রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৬ পূর্বাহ্ন

সমুদ্রভ্রমণ, কুয়াকাটাই সেরা

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৩

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পটুয়াখালীর একটি উপশহর, নৈসর্গিক দৃশ্যের অবারিত ক্ষেত্র কুয়াকাটা। রাজধানী ঢাকা থেকে যাতায়াতের সুব্যবস্থা রয়েছে।

পদ্মা সেতু দিয়ে সড়কপথে ও নৌ-পথে আপনি উপভোগ করতে পারেন এই ভ্রমণানন্দ। তবে আমার কাছে নৌ-পথটাই অধিক আরামপ্রিয় মনে হয়েছে।

কুয়াকাটার অন্যতম সম্পদ ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সমুদ্রসৈকত। ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়ের বসবাস এই জেলায়। জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৭৮৪ সালে রাখাইন আদিবাসীদের বসবাসকালে কুয়াকাটা বনাঞ্চল সুন্দরবনের একটি অংশ ছিল। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে জলপথে এক ঘণ্টার পথ সুন্দরবন। বৌদ্ধধর্ম পালনকারী এখানকার আদিবাসীরা এক সময় সুপেয় পানির জন্য কুয়া খনন করতো। সেখান থেকে এই অঞ্চলের নাম কুয়াকাটা হয়েছে বলে জানা যায়, তবে ভিন্নমতও আছে।

ভ্রমণপিপাসু মানুষের অত্যন্ত প্রিয় বিষয় সমুদ্রভ্রমণ। সমুদ্র তার স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্যে বুকে টেনে নেয় সবাইকে। বিশাল নীল আকাশের প্রতিফলন ঘটে সমুদ্রে। নীল দিগন্ত মিলেমিশে একাকার হয় সমুদ্র জলের ঢেউয়ের খেলায় আছড়ে পড়ে বালুর তটে। সেই সমুদ্রের টানে ঘর ছেড়েছি আমরা দু’জন। সম্প্রতি আমি এবং আমার জীবনসঙ্গী জীবনে ছন্দ ফিরিয়ে আনতে এই সিদ্ধান্ত নেই।

রাজধানী ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল পৌঁছালাম সন্ধ্যা ৬টায়। আগে থেকেই বুকিং দেওয়া ছিল লঞ্চ কেবিন। কেবিন প্রতি দুই হাজার টাকা ভাড়া নিল। ৭টায় লঞ্চযাত্রা করে। বুড়িগঙ্গা নদীর উপর দিয়ে লঞ্চ চললো ধীরগতিতে। প্রথমটায় বুড়িগঙ্গা নদীর দূষিত পানি আর বেহাল দশা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফতুল্লাঘাট পার হওয়ার পর মনটা আবার আনন্দে ভরপুর হলো। নদীর বুক চিরে এগিয়ে চলল লঞ্চ। নদীর সুশীতল বাতাস আর তারায় খচিত বিশাল আকাশের মনোরম রাত্রিকালীন সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলাম।

অন্ধকার দূর করে একখণ্ড চাঁদও আকাশে উঠলো। ছাদের একপাশে বসে সেই দৃশ্য উপভোগ করা গেল কিছুক্ষণ। আমি ও আমার সঙ্গী কেবিনে এসে রাতের আহার পর্ব সমাপ্ত করলাম। হোটেলের মতোই ব্যবস্থা। সব ধরনের খাবারই পাওয়া যায়। দামও নাগালের মধ্যেই। দু’জনের খাবারের বিল এলো সাড়ে চারশ টাকা। এরপর কেবিনে মৃদু দুলুনিতে ঘুমাতে কোনো বাধা নেই। রাত প্রায় শেষ। বগা লঞ্চঘাটে পৌঁছাই প্রায় ভোরের দিকে। কাছাকাছি চলে এসেছি। আর মাত্র ৩০ মিনিট পরেই পটুয়াখালী যাবো।

নদীর ভালোবাসা, সুবাতাস, আর আপ্যায়ন শেষে আমরা ভোর ৬টায় পৌঁছাই পটুয়াখালি নদীবন্দরে। উদ্দেশ্য কুয়াকাটা গমন। একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে আমরা যাই বাসস্ট্যান্ডে। এর মধ্যে নাস্তা সেরে নেই একটি হোটেলে। বাসে উঠলাম। দু’ঘণ্টা লাগবে কুয়াকাটা যেতে। ১৪০ টাকা করে ভাড়া নিল। রাতে ঘুম কম হয়েছে। তাই বাসে উঠে এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলাম দু’জন।

এরপর প্রত্যাশিত কুয়াকাটা শহরে চলে এলাম। হোটেল বুকিং দেওয়াই ছিল। তবে না থাকলেও সমস্যা নেই প্রচুর হোটেল আছে এখানে। দেখে শুনেও নেওয়া যায়। ভাড়া ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যেই আছে। আমরা উঠলাম হোটেল মোহনাতে। চারদিকে প্রাকৃতিক দৃশ্য। চমৎকার ব্যবস্থা এখানে। নিরিবিলি মনোরম পরিবেশ। আমরা থাকব দু’রাত তিন দিন। খরচ হবে আনুমানিক সব মিলিয়ে ২০ হাজার টাকা।

