সাম্প্রতিককালে স্পেনের পর্যটন শিল্প দারুণভাবে উপকৃত হয়েছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে বেড়াতে আসা পর্যটকদের মাধ্যমে। সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ২০২২ সালে যে ২৫টি দেশের পর্যটকরা স্পেনে সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবও আছে।
স্প্যানিশ হালাল ইনস্টিউটের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যেসব মুসলিম নাগরিক স্পেনে বেড়াতে এসেছেন তাদেরকে পরিসংখ্যানের আওতায় আনা হয়নি।
তাই মুসলিম পর্যটকদের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। এই প্রবণতার কারণটিও বোধগম্য। স্পেনে যে মুসলিম ঐতিহাসিক স্থানগুলো আছে সেগুলোর কদর আছে কমবেশি সব দেশের পর্যটকদের কাছে।
এই সেদিন পর্যন্ত স্পেনে মুসলিম পর্যটকরা মুসলিমবান্ধব ভ্রমণ ও ইসলামিক ধাঁচের ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে পারতেন না যা প্রধানত পাওয়া যায় আন্দালুসিয়া অঞ্চলে। তবে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। হালাল পর্যটন এখন গোটা স্পেনজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, এখন এটি আর আন্দালুসিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়।
সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মুসলিম স্পেনের ইতিহাস প্রচার করার পাশাপাশি বর্তমানে ‘হালাল এক্সপেরিয়েন্স’ নামে একটি প্রজেক্ট পরিচালনা করছেন আইচা ফার্নান্দেজ। তিনি বলেন, ‘কোম্পানি, রেস্টুরেন্ট ও হোটেলগুলো চাইছে মুসলিম লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হতে। তবে তারা জানেন না কীভাবে পরিচিত হতে হবে।’
তাই তিনি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেখানোর চেষ্টা করছেন যে কীভাবে মুসলিম ক্রেতা ও সেবা গ্রহীতাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়া যায়। এর পাশাপাশি আইচা কর্ডোভায় ‘হালাল এক্সপেরিয়েন্স ফার্স্ট ইন পার্সন’ সেমিনার আয়োজনও করেছেন।
আইচা ফার্নান্দেজের সামনে আরও কিছু লক্ষ্য আছে। তার প্রজেক্ট শুধু কোম্পানিগুলোকে মুসলিমদের চাহিদাসমূহ বুঝার ক্ষেত্রে সহায়তা করে না এর পাশাপাশি স্পেনকে তুলে ধরতে চায় এমন একটি দেশ হিসেবে যেখানে মানুষ আন্দালুসিয়া ছাড়াও ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যসমূহ সম্পর্কে জানতে পারবে।
স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ থেকে এক ঘণ্টা দূরত্বের শহর টলেডোতে মুসলিম ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য আইচা সেখানে ওয়াকিং ট্যুরেরও আয়োজন করে থাকেন। এর পাশাপাশি আইচার সহকর্মী রাফায়েল মার্টিনেজ রাজধানী মাদ্রিদ শহরে মুসলিম ও আরব শিকড়সমৃদ্ধ এলাকায় একই ধরনের কর্মসূচি পালন করে থাকেন।
আইচা ব্যাখ্যা করেন যে, ‘আন্দালুসিয়া হলো আল-আন্দালুস কিন্তু আল-আন্দালুস আবার আন্দালুসিয়া নয়। আমরা চিন্তা করি যে, আল-আন্দালুসই মনে হয় এখন পর্যন্ত টিকে আছে। আমরা ভুলে যাই সোরিয়া, জারাগোজা, মাদ্রিদ, টলেডো, ক্যাসেরেস ও বাদাজোজের কথা।’
স্পেনের পর্যটনের বৈচিত্র্যকে ভালোভাবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে শুধু যে আইচা ও রাফায়েলই কাজ করছেন তা নয়। ‘লাস ফুয়েন্তেস ফাউন্ডেশন ফর ডিফিউশন অব ইসলামিক হেরিটেজ ইন স্পেন’-এর ডিরেক্টর বারবারা রুইজ বেজারানো আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘স্পেনের আভ্যন্তরীণ পর্যটনের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে মুসলিমবান্ধব পর্যটনের।’
অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে অনেক কোম্পানি মুসলিম বাজারে প্রবেশ করার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আইচা ফার্নান্দেজের কাছ থেকে জানা যায়, মুসলিম সেবা গ্রহীতাদের চালচলনে বুঝা যায় তারা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির ও গ্রুপ ট্রিপের মাধ্যমে একটু সময় নিয়ে ভ্রমণ করতে চান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই আসুন আর ইন্দোনেশিয়া থেকেই আসুন তারা সাধারণত: দুদিনের জন্য আসেন না। স্প্যানিশ হালাল ইনস্টিটিউট হলো স্পেন, ইউরোপের অংশবিশেষ ও দক্ষিণ আমেরিকায় হালাল ব্র্যান্ডসমূহের অ্যাক্রিডিটেশন বা অনুমোদন দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান।
স্পেন ও স্পেনের বাইরে এই বাজারের দারুণ প্রসার লক্ষ্য করেছে ইনস্টিটিউটটি। তারা দাবি করে, আগ্রহী স্প্যানিশ কোম্পানিগুলোর অনুমোদন লাভের হার ২০১০ সাল থেকে বাড়ছে ও একসময় সংখ্যাটি ১০০ হলেও বর্তমানে তা ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এই আগ্রহ আরও বেড়েছে ও অন্যান্য বাজারে নিজেদের পণ্য বিক্রির চেষ্টাও একটি কারণ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলিম জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। তাদের মাঝে একটি অগ্রসরমাণ মধ্যবিত্ত শ্রেণি আছে যারা নিয়মিত ভ্রমণ করে ও নিজেদের প্রয়োজনীয় সেবার চাহিদার কথা জানায়। ২০২২ সালের স্টেট অব দ্য ইসলামিক ইকোনোমি রিপোর্ট জানিয়েছিল, ২০২৩ সালের শেষে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ হবে মুসলিম।
আর এ কারণেই বিশ্বজুড়ে পর্যটন ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িতরা মুসলিম পর্যটকদের বিশেষ বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর দিকে নজর দিচ্ছে। দক্ষিণ স্পেনের আন্দালুসিয়ার টরেমলিনোস শহরের কস্তা দেল সোল হোটেল তাদের অমুসলিম কর্মচারীদের জন্য মুসলিম রীতিনীতি শেখানোর পেছনে অর্থ বিনিয়োগ করেছে। আর এর ফলে তারা তাদের মুসলিম অতিথিদেরকে তুলনামূলকভাবে ভালো সেবা দিতে পারছে।
স্পেনের উত্তর-পূর্ব উপকূলবর্তী বার্সেলোনা শহরের ম্যান্ডারিন ওরিয়েন্টাল হোটেল সাম্প্রতিক সময়ে হালাল হোটেল হিসেবে তালিকাভুক্ত। তারা দাবি করে যে, খাওয়া-দাওয়ার বাইরে আরও কিছু বিষয় মুসলিম অতিথিদেরেকে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে আলাদা করে রেখেছে।
রুমের সাজসজ্জা থেকে শুরু করে নামাযের সুব্যবস্থা করে দেওয়ার কারণে তাদের মুসলিম অতিথিরা এখানে সহজেই মানিয়ে নিতে পারেন এবং সার্বিক পরিবেশটি উপভোগও করেন।
হালাল ও মুসলিমবান্ধব পর্যটন এখন সারা বিশ্বেই বিকাশ লাভ করছে। সবই শুরু হয়েছে তুরস্কের বিশেষ কিছু উদ্যোগ ও বড় বড় হালাল রিসোর্টের আবির্ভাবের কারণে। তদুপরি এই প্রবণতা প্রসার লাভ করেছে এমনকি দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো অমুসলিম দেশেও।
আর এটি দ্রুতই তাদেরকে পরিণত করেছে র্যাংকিংয়ের ওপরের দিকের মুসলিমবান্ধব ভ্রমণ গন্তব্যে। স্পেনও ক্রমান্বয়ে মুসলিম পর্যটকদের প্রতি বন্ধুবৎসল হয়ে উঠছে।
বাস্তবতা উপলব্ধি করে মুসলিমদের চাহিদা পূরণ করার মতো হোটেল ও রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে স্পেনকে একটি মুসলিমবান্ধব ভ্রমণ গন্তব্যে পরিণত করতে।
স্পেনের মালাগা পৌরসভা সবার আগে একটি হালাল ট্যুরিজম গাইড তৈরি করেছে এবং সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত তৃতীয় হালাল ইন ট্রাভেল গ্লোবাল সামিটে তারা সেরা হালাল পর্যটন বিপণনের স্বীকৃতি পেয়েছে।
স্পেনের মুসলিমদের সোনালী অতীত ও এখনকার মুসলিমবান্ধব বিভিন্ন সেবার কথা উল্লেখ করে নিজের ওয়েবসাইটে একটি নির্দেশনা তৈরি করেছেন রাফায়েল মার্টিনেজ। তিনি এটিকে বিবেচনা করছেন স্পেনে মুসলিমদের ইতিহাস ও অবদানসমূহকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে।
সূত্র: দ্য নিউ আরব।