেশটাকে আরও আরামপ্রিয় করে তোলে বুনো পাখিদের কিচিরমিচির।

ওলোউপেনা জলপ্রপাত
ওলোউপেনাকে বলা যেতে পারে হাওয়াইয়ের মোলোকাই দ্বীপের গুপ্তধন। এই ভান্ডারের উন্মোচন কমে হয়েছিলো তার কোনও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। কিন্তু এখনও জলপ্রপাত এবং পাথরের এই সমন্বিত ঐশ্বর্য্য যে কোনও হৃদয়কে উদাস করতে সক্ষম।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই ঝর্ণার উচ্চতা ৯০০ মিটার (২ হাজার ৯৫৩ ফুট), যার কোমনীয়তা আশেপাশের সমুদ্রের আলিঙ্গনে প্রতিফলিত হয়। দ্বীপের স্নিগ্ধতার সঙ্গে ওলোউপেনা জলপ্রপাত যেন জল ও স্থলের এক মহিমান্বিত সম্প্রীতি।নিষ্কাশন এলাকাটি বেশ ছোট বলে এর পানির প্রবাহ তেমন বেশি নয়। তবে কায়াকিং-এর সময় স্রোতের মৃদু দোলাটা উপভোগ করা যেতে পারে।

ইয়াম্বিলা জলপ্রপাত
পেরুর অ্যামাজোনাসের পেরুভিয়ান অঞ্চলের গভীরে, সবচেয়ে বেশি চিত্তাকর্ষণের উৎসটি হচ্ছে এই জলপ্রপাত। সুসজ্জিত পাহাড়ি বনের মাঝ থেকে উত্থিত এই এক পশলা প্রস্রবনের উচ্চতা ৮৯৫ দশমিক ৫ মিটার (২ হাজার ৯৩৮ ফুট)। গভীর জঙ্গলের জীববৈচিত্র্যের ক্যানভাসের মাঝে জলের বজ্রকন্ঠ এক জাদুকরী আবহের সৃষ্টি করে।

অনেক আগে থেকে লোক চক্ষুর আড়ালে থাকা ইয়াম্বিলাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে ২০০৭ সালে এক ভৌগলিক সমীক্ষার সময়। এর জলপ্রবাহ তীব্র বেগে পাহাড়ের পাদদেশে আঘাত করে না; এমনকি অবিরাম বৃষ্টির মৌসুমেও নয়।

স্কোরগা জলপ্রপাত
নরওয়ের সানডালেন উপত্যকার অপরিসীম শূণ্যতাকে চিরকালের জন্য সমাধিস্থ করেছে এই ঝর্ণা। কাল্ড গ্লেসিয়ারের বরফ গলা পানি আংশিকভাবে অবদান রেখেছে ছোট দুটো হৃদের সৃষ্টিতে। এই হৃদ দুটিকে আশ্রয় দেয়া বেসিনের উৎপত্তিস্থল প্রায় ৯৩০ মিটার (৩ হাজার ৫০ ফুট) উচ্চতার সেই স্কোরগা ফল্স। এই অঞ্চলের কাঁচা রুপের প্রতিফলন স্কোরগার নির্ঝর আর নর্ডিক পুরনো সভ্যতার সঙ্গে সাদৃশ্য স্থাপন করে।

উচ্চতায় প্রতিবেশী জলপ্রপাত ভেনুফ্যালেটকে ছাড়িয়ে যাবার কারণে, উপত্যকার নিচ থেকে স্কোরগার অর্ধেকের কিছু বেশি দৃশ্যমান হয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ছোট হওয়ায় ভেনুফ্যালেটের পুরোটাই দেখা যায় উপত্যকা থেকে। ক্রস-উপত্যাকার সেরা দৃশ্যটি দেখা যায় সানডেলেনের ৬২ ও ৭০ হাইওয়ে জাংশনের ৮ কিলোমিটার পূর্ব থেকে।

বালাইফোসেন জলপ্রপাত
হোর্ডাল্যান্ড-এর ওসাফজর্ডান-এর মাঝ থেকে অনেকটা অস্ফুটে বেরিয়ে আছে যেন বালাইফোসেন। প্রায় ৮৫০ মিটার (২ হাজার ৭৮৮ ফুট) উচু এই রত্নটির প্রতি পরতে পরতে যেন সূক্ষ্ম জাঁকজমকের কাজ। নরওয়ের নদীর সঙ্গে ঝর্ণা আলিঙ্গনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মোহনীয় দৃশ্যের অধিকারি এই জলপ্রপাত।

