কলকাতা বা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এতবার গিয়েছি, কিন্তু দেশটির কোনো সমুদ্রসৈকতে যাইনি। তাই এবার পরিকল্পনা করেছিলাম যে দিঘায় যাব। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একটি সমুদ্রসৈকত দিঘা। এটি কলকাতা থেকে ১৮৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বলা হয়ে থাকে যে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনস্থান দিঘা।
কোরবানির ঈদের কারণে বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দরে বিশাল জনসমুদ্র পেরিয়ে কলকাতায় পৌঁছালাম গত ৯ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায়। কলকাতা থেকে দিঘায় যাওয়ার জন্য তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি কোচের টিকিট আগেই অনলাইনে বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। টিকিট ওয়েটিংয়ে ছিল। ভাগ্য ভালো যে ওয়েটিং থেকে সিট পেয়ে গেলাম। ১০ জুলাই একদম সকালবেলা ওঠে হাওড়া রেলস্টেশনের উদ্দেশে রওনা দিলাম। সকাল ৭টার আগেই ট্রেন ছাড়ল। পৌঁছালাম ১০টার একটু পর। খুব ভালো ট্রেন ছিল এবং ভ্রমণটাও উপভোগ্য ছিল। সঙ্গে ছিল বৃষ্টি। সুন্দর প্রকৃতি দেখতে ভালো লাগছিল। ফেরিওয়ালারা শিঙাড়া, ডিমচপ, রোল, ঘুগনি প্রভৃতি মুখরোচক খাবার নিয়ে ট্রেনে উঠছিল। খেতে বেশ সুস্বাদু ছিল। আর চা না খেলে তো তন্দ্রাভাব ও ক্লান্তিই কাটত না।
পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এই স্বল্প সময়ের ভ্রমণের মধ্যেই ট্রেনের কামরা ও ওয়াশরুম পরিষ্কার করলেন। বিনিময়ে যাত্রীদের কাছ থেকে বকশিশ নিলেন। বিষয়টা আসলেই খুব ভালো। আমাদের দেশের ট্রেনগুলোতেও এই ব্যবস্থা চালু করা উচিত।
দিঘা রেলস্টেশনে পৌঁছালাম বৃষ্টির মধ্যে। বর্ষাকাল সমুদ্রে যাওয়ার জন্য মোটেও সঠিক সময় নয়। ট্রেনের কিছু যাত্রী দিঘা স্টেশনে নেমে ধূমপান করেছিলেন, তাই তাঁদের প্রতিজনের থেকে ২০০ রুপি করে জরিমানা আদায় করল পুলিশ। বোঝা গেল, এখানে আইন খুব কড়া। আমাদের দেশে তো এমন আইন থাকলেও তা কার্যকর হতে দেখি না। বৃষ্টির মধ্যেই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, যা এখানে টোটো নামে পরিচিত, টোটোতে করেই একটি হোটেলে গিয়ে উঠলাম। একটা বিষয় খেয়াল করলাম যে টোটোর চালকেরা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছিলেন। একে ঈদ, তার ওপর রোববার, এ জন্য ভিড় যেমন বেশি ছিল, হোটেলভাড়াও বেশি ছিল। এসি রুমের ভাড়া ১ হাজার ৭০০-১ হাজার ৮০০ ও নন-এসি ১ হাজার ২০০-১ হাজার ৩০০ রুপি নিচ্ছিল। আর ভালো মানের হোটেলগুলো, যেগুলো সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি অবস্থিত, সেগুলোর ভাড়া ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার। দিঘায় সরকারি লজ রয়েছে, থাকার খরচও কম। ভালোভাবে আগে থেকে খোঁজ নিয়ে গেলে সস্তায় থাকার জায়গা পাওয়াই যেত। তবে হোটেলগুলোর গেট রাত ১১টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। তাই অনেক রাত পর্যন্ত সৈকতে বসে থাকা যায় না।
বোল্ডারে লেগে হাত-পা ছিলে গেল। তখন জোয়ার ছিল। সাঁতার জানি না, তাই ভয়ও লাগছিল। কিন্তু সে এক ভিন্ন উত্তেজনা। দিঘা ভীষণ ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি। মোটামুটি প্রায় ৯০ ভাগ মেয়ে ও নারী ছোট ছোট জামা, শর্টসসহ বিভিন্ন আধুনিক পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, সমুদ্রস্নান করছিলেন। নিরাপত্তাব্যবস্থাও ভালো। পর্যটনস্থানগুলো তো এমনই হওয়া উচিত, যেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ানো যায়। ঘুরতে গিয়েও যদি মনমতো পোশাক না পরা যায়, কিংবা নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা লাগে, তাহলে ঘোরার আনন্দই ম্লান হয়ে যায়।
দিঘায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত—দুটিই দেখা যায়। সন্ধ্যা হওয়ার আগে থেকেই আকাশ মেঘে ঢেকে ছিল, হালকা বৃষ্টিও হয়েছে, তাই সূর্যাস্ত উপভোগ করা গেল না। কিন্তু মেঘ কেটে যাওয়ার পরে চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করা গেল, যদিও পূর্ণিমা আসার তখনো ২-৩ দিন বাকি ছিল।
এখানে খাবারের দোকানগুলোতে সামুদ্রিক বিভিন্ন মাছ, যেমন রুপচাঁদা, চিংড়ি ও কাঁকড়া পাওয়া যায়। আবার তপসে মাছও মিলে। পাশাপাশি বিভিন্ন রকম রুটি, সবজি, ডাল, চাউমিন প্রভৃতি তো আছেই। আর সৈকতের মধ্যে যে বিক্রেতার কাছ থেকে পাপড়ি চাট খেয়েছিলাম, এর স্বাদ সহজে ভোলা যাবে না, যেমন স্বাদ ছিল, ঝালটাও ছিল তেমন বেশি। গান বাজিয়ে কী চমৎকারভাবেই না পাপড়ি চাট, ভেলপুরি, মুড়িমাখা প্রভৃতি বানাচ্ছিলেন লোকটি। সৈকতের পাশের দোকানে বসে মাটির পাত্রে চা খেতে কিন্তু ভুলবেন না।
এখানে হস্তশিল্পের বিভিন্ন দোকান রয়েছে। মন চাইলে কিনে আনতে পারেন আপনার পছন্দের কোনো জিনিস।
পরদিন সকালে কলকাতায় ফেরার ট্রেনের টিকিটও ছিল ওয়েটিং লিস্টে। শেষ পর্যন্ত সিট না পেয়ে বাসে করে কলকাতায় ফিরতে হলো। বাসে করে ফিরতে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে অল্প সময়ের যাত্রাবিরতিসহ। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাসযাত্রার কষ্ট কমিয়ে দিল।
ভ্রমণ বরাবরই আনন্দদায়ক। আর নতুন একটা জায়গায় ভ্রমণ করতে পারলে এই আনন্দ শতগুণ বেড়ে যায়। আজ (২৭ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব পর্যটন দিবস। বেশি বেশি ভ্রমণ করুন। সারা বছরই ভ্রমণের পরিকল্পনা করুন, ঘোরার জন্য টাকা জমান। আনন্দে বাঁচুন। আর প্রাণ খুলে গেয়ে উঠুন, ‘আজকে যে দল বেঁধে দিঘা যায়, নিরালা সফরে যাবে কাল সে।’