এখানে কোনো রিকশা নেই। আছে ভ্যান আর অটোরিকশা। হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়ে প্রথমে যাই সমুদ্রসৈকতে। একটা ধাক্কা লাগে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের আদলেই গড়ে উঠেছে সৈকতটি। দৈর্ঘ্যে ছোট। কক্সবাজারের বিশাল ঢেউ এখানে নেই। তবে ঢেউয়ের আকৃতি ছোট হলেও সে তো সাগরকন্যা। তার বিশালত্ব ও গভীরতার সৌন্দর্য অনস্বীকার্য। একই বিচে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সৌভাগ্য ক’জনের হয়।

প্রথমদিন আমরা সন্ধ্যার আগেই চলে যাই সৈকতে। উদ্দেশ্য সূর্যাস্ত অবলোকন। এসময় মোটামুটি লোকসমাগম হয় ভালোই। কমলা রঙের সূর্যটাকে ধীরে ধীরে সমুদ্রের অতলে ডুবে যেতে দেখি। মুহূর্তটিকে আমরা ক্যামেরাবন্দি করলাম। সূর্যাস্তের এই অপরূপ দৃশ্যের পর আলো-আঁধারির সন্ধ্যা নেমে এলো সৈকতে। রাতের আকাশে দেখা দিল এক চিলতে চাঁদ। কমে যায় লোক সমাগম। আমরা দু’জন এই আবছা আলোর সৈকতে ঘুরে বেড়াই অনেকক্ষণ। জলে পা ডুবিয়ে হাঁটি। এ এক অন্য রকম অনুভূতি।

তারপর সৈকতে এসে ডাব খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করি। তীর ঘেঁষে বার্মিজ মার্কেটে করা যায় কেনাকাটা। পছন্দ অনুযায়ী আচার, গহনা, জুতা, নানান বাহারি হ্যাট ও শামুক ঝিনুকের সামগ্রীতে সাজানো দোকানপাট। বিভিন্ন হোটেলে রয়েছে খাবারের সুব্যবস্থা। পছন্দ মতো সামুদ্রিক মাছও খেতে পারেন। দাম মোটামুটি নাগালের মধ্যে। কয়েকটি হোটেল দেখে শুনে নিতে পারেন। আমরা রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে যাই। সারাদিন ঘোরাঘুরি ও ক্লান্তির পর খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন ভোরবেলা উঠে পুনরায় সাগরকন্যার টানে সৈকতে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে।

সকালে উঠে নাস্তা করে মিশ্রি পল্লী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। সেখানে রয়েছে আদিবাসী রাখাইনদের বাস। মোটরবাইক কিংবা অটোরিকশা করে যেতে হয়। রাস্তা কিছুটা খারাপ। মেরামতের কাজ চলছে। মোটরবাইক নিলে সবচেয়ে ভালো হয়। জনসংখ্যা বেশি হলে অটো নিতে পারেন। আমরা অটোতে করে মিশ্রি পল্লী যাই। সেখানে গিয়ে প্রথমে দুধ চায়ের সন্ধান করি। কারণ আমার সঙ্গীটি অসম্ভব চা-পিপাসু। মনের মতো চা পাচ্ছি না। বটতলায় বসে গরুর দুধের চা ও নাস্তা করি। দেখলাম বার্মিজপল্লীতে রাখাইনরা বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করছে। নানা রকম পিঠা, বার্মিজ শাল, থ্রি পিস বার্মিজদের হাতে বোনা। দুটো শাল নিলাম। দাম ৩শ-৪শ টাকার  মধ্যে। মার্কেটের শেষ প্রান্তে রাখাইনদের গ্রাম। ঐতিহ্যবাহী রাখাইন সম্প্রদায়ের পূর্বনাম আরাকানি। বার্মিজ ভাষার সঙ্গে এদের ভাষার মিল রয়েছে। পূর্বপুরুষ বার্মা থেকে এসেছে। ধর্ম বৌদ্ধ।

একসময় এই পুরো এলাকা রাখাইনদের দখলে ছিল। ব্রিটিশের রাজত্বে রাখাইনদের উপর অনেক অত্যাচার হয়েছে। ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে অনেক কাজও করেছে। তার নির্দশন ব্রিটিশ আমলে নির্মিত একটি বিশালাকৃতির বৌদ্ধমূর্তি। জানা গেল এই মূর্তির দৈর্ঘ্য ৩৬ ফুট। রাখাইনদের উপাসনালয়ে স্থাপিত র্মূতিটি। বর্তমানে রাখাইনপল্লীতে বৌদ্ধ মন্দিরে একটি বিশাল আকৃতির মিষ্টি পানির কুয়া রয়েছে দর্শকদের জন্য। ব্রিটিশের শাসনামলে এটিও তৈরি করা হয়েছিল।