এর জলপ্রবাহ ঋতুভেদে নতুন আঙ্গিকে সেজে ওঠে। গ্রীষ্মের রোদের সোনালী জল শীতের মাসগুলোতে রূপান্তরিত হয় বরফ কঠিন সোপানে। এরপরও অদৃশ্য হয়ে যায় না রোদের আলোয় প্রতিফলিত ঝলমলে ভাব।গড়পড়তায় এর স্বল্প প্রবাহের গতি থাকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২০ ফুট (৬ দশমিক ১ মিটার)। মাধুর্যমন্ডিত এই জলপ্রপাতের আবিষ্কার নিয়ে স্পষ্ট তেমন কিছু পাওয়া যায় না।

ভিনুফোসেন জলপ্রপাত
বালাইফোসেনের মতই পানি ও বরফের দারুণ এক ঐকতান ভিনুফোসেন। এই ৮৪৫ মিটার (২ হাজার ৭৭২ ফুট) উচ্চতার জলজ পতন নির্বিঘ্নে রাজত্ব করে চলেছে নরওয়ের স্যানডালে। মোর ওগ রোম্সডাল অঞ্চলের একটি সত্যিকারের অলঙ্কার এই জলপ্রপাত।

শীতকালে এর হিমায়িত দর্শন উষ্ণ মাসগুলোতে রূপান্তরিত হয় আলোকোজ্জ্বল নন্দিত ঝর্ণাধারায়। বহুরূপী প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে ভিনুফোসেনের জল প্রবাহের হারও পরিবর্তিত হয়। তবে বর্ষায় নয়; পানি প্রবাহের চাপ শীর্ষে থাকে তুষার গলা মৌসুমে।

ম্যাটেনবাখ জলপ্রপাত
সুইজারল্যান্ডের লটারব্রানেন উপত্যকায় এই ঝর্ণাটি পরিব্রাজকদের জন্য বেশ লোভনীয় ব্যাপার। ৮৪০ মিটার (২ হাজার ৭৫৫ ফুট)-এর একটি চোখ ধাঁধানো উচ্চতাটি অনায়াসেই লোভ জাগায় এর চূড়ায় পদচিহ্ন রাখার। সেখান থেকে আল্পস পর্বতমালার রূঢ়তার সঙ্গে পায়ের নিচের আদিম কমনীয়তাকে অনুভব করাটা কোনভাবেই এড়িয়ে যাবার নয়। পর্বতের সোপাকার গায়ে পানির ভূবন ভোলা নৃত্য এক নিমেষে ভুলিয়ে দেয় হাইকিং-এর কষ্ট।

২০২০ সালের ভার্টিকাল ওয়াটার ক্যানিয়নিং টিম বিশ্বের সর্বোচ্চ ঝর্ণা আবিষ্কারের অভিযানে গিয়ে খোঁজ পায় এই নৈসর্গের। এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য নির্ধারণ এখনও গবেষণাধীন রয়েছে। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, এখন পর্যন্ত সদ্য আবিষ্কৃত এই জলপ্রপাতটি ইউরেশিয়ার সর্বোচ্চ জলপ্রপাত।

জেমস ব্রুস জলপ্রপাত
আজকের ঝিরিপথ অনুসন্ধানের অভিযানটির ইতি টানা হবে হবে কানাডার প্রিন্সেস লুইসা মেরিন প্রাদেশিক পার্কে। এখানকার ৮৪০ মিটার (২ হাজার ৭৬০ ফুট) উচ্চতার জেমস ব্রুস জলপ্রপাত অকুন্ঠচিত্তে আত্ম-প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে পারে।

প্রিন্সেস লুইসা ইনলেট তুষারক্ষেত্র থেকে আসে দুটি সমান্তরাল স্রোত সারা বছরই থাকে স্পন্দনহীন। লকিল্টস ক্রিকের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া স্রোতগুলোর শেষ গন্তব্য থাকে চ্যাটারবক্স জলপ্রপাতে। মূলত, এটিই জেম্স ব্রুস ফল্স নামে পরিচিত। এক কথায় এটিকে বলা যেতে পারে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার রুক্ষ সৌন্দর্যের প্রমাণ।

উপসংহার
বিশ্বের সেরা এই ১০টি মনোহর প্রাকৃতিক ঝর্ণা ও জলপ্রপাত সৃষ্টি জগতের মহানুভবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই দর্শনীয় স্থানগুলো থেকে প্রস্থান নেবার সময় যে কোনও পর্যটকের ভেতরেই সৃষ্টি হয় আবার ফিরে যাবার তাড়া। রূপান্তর ও পরিবর্তনে অভ্যস্ত মানব হৃদয় অজ্ঞাত কাল ধরে অপরিবর্তিত থাকা এই বিস্ময়গুলো দেখে নিজেকে সপে দেয় স্তব্ধতায়। কেননা সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি ঝর্ণাগুলোয় জড়িয়ে আছে শত শত যুগের সম্প্রদায়ের গল্প। আর তাই, এই জলজ নৈসর্গের মাহাত্ম্যের বিস্তৃতি ছাড়িয়ে যায় এদের শ্বাসরুদ্ধকর উচ্চতাকেও।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com