ভিয়েতনাম। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পুচকি একটা দেশ। একটা সময় সাম্রাজ্যবাদী হিংস্রতার কবলে পড়ে নাস্তানাবুদ হয়ে গিয়েছিল এই দেশটি। তা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়িয়ে আজ সে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক দেশ। দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষগুলি সদা হাস্যময়। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অতুলনীয়। তেমনই সচেতন এখানকার নাগরিকরা। অতিথি তথা বিদেশি পর্যটকদের স্বাগত জানাতে এঁরা সদা প্রস্তুত। এমনকি যে দেশের অত্যাচারে দেশের হাল বেহাল হয়ে গিয়েছিল সেই দেশের নাগরিকদেরও তাঁরা হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানান।
কোভিড 19 মহামারিতে যখন গোটা বিশ্ব বিধ্বস্ত, সেই সময় রোগের হাত থেকে দেশবাসীকে একরকম বাঁচিয়ে রেখেছিল ভিয়েতনাম সরকার। কঠোর নিয়ম এবং সচেতনতার কারণে সেই দেশের রোগের প্রকোপ অনেকটাই কম ছিল। দেশে বিদেশি পর্যটকদের প্রবেশ একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতি সম্প্রতি নিজেদের দেশের দরজা বিদেশি পর্যটকদের জন্য খুলে দিয়েছে ভিয়েতনাম। শুধু তাই নয় বিদেশে বসবাসকারী ভিয়েতনামীদেরও দেশে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। শুধু দেশে প্রবেশ করলে কয়েকটি নিয়ম মেনে চলতে হবে।
ভিয়েতনাম প্রবেশ
ভিয়েতনামে প্রবেশ করতে গেলে ই-ভিসা সংগ্রহ করা যায়। কম করে ৩০ দিনের পর্যটন ভিসা মেলে। ভারত সহ ৮০টি দেশ ই-ভিসার আবেদন করতে পারে। কলকাতা থেকে বিমান চেপে সরাসরি ভিয়েতনাম পৌঁছোনো যায়। হো চি মিন সিটি, হ্যানয়, হুই ইত্যাদি স্থানে কলকাতা থেকে সরাসরি পৌঁছোনো যায়।
হো চি মিন সিটি
ভিয়েতনামে বেড়াতে গেলে হো চি মিন সিটি দিয়েই ভ্রমণ শুরু করা উচিত। অত্যন্ত এই ব্যস্ত আধুনিক শহর ভিয়েতনামের বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এখানকার রাস্তাঘাট, রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, শপিং মল সবসময় বিদেশি পর্যটকে ভর্তি থাকে। হো চি মিন সিটির দর্শণীয় স্থানগুলি রয়েছে প্রধানত দং খাই শহরে। এখানকার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হল মিউজিয়াম। দেশের অতীতের ইতিহাস জানতে গেলে এখানে যেতেই হবে। এছাড়াও উনিশ শতকের শেষে নির্মিত হওয়া গ্র্যান্ড নটর ডেম ক্যাথিড্রাল, ফরাসি উপনিবেশকালের বেশকিছু স্থাপত্যশিল্প, বৌদ্ধ এবং তাওবাদীদের বিখ্যাত জেড এম্পেরর প্যাগোডা দেখতে পাবেন এখানে। যদি শহরের মূল দুটি আকর্ষণই রয়েছে শহর কেন্দ্রের কিছুটা বাইরে। রিইউনিফিকেশন প্যালেস বা ইন্ডিপেন্ডেন্স প্যালেস। দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্টের আবাসস্থল ছিল এটি। ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল এখানেই দক্ষিণ ভিয়েতনামের যুদ্ধ থেমে যায়। ফলে ভিয়েতনামের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এটি। এবং দ্বিতীয় আকর্ষণটি হল ওয়ার রেমেনেন্টস মিউজিয়াম। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যদের নৃশংস এবং বর্বর অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই জাদুঘরে।
হুই
ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিয়েতনামের পুরোনো শহর হুই। প্রায় গোটা শহরজুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে এনগুয়েন সাম্রাজ্যের প্রাচীন নিদর্শন। পারফিউম নদীর তীরে গড়ে ওঠা প্রাচীন ঘেরা ইম্পেরিয়াল এনক্লোজারের দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই কিলোমিটার। এনগো মন গেট, থাই হোয়া প্যালেস, ডিয়েন থো রেসিডেন্স, হল অফ মান্দারিনটার সিলিংয়ের চিত্রশিল্প আকর্ষণীয়। ইম্পেরিয়াল এনক্লোজারের প্রাচীরের বাইরের দৃশ্যও অসাধারণ। অপূর্ব সুন্দর পারফিউম নদীতে নৌকা চড়েই সাধারণত শহর দেখার ব্যবস্থা করা হয়। টু ডক সমাধিমন্দির, থিয়েন মু প্যাগোডা সহ দেখে নিতে পারেন অন্যান্য দর্শনীয় স্থান। উপরি পাওনা পারফিউম নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য।
হ্যানয়
হো চি মিন বাণিজ্যিক কেন্দ্র হলেও ভিয়েতনামের রাজধানী হল হ্যানয়। গোটা দেশের পরিচয় পেতে চাইলে এই শহরই হতে পারে সেরা স্থান। আর পাঁচটা শহরের মতো এই শহরও ব্যস্ত। শহরে গাড়ির সংখ্যা প্রচুর। তবে তাও সাবেকি এই শহর পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। ভিয়েতনামের প্রকৃত জীবনযাত্রা এখানেই দেখতে পাবেন। এখানকার প্রাচীন ওল্ড টাউন কোয়ার্টার দেখে মুগ্ধ হন পর্যটকরা। শহরের জাদুঘরগুলি ইতিহাসের প্রাচীন কথা বলে। দেশের শিল্পকলা প্রদর্শনশালা তথা মিউজিয়াম অফ এথনোলজি এবং ভিয়েতনাম ফাইন আর্টস মিউজিয়াম নামের দুটো বিশ্বমানের জাদুঘর রয়েছে এখানে। এছাড়াও হো চি মিনের সমাধিমন্দির একটি অবশ্য দর্শণীয় স্থান।
মি সান
ভিয়েতনামে মি সান শহরে প্রবেশ করলে মনে হবে যেন রূপকথার ঘুমন্ত অরণ্য নগরীতে ঢুকে পড়েছেন। পর্বত এবং জঙ্গলে ঘেরা ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর মি সানের আরেক নাম মন্দির নগরী। শহরের নির্মাণ হয়েছিল চতুর্থ শতকে চাম যুগে। এটি হিন্দু প্রধান শহর। সপ্তম থেকে দশম শতক পর্যন্ত প্রাচীন হিন্দুধর্মীয় এই শহরটি বেশ ব্যস্ত নগরীই ছিল। এরপর থেকেই ক্রমশ লোকজন এই শহর পরিত্যাগ করতে থাকে। ত্রয়োদশ শতক থেকে এটি পুরোপুরিই পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হয়ে যায়। শহরটিতে এখনও প্রায় কুড়িটির মতো মন্দিরের কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলোই স্থাপত্যই তৈরি করা হয়েছিল ইট এবং বালির ব্লক দিয়ে। মন্দিরের স্থাপত্যশিল্পে এশিয়ার সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। বিশেষ করে ভারত এবং মালয় সাম্রাজ্যের ছাপই স্পষ্ট। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকানরা এরকম বহু প্রাচীন নিদর্শন ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরটিই যেন এক আস্ত জ্বলজ্যান্ত ইতিহাস।
হোই অ্যান
ভিয়েতনামের হোই অ্যান শহরটি পর্যটকদের জন্য একেবারে আদর্শ। প্রায় গোটা শহর জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঐতিহাসিক স্থাপত্য। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরাতন নগরীর ইমারতগুলি। পঞ্চদশ শতকের দিকে এই জায়গাটিকেই বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে জাপানি এবং চিনা ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করতেন। এখানে ব্যবসা সংক্রান্ত বৈঠক সারতেন। শহরজুড়ে সেই ব্যবসায়ীদের আবাস স্থলগুলি এখনও বর্তমান। কোনও কোনওটি আবার মিউজিয়াম হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এই বাড়িগুলি ঘুরে ঘুরে দেখলে প্রাচীন দিনগুলিতে পৌঁছে যাবেন। অনেকটা আমাদের মুর্শিদাবাদের নানা ঐতিহাসিক স্থানগুলির মতো। হোই অ্যান শহরের সবচেয়ে বড় নিদর্শন হল ট্র্যান ফু স্ট্রিটের পশ্চিমপ্রান্তের জাপানিজ ব্রিজটি। এর কাছেই রয়েছে ফুজিয়ান চাইনিজ কংগ্রেগেশনের অ্যাসেম্বলি হলটি। এছাড়াও শহরজুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ছোটোখাটো প্যাগোডা এবং মিউজিয়াম।