সঠিক পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এসব স্মৃতিচিহ্ন। একটি ভঙ্গুর রাখাইন ভাষা শিক্ষা স্কুলেরও সন্ধান পাই। আদিবাসীদের ভাষাগুলোও এখন হুমকির মুখে। আদিবাসী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব। জানা যায় অনেক রাখাইন রা জমিজমা বিক্রি করে সব মিয়ানমার চলে যাচ্ছে! মাত্র কয়েক ঘর রাখাইন সম্প্রদায় এখানে বাস করছে। আদিবাসী ও তাদের ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে! রাখাইনপল্লীকে বিদায় দিয়ে পুনরায় আমরা মোটরবাইকে করে রওয়ানা দিলাম কুয়াকাটায় হোটেলের উদ্দেশ্যে। মোটরবাইকে যাত্রা অসাধারণ মনে হলো। মাত্র ২০ মিনিটে পৌঁছে যাই।

সন্ধ্যার পর আমরা যথারীতি চলে যাই সৈকতে। সাগরকন্যার সঙ্গে মিতালি স্থাপন করি। পরদিন সকালে সমুদ্রস্নানের সিদ্ধান্ত নেই। সমুদ্রজলে অবগাহন ছাড়া এই স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়।

সাগরতীরের ডাব খেয়ে নিলাম। মাথার উপর সূর্যদেব আলো উত্তাপ ছড়াচ্ছেন। স্নান করার উপযুক্ত পরিবেশ। লোকসমাগম খুব বেশি নয়। সমুদ্রও বেশ উচ্ছ্বলিত, মুখরিত। একদল তরুণ যুবকেরা স্পিডবোটে চড়ে বেড়াচ্ছে। পানিতে ঝাপ দিচ্ছে। দীর্ঘ সমুদ্রতট পেরিয়ে আমরা এক এক করে জলে নামি। ঈষদুষ্ণ জল। জলকেলিতে ব্যস্ত হয়ে যাই দু’জন। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে আমাদের গায়। সে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। আমাদের জলকেলিতে সেও অংশ নিচ্ছে। স্বাগতম জানাচ্ছে তার বুকে। একজন ক্যামেরা ম্যান আমাদের পিছু নিয়েছে। তার আবদার উপেক্ষা করতে পারলাম না। সেও ঝটপট আমাদের সব দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করলো। তবে এদের থেকে সাবধান! ৩০০ ছবি নিল সে। দাম চাইলো প্রতি পিস ১০ টাকা করে। আমার সঙ্গীতো রেগে আগুন! আমি ৫০ কপিতে সুরাহা করলাম। সমুদ্রজলে স্নান সেরে চলে আসি হোটেলে। কিন্তু হায় সমুদ্র কি মনে রাখবে আমাদের কথা।

কত খেলা করেছি তার বুকে। যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি। দু’হাতে আঁকড়ে ধরেছি। সমুদ্রের অবারিত হাতছানি আজও ডাকে আমাদের। একটু স্থান লাভ করে নিজেকে ধন্য মনে করেছি।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লেবুর চর। পরের দিন সকালবেলা মোটরবাইকে করে সৈকতের পাশ দিয়ে ২০ কিলোমিটার দূরে চলে যাই লেবুর চরে। সাগরের কোলঘেঁষে বালুকাময় পথে যাত্রা সেটাও রোমাঞ্চকর অনূভূতি।  কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাই লেবুর বনে। সেখানে সারি সারি সুদৃশ্য বনরাজি। ধ্বংসাবশেষ!

ইতিহাসের কোনো প্রাচীন জনপদের বনরাজির মতো পড়ে আছে। সিডর, আইলা ঘূর্ণিঝড়েও যে গাছগুলো টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। মজবুত লোহার মতো শক্তিশালী গজারিয়া বৃক্ষ শোভিত চরাঞ্চল। সাদা বালুকাময় চর তার একপাশে বন। মাঝে মধ্যে বৃক্ষের সারি। ঝোপের বন। ছবির মতো সুন্দর দৃশ্য। সেই অপূর্ব বনে গাছপালাশোভিত সমুদ্রতটে আমরা ভ্রমণ করি। জনহীন বনভূমি। তার মধ্যে আমরা দু’টি প্রাণী এঁকে দিই পদচিহ্ন।

একদিনে কুয়াকাটা ভ্রমণ সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজন কয়েকটি দিন। আর শুক্র-শনিবারে ভিড় বেশি হয়। আমরা তাই বেছে নিয়েছিলাম রবি থেকে মঙ্গলবার। সব দেখে শুনে আমার কাছে মনে হলো কুয়াকাটা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ পর্যটন স্থান। এ পর্যন্ত যতগুলো স্পট দেখেছি কুয়াকাটা তাদের মধ্যে সেরা।

সমুদ্রস্নান, সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য, বৌদ্ধ মন্দিরের দার্শনিক গাম্ভীর্য,  রাখাইন সস্প্রদায়ের উষ্ণ অভ্যর্থনা, লেবুর চরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য সব কিছু আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আসুন আমরা কুয়াকাটা ভ্রমণ করি উপভোগ করি প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্য এবং প্রিয়জনদের উপহার দেই চিরস্মরণীয় কিছু মূল্যবান মুহূর্ত।